বৃহস্পতিবার   ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪   পৌষ ১২ ১৪৩১

বক্তাবলী গণহত্যা ইতিহাসের নির্মম পদাবলী

রফিউর রাব্বি

প্রকাশিত: ২৯ নভেম্বর ২০২৪  


আমাদের মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসই যেমনি গৌরবের তেমনি শোকের। প্রতিদিন অসংখ্য স্বজন হারিয়েছি আমরা, শত্রুকে পরাজিত করে ক্রমাগত এগিয়ে গিয়েছি বিজয়ের দিকে। একাত্তরে যুদ্ধকালীন গোটা নয় মাস নিরীহ মানুষের উপর পাক সেনারা চালায় বর্বরোচিত নির্মম নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞ। সারা দেশের মতো নারায়ণগঞ্জেও রয়েগেছে তাদের সে নির্যাতন ও বর্বরতার অসংখ্য চিহ্ন।

 

 

নারায়ণগঞ্জে সংঘটিত হয়েছে ১০৯টি গণহত্যা, রয়েছে ৩৩টি বধ্যভূমি ও গণকবর, রয়েছে ৪৬টি নির্যাতনকেন্দ্র। যেখানে মুক্তিযোদ্ধা ও নিরপরাধ নিরীহ মানুষদের নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে। তবে সারা দেশের মতো নারায়ণগঞ্জেও মুক্তিযুদ্ধের রক্তাক্ত ও গৌরবের সে উপাখ্যান পুরোপুরি এখনো সংগ্রহ করা যায় নি, নেই কোন শহীদের তালিকা।  

 


একাত্তরের ২৯ নভেম্বর আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক শোক ও গৌরবের দিন। দিনটি বক্তাবলী গণহত্যা ও প্রতিরোধের দিবস হিসেবে পরিচিত। ২৫ মার্চ ইতিহাসের বর্বরতম গণহত্যার দুইদিন পর ২৭ মার্চ দুপুরে পাক সেনারা নারায়ণগঞ্জে প্রবেশ করতে গেলে ছাত্র-জনতার প্রতিরোধের মুখে পড়ে। সে দিন শহরে না ঢুকে নারায়ণগঞ্জ সরকারী বালিকা বিদ্যালয়ে রাত কাটিয়ে ২৮ মার্চ সকালে ভারি অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে শহরে ঢোকে হানাদার বাহিনী। যুদ্ধকালীন গোটা নয় মাস নিরীহ মানুষের উপর তারা চালায় বর্বরোচিত নির্মম নির্যাতন, হত্যাযজ্ঞ।

 


নারায়ণগঞ্জের পশ্চিমাঞ্চল ধলেশ্বরীর পাড় ধরে বক্তাবলীর বাইশটি গ্রাম। বক্তাবলী ও আলীরটেক দুটি ইউনিয়নের সমন্বয়ে বক্তাবলী পরগনা। তখন ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ থেকে মুন্সিগঞ্জের দিকে চলে যাওয়ার সহজ ও নিরাপদ যাত্রাপথটি ছিল এই বক্তাবলী। বক্তাবলীর পূর্বে ও দক্ষিণে ধলেশ্বরী নদী আর উত্তরে বুড়িগঙ্গা। দক্ষিণ আমেরিকার আটলান্টিকের পাড়ে লম্বা সরু দেশ চিলির মতো এ বক্তাবলী। দুই নদীর মাঝখানে বক্তাবলীর বাইশটি গ্রাম যেন দুপুরের ঘাসের ওপর বিছিয়ে রাখা মায়ের ভেজা কাপড়।

 


২৯ নভেম্বর রাতে যখন ঘন কুয়াশার চাদরে ঢাকা বক্তাবলী পরগনা; তখন নারায়ণগঞ্জ শহরের কয়েকজন রাজাকারের সহযোগিতায় মধ্যরাত সাড়ে তিনটায় পাকবাহিনী তিনদিন থেকে ঘিরে ফেলে গোটা বক্তাবলী। প্রথমে তারা গানবোট নিয়ে ধলেশ্বরী নদীর বুকে অবস্থান নেয়। সুবেহসাদেকের সময় বক্তাবলীর চরে গানবোট ভিড়িয়ে নদীর পাড়ে নামতে শুরু করে। সে দিন প্রচণ্ড কুয়াশার কারণে তারা গ্রামে অগ্রসর হতে সাহস করে না।

 

 

সে সময় মুক্তারকান্দি প্রাইমারি স্কুল ও কানাইনগর হাই স্কুলে মুক্তিযোদ্ধাদের দুটি ক্যাম্প ছিল। নদীর পাড় সংলগ্ন ডিক্রির চর মসজিদ ও বিভিন্ন বাড়িতে রাত কাটাতেন মুক্তিযোদ্ধারা। যার ফলে মুক্তিযোদ্ধারা সে দিন পাকসেনাদের উপস্থিতি সাথে সাথেই টের পেয়ে যান এবং প্রতিরোধের প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। অন্যদিকে কুয়াশা একটু কাটতে থাকলে কুঁড়ের পাড় অঞ্চলের নদীর কাছ থেকে গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে গ্রামের দিকে অগ্রসর হতে থাকে পাক সেনাবাহিনী।

 

 

তখন সকাল প্রায় সাতটা। মাহফুজুর রহমানের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা হানাদারদের প্রতিরোধ শুরু করেন। এখানে উল্লেখ্য মাহফুজুর রহমান পরবর্তী সময়ে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের প্রথম চেয়ারম্যান হয়েছিলেন। প্রতিরোধের শুরুতেই পাঁচজন পাকসেনাকে হত্যা করে মুক্তিযোদ্ধারা এবং আহত হয় বেশ কিছু পাকসেনা। পাকসেনারা পাঁচটি লাশ ও আহত দুই জনকে কাঁধে নিয়ে পিছু হটে।

 

 

এখানে প্রায় দুই ঘণ্টা প্রতিরোধ যুদ্ধ চলে। এ দুই ঘণ্টা প্রতিরোধের কারণে বক্তাবলীর গ্রামগুলো থেকে পঞ্চাশ হাজারেরও বেশি মানুষ তখন মুন্সিগঞ্জ ও বিভিন্ন অঞ্চলে নিরাপদে সরে যেতে সক্ষম হন। এর পরপরই পাকবাহিনী ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে গ্রামগুলোর ওপর। পাকবাহিনীর আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের মুখে মুক্তিযোদ্ধারা বাধ্য হয়ে পিছু হটেন। আর তখনই শুরু হয় পাকবাহিনীর তাণ্ডব।

 

 

তারা ডিক্রির চর নদীর পাড়ে সারিবদ্ধ দাঁড় করিয়ে একসাথে হত্যা করে চল্লিশ জন নিরীহ গ্রামবাসীকে। লক্ষ্মীনগর কবরস্থানের কাছে খড়ের পাড়ার ভেতরে আশ্রয় নেয়া দলবদ্ধ গ্রামবাসীদের আগুন দিয়ে পুরিয়ে হত্যা করে। শীতের সকালে রাজাপুরের হলুদ সরিষা ক্ষেত লাল হয়ে ওঠে, পড়ে থাকে লাশের পর লাশ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র শহীদুল্লাহ্, মুনীরুজ্জামানসহ বহু ছাত্র আর সাধারণ কৃষককে হত্যা করে ওরা। সে দিন বক্তাবলীতে ১৩৯ জনকে হত্যা করে পাক হানাদারবাহিনী। বক্তাবলী পরগনার বাইশটি গ্রামই গানপাউডার দিয়ে বিকেলের মধ্যেই জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছাই করে দেয়।

 


দেশে যে কয়টি গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে বক্তাবলী তার মধ্যে অন্যতম। এখানে প্রতিরোধ হয়েছে, পাকসেনাদের হত্যা করা হয়েছে, মুক্তিযোদ্ধারা শহীদ হয়েছেন। অথচ নির্মম আমাদের বাস্তবতা! আজ তিপ্পান্ন বছর পরেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ ছাত্রদের তালিকায় যেমনি এ বক্তাবলীর শহীদদের নাম নেই, স্থানীয় জেলা প্রশাসনের শহীদদের তালিকাতেও এ ১৩৯ জনের একজনেরও নাম নেই।

 

 

অথচ এ একটি মাত্র অঞ্চল যেখানে তখন একজনও রাজাকার বা স্বাধীনতা-বিরোধী ছিলেন না। এ বাইশটি গ্রামের প্রতিটি বাড়িতেই গ্রামবাসী মুক্তিযুদ্ধের নয়টি মাস নিজেরা খেয়ে না খেয়ে মুক্তিযোদ্ধা ও আশ্রয় নেয়া মানুষদের খাইয়েছেন, আশ্রয় দিয়েছেন। এ গ্রামগুলোর ছাত্র, যুবক, চাষাভূষা- প্রতিটি মানুষই ছিলেন প্রকৃত অর্থে মুক্তিযোদ্ধা। বক্তাবলীর সন্তানহারা, পিতাহারা, স্বজনহারা শহীদ পরিবারগুলো অর্ধশতাব্দী ধরে বয়ে চলেছে সেই ক্ষত, এখনও তাদের বুকফাটা আর্তনাদ, আহাজারি।

 


আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের ৫০ শতাংশ সত্যও এখনো উদঘাটিত হয়নি। এই সময়ে যারা রাষ্ট্র ক্ষমতায় এসেছেন সকলেই রাজনীতির প্রয়োজনে নিজেদের মতো করে মুক্তিযুদ্ধের বয়ান তৈরি করেছেন। আওয়ামী লীগ এত বড় একটি জনযুদ্ধকে দলীয় সম্পত্তি বানাতে গিয়ে গোটা মুক্তিযুদ্ধকে বিতর্কিত করেছে। কেউবা মুক্তিযুদ্ধটাকে খণ্ডিত করে আদর্শগত কারণে এর সত্য উদঘাটনে থেকেছে সম্পুর্ণ উদাসিন।

 

 

এতে করে মুক্তিযুদ্ধটাকে তারা পণ্য বানিয়ে বেচা-কেনার বাজারে তুলে নতুন প্রজন্মের কাছে অপ্রয়োজনীয়, অপ্রাসঙ্গিক কখনোবা গুরুত্বহীন করে তুলেছে। আজকের প্রজন্ম যখন দেখে একাত্তরে বা তার পরে জন্ম নেয়া সনদধারি মুক্তিযোদ্ধারা দেশে সর্বশক্তিতে বলীয়ান- অথবা দেশে সকল অন্যায়, অনিয়ম, গুম-হত্যা, নির্যাতন, বিচারহীনতা, দুর্নিতি, অর্থপাচার সবই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে বৈধ বলে চালিয়ে দেয়ার হীন-চক্রান্ত বিদ্যমান; তখন এই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে বিবেকবান কিংবা নুন্যতম মানবিক চিন্তা সম্পন্ন কোন মানুষের থাকার কথা নয়।

 


আহমদ ছফা বলেছিলেন, একাত্তরে যারা একবার রাজাকার-আলবদরে নাম লিখিয়েছেন তারা সারা জীবনই রাজাকার আর স্বাধীনতা বিরোধী। কিন্তু যাঁরা মুক্তিযুদ্ধ করেছেন বা ক্যাম্পে গিয়ে নাম লিখিয়েছেন তাঁরা সারাজীবনই মুক্তিযোদ্ধা নন। দেশের ক্রান্তিলগ্নে পদে পদে তাঁদের দেশপ্রেমের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে মুক্তিযোদ্ধা থাকতে হয়।

 

 

মুক্তিযুদ্ধ করেও যারা পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী, দেশের ও দেশের মানুষের স্বার্থ বিরোধী অবস্থান নেন কিংবা দেশের বা দেশের মানুষের সংকটে, দুঃসময়ে নিশ্চুপ থাকেন তারা মুক্তিযোদ্ধা থাকেন না। শেকড় ছিন্ন কোন প্রাণি বা উদ্ভিদ যেমনি বাঁচে না, একাত্তর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এ ভূখণ্ডের কোন ইতিহাসকেও টেকানো যাবে না।

 

 

আজকে মুক্তিযোদ্ধার তালিকা তৈরির চেয়ে জরুরি ছিল শহীদদের একটি তালিকা তৈরি করা। শহীদের সংখ্য নিয়ে বিতর্কে যেয়ে লাভ নেই। বিশে^ কোন গণহত্যার হিসেব পুরোপুরি নির্ভুল হয় নি। এইটির সাথে জড়িয়ে থাকে দুঃখ, ভালোবাসা, আবেগ আর স্বজন হারানোর বেদনা।  বক্তাবলী গণহত্যা দিবসে আমরা একাত্তর ও চব্বিশের সকল শহীদদের জানাই রক্তিম অভিবাদন।       এন. হুসেইন রনী  /জেসি


রফিউর রাব্বি : লেখক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব