Logo
Logo
×

বিচিত্র সংবাদ

বাংলাদেশে মনোরঞ্জনের গণমাধ্যম ও গৃহপালিত সাংবাদিকদের প্রসঙ্গ

Icon

আহমদ তমিজ

প্রকাশ: ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১০:৪৭ পিএম

বাংলাদেশে মনোরঞ্জনের গণমাধ্যম ও গৃহপালিত সাংবাদিকদের প্রসঙ্গ


বলা হয়ে থাকে মিডিয়া বা গণমাধ্যম হচ্ছে রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ। কখনো বলা হয় শক্তির দিক দিয়ে গণমাধ্যম একটি পারমানবিক বোমার চেয়েও বেশি শক্তিশালী। একটি এটম বোম একটি জনপদকে ধ্বংস করে দিতে পারে। কিন্তু গণ-মাধ্যম তথা সাংবাদিকতা একটি জনপদের মানুষের মন এবং মনণে আমূল পরিবর্তন এনে একটি সভ্যতার মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে।

 

 

কিন্তু মিডিয়া এই সংঘবদ্ধ শক্তিকে যখন একটি কর্তৃত্ববাদী শাসক গোষ্ঠী অবৈধ সুযোগ-সুবিধার মাধ্যমে বিভক্ত করে- আপোষ নামায় স্বাক্ষর কারিয়ে একটি শৃঙ্খলবদ্ধ সাংবাদিক গোষ্ঠী সৃষ্টি করে-তখন তাদের প্রধান প্রধান কাজ হয় শাসক গোষ্ঠীর অবৈধ ক্ষমতার মসনদকে টিকিয়ে রাখার জন্য মিথ্যা ও মিথ্যার সমর্থনে তাদের উন্নয়নের গীতাঞ্জলি পাঠে সোচ্চার হওয়া।

 

 

এহেন সাংবাদিকতাকে দেশ-বিদেশের বিজ্ঞ জন মনোরঞ্জনের সাংবাদিকতা বা অ্যাম্বেডেড জার্নালিজম বলে আখ্যায়িত করেছেন। সম্ভবত এ শ্রেণির সাংবাদিকদের পদ্মা নদীর মাঝি উপন্যাসের কথাশিল্পী মানিক বঙ্গোপাধ্যায়- কলম পেশা মজুর বলে-আখ্যায়িত করেছিলেন।

 

 

সাদ্দাম হোসেনের ইরাকে মার্কিন বাহীনির নেতৃত্বে ন্যাটো বাহিনীর বিমান হামলা ও স্থল অভিযানের শুরুতে পেন্টাগনের সামরিক সাজোঁয়া বহরের সাথে যাওরা সিত্রনএন বিবিসি ও ফক্স নিউজসহ অন্যান্য মিডিয়ার সাংবাদিকরা যুদ্ধ ক্ষেত্র থেকে যে সব রিপোর্ট পাঠিয়েছিল তার পুরোটাই ছিল মার্কিন ন্যাটো বাহিনীর কমান্ডারদের সেন্সর করা ও অনুমোদিত।

 

 

এইসব মিথ্যা রিপোর্টে ইরাকে লক্ষ লক্ষ মানুষ হত্যার নির্মম অভিযানকে জায়েজ করার জন্য নৈতিক ও রাজনৈতিক রঙ মিশিয়ে এ যুদ্ধের ন্যায্যতা প্রমাণ করে বিশে^ও মানুষের সমর্থন আদায়ের জন্য উক্ত মিডিয়াগুলো একটি মনস্তাত্মিক ক্যাম্পেইনে নেমেছিল।

 

 

গত পনের বছরে বাংলাদেশের গণমাধ্যম তথা সাংবাদিকদের উপর শাসকগোষ্ঠির দমন পীড়নের বিচ্ছিন্নভাবে আন্দোলন সংগ্রাম হলেও তা ফলপ্রসূ হয়নি। এ ব্যর্থতার প্রধান কারণ হলো- শাসকগোষ্ঠীর পক্ষে এক শ্রেণির সুবিধাবাদী সাংবাদিক নেতৃত্বের বিভাজন। তাদের সক্রিয় সমর্থনে কর্তৃত্ববাদী সরকারের শাসন নির্যাতন প্রবলতর হয়ে উঠেছিল।

 

 

সাংবাদকদের এই বিভাজন টিকিয়ে রাখার জন্য শাসকগোষ্ঠী দেশব্যাপী সাংবাদিকদের অন্যায় সুযোগ সুবিধা দিয়ে খুব দক্ষতার সাথে দেশে একটি অনুগত বেসরকারী গণমাধ্যম গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিল। দেশে তারা সরকারের ক্ষমতা ঘনিষ্ঠ সাংবাদিক হিসেবে পরিচিত লাভ করেছিল।

 

 

এদের মাধ্যমে সরকার সমর্থিত প্রেস ক্লাব ও সাংবাদিক ইউনিয়নগুলোর মাধ্যমে দুঃস্থ সাংবাদিকদের সাহায্যের নামে বিপুল অর্থ দিয়ে তাদেরকে সুবিধাবাদীতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ করে দেশে এক শ্রেণির গৃহপালিত সাংবাদিক সৃষ্টি করেছিল। এদের মধ্যে কাউকে টিভি, সাংবাদপত্র ও অনলাইন পোর্টালের মালিক সম্পাদক বানানো হয়েছিল।

 

 

সরকারী জমির প্লট বরাদ্দ ব্যাংকের পরিচালনা পরিষদের সদস্য, বিদেশে দূতাবাসে চাকুরি, অনেককে প্রধান মন্ত্রীর বিদেশ সফর সঙ্গী, হজ¦ কাফেলার সদস্য এমনকি কাউকে আবার শাসকদলীয় সংসদ সদস্য বানিয়েছিল। স্থানীয়ভাবে পৌরসভা বা সিটি কর্পোরেশনের মার্কেটের দোকন বরাদ্দ দিয়ে পরে তা বিক্রি করে সাংবাদিকদের পকেট ভারী করেছিন।

 

 

এমপিদের সহায়তায় অনেকে গার্মেন্টস ঝুট ব্যবসায় এবং জমি ক্রয় বিক্রয়ের দালালি ব্যবসায় নেমেছিল। মাস তিনেক আগে বর্তমানে পলাতক নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের এমপি শামীম ওসমান স্থানীয় রাইফেল ক্লাবে এক আলোচনা সভায় বলেছিলেন, আমি একজন সাংবাদিককে ব্যবসা করার জন্য ১০ লক্ষ টাকা দিয়েছিলাম।

 

 

এভাবে সারাদেশে সরকার সমর্থক একশ্রেণির স্বেচ্ছাচারী সাংবাদিক তৈরী করা হয়েছিল। এরাই গত ১৫ বছর কর্তৃত্ববাদী শাসকের পক্ষে তাদের উন্নয়নের গীতাঞ্জলি পাঠ করেছিল। এ সময় সরকার সমর্থক ব্যবসায়ী ও কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো গণমাধ্যমে বিপুল ভাবে বিনিয়োগ করেছিল। ফলে সাংবাদিককতার সার্বজনীন লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য আশঙ্কানজনকভাবে পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছিল।

 

 

এ সময় আদর্শিক সাংবাদিকতার পরিবর্তে হাজির হয় তথাকথিত পেশাদার সাংবাদিকতা। সাথে সাথে সাংবাদিকদের সংস্থা ও বেড়েছে লক্ষণীয় ভাবে। জেলা উপজেলা এমন কি ইউনিয়ন পর্যায়েও রয়েছে অগণিত সংবাদপত্রের কার্ডধারী সাংবাদিক। প্রশ্ন হচ্ছে এদের কাজ কি? তারা সেখানে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা তথা ঘটনার সত্য উদঘাটনে কতটা সোচ্চার ?

 

 

কিছুদিন আগে হেলেনা জাহাঙ্গীর নামের সরকার দলীয় একনারীকে সাংবাদিকতার নামে চাঁদাবাজীসহ বিভিন্ন অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছিল। তিনি জয়যাত্রা নামক একটি আইপি টিভির স্বঘোষিত মালিক ছিলেন। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে তার জয়যাত্রা নামক টিভির মালয়েশিয়ার প্রতিনিধি যিনি হতে যাচ্ছিলেন তার কাছ থেকে হেলেনা জাহাঙ্গীর পাঁচ লক্ষা টাকা ঘুষ নিয়েছিলেন।

 

 

দেশের বিভিন্ন স্থানে তার প্রতিনিধিরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে কেউ যদি টাকা দিয়ে টিভি বা পত্রিকার প্রতিনিধিত্ব ক্রয় করেন তিনি কি সাংবাদিকতা করবেন নাকি চাঁদাবাজি করবেন? এহেন চাঁদাবাজ সাংবাদিকদের খপ্পরে পড়ে অনেক নিদোর্ষ মানুষ অভিযুক্ত হচ্ছেন। ব্যক্তিগত  ক্রোধের কারণ অনেক নির্দোষ।

 


মানুষকে অপরাধের সাথে জড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। আটক হেলেনা জাহাঙ্গীর আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, আমি ২৫ বার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে বিদেশ ভ্রমণ করেছি। আমাদের সংবিধানে সাংবাদিকরা যাতে সত্য ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করতে পারেন সেদিকে লক্ষ্য রেখেই মৌলিক অধিকার হিসেবে চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং জনগণের বাক স্বাধীনতার কথা বলা হয়েছে।

 

 

তাই সাংবাদিকরা হচ্ছে জনগণের বাক স্বাধীনতা, আইনের শাসনও গণতন্ত্র রক্ষার কলাম যোদ্ধা। আর জনগণের পক্ষে স্বাধীনতার ধারক বাহক হচ্ছে স্বাধীন সংবাদপত্র। বিগত কতৃত্ববাদী সরকারের আমলে বিশিষ্ঠ আইনজ্ঞ শাহদীন মালিক এক সাক্ষাৎকারে যা বলেছিলেন, বলতে গেলে দু’ একটি ব্যতিক্রম বাদে প্রায় সব গণমাধ্যমে সংবাদ পত্র, টিভি চ্যানেল ও নিউজ পোটালের পিছনে রয়েছে ব্যবসায়ীক প্রতিষ্ঠান।

 

 

ব্যবসায়ীরা দলে দলে যেমন সংসদের চেয়েও বেশি ঢুকছেন সংবাদ মাধ্যমের জগতে। ফলে ব্যবসায়ীক স্বার্থে সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা সীমিত হওয়ার প্রবণতাকে এমন আর উপেক্ষা করা যায়না। গত ২ মে বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবসে গবেষণা প্রতিষ্ঠান টি আইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামন এক বিবৃতিতে বলেছেন।

 

 

বেশির ভাগ সংবাদ মাধ্যমের মালিকানা ব্যবসায়ীদের হাতে আর এ ব্যবসায়ী মহলের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে রাজনৈতিক সংশিষ্টতার কারণে মিডিয়া ক্যাপচার বা জবরদখল প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি পেয়েছে। ফলে পেশাদার সাংবাদিক অনেকক্ষেত্রে প্রকৃত মালিকদের স্বার্থে ও নিজেদের সুরাক্ষার জন্য প্রকৃত সংবাদ প্রচার গোপন করতে বাধ্য হচ্ছে।

 

 

বিশিষ্ট চিন্তাবিদ ও বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক ড. সলিমুল্লাহ খান এক সাক্ষাতকারে বলেছিলেন,  মিডিয়া এমন মিথ্যা অনৈতিকতা ও অকল্যাণকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য যেন দায়িত্ব নিয়েছে। তাই অনেকে আজ বলতে শুরু করেছেন- অতীতে লোকে মিথ্যা বলত আর মিডিয়া তখন সত্য খুঁজে বের করতো। এমন মিডিয়া বা গণমাধ্যম মিথ্যা বলে আর অনুসন্ধানীদের সত্য খুঁজে বের করতে হয়।

 

 

একটি সরকারের কতৃত্ববাদী ফ্যাসিস্ট হওয়ার পথে সংবাদপত্র তথা গণ মধ্যমের ও বিরাটা ভূমিকা থাকে। তাদের দায়িত্বহীন শর্তহীন সমর্থনে একটি স্বৈরাচারী সরকার ক্রমান্বয়ে তার নীতিতে অটল থেকে গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও জনগণের কাঙ্খিত শাসন থেকে একটি ভয়ঙ্কর শাসকে পরিণত হতে পারে।

 

 

এ ব্যাপারে ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা যায় নাৎসি জার্মানীর ফ্যাসিস্ট এডলফ হিটলার তার অশুভ অভিলাষকে চরিতার্থ করার পথে সে সময়ের সংবাদপত্র তথা মিডিয়াসমূহের তার একনিষ্ট প্রচারক হিসেবে কাজ করেছে। সংবাদপত্রের সেসময়ের ভূমিকা জার্মান জাতিকে হিটলারের গোড়া-সমর্থক হিসেবে গড়ে উঠতে সহায়তা করেছিল।

 

 

তারা হিটলারের পিছনে উণ্ডাদও শতা দাড়িয়ে ছিল । ফলে হিটলার মানুষ হত্যা জোর করে অন্য রাষ্ট্র দখলে নিয়ে সমগ্র বিশে^ অশান্তির দাবানল ছডিয়ে দিয়ে দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধ বাধিয়ে দিয়েছিল। একইভাবে মধ্য প্রাচ্যেও বিষফোঁড়া অবৈধ ইসরাইল রাষ্ট্রের পক্ষে বিশ^জুড়ে ইহুদি মালিকানাধীন বিখ্যাত পত্রিকা বা মিডিয়াগুলো জোড়ালো ভূমিকা রাখার কারনে এ অবৈধ রাষ্ট্রটি এখানো টিকে আছে।

 

 

গত ১৫ বছরে পেশাদার নামধারী দলবাজ সাংবাদিকরা হাওয়া ভবনের রহস্য উদঘাটনে সত্য মিথ্যার ফানুস উঠিয়েছিল। কিন্তু শতশত তরুণদেরকে যখন গুম করে আয়না ঘরের নিষ্ঠুর বন্দীশালায় আটকে রেখে নির্যাতন এমনকি হত্যা করেছে সে রহস্য উদঘাটনে তেমনভাবে তারা সোচ্চার হয়নি।

 

 

আওয়ামী গুন্ডারা যখন আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমান ও সংগ্রাম সম্পাদক আবুল আসাদকে বেআইনিভাবে পত্রিকা অফিস থেকে টেনে হেঁছড়ে বের করে অফিস তছনছ করেছিল তখন এইসব সম্পাদক সাংবাদিকরা মুখ বন্ধ করে এ ঘটনায় সম্পাদক পরিষদও নিন্দা জানিয়ে তাদের পক্ষে কোন বিবৃতি দেয়নি-উল্টো বলেছে এদের সাংবাদিকতার সাথে তারা একমত নয়।

 

 

এখন হাসিনা সরকারের পতনের পর তার উচ্ছিষ্ঠভোগীরা কেউ কেউ পালিয়েছে কেও আবার ভোল পালটিয়ে হাসিনা রেজিম এর বিরুদ্ধে কলম ধরেছেন।

 


পাদটাকা : ভারতের বিখ্যাত পত্রিকা ডেইলি ইন্ডিয়ান একমপ্রেস এর মালিক সম্পাদক ছিলেন রামনাথ গোয়েন্ধা একবার এক প্রাদেশিক মুখ্যমন্ত্রী তার সাথে সাক্ষাৎ করতে এসে আলোচনার মধ্যে বললেন আপনার পত্রিকার অমুক রিপোর্টার খুব ভাল কাজ করছে বলে তার খুব প্রশংসা করলেন।

 

 

গোয়েন্ধা পরদিন উক্ত রিপোর্টকে চাকুরি থেকে অব্যাহতি দিয়ে বলেছিলেন আমি এমন সাংবাদিকতাকে পছন্দ করিনা এমন রিপোর্টাকে পছন্দ করিনা যারা সরকারের প্রিয়ভাজন ও কাঙ্খিত ব্যক্তি হয়। কেননা সাংবাদিকের মৌলিক কাজ হচ্ছে সরকারের ভুল-ত্রুটির সমালোচনা করা। আর এ কারণেই একজন প্রকৃত নির্ভেজাল সাংবাদিক ক্ষমতাসীন সরকার ও সরকারী সংস্থাগুলোর চোখের কাঁটায় পরিণত হয়। লেখক: আইনজীবী/সাংবাদিক।      এন. হুসেইন রনী  /জেসি

Abu Al Moursalin Babla

Editor & Publisher
ই-মেইল: [email protected]

অনুসরণ করুন