শুক্রবার   ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪   পৌষ ১২ ১৪৩১

বাফুফে’র আলাদিনের চেরাগ

করীম রেজা

প্রকাশিত: ৩ আগস্ট ২০২২  


 
বাফুফে’র পূর্ণরূপ, বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন। বাফুফে অনেক বড় একটি কাজ সকলের অগোচরেই করে ফেলেছে। পত্র-পত্রিকার খবর থেকে এমনটাই যে কেউ ভাবতে পারে। মনে হতে পারে যেন তারা হঠাৎ করেই আলাদিনের চেরাগ হস্তগত করেছে। যার মূল্য বাংলাদেশি টাকায় ৩৫ কোটি টাকা । খুব গর্বের সঙ্গে প্রচার করা হচ্ছে আন্তর্জাতিক ফুটবল সংস্থা বাফুফেকে ৩৫ কোটি টাকা দিয়েছে একটি অত্যাধুনিক প্রশিক্ষণশালা নির্মাণ করতে।


বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ই সর্বপ্রথম বাফুফের আলাদিনের চেরাগ হাতে পাওয়ার খবর পায়। গুরুত্ব দিতেও তৎপর হয়। তাই বন মন্ত্রণালয় কাল বিলম্ব না করে, পরিবেশের কথা না ভেবে, দেশের সংরক্ষিত বনাঞ্চল রক্ষা বা উন্নয়নের কথা মাথায় না রেখে সেখানে ট্রেনিং সেন্টার নির্মাণের জন্য জায়গা বরাদ্দ দিয়েছে। মাঠ পর্যায়ে বন বিভাগের আপত্তিও গ্রাহ্যের মধ্যে নেয়নি। ২০১৩ সনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেছিলেন দুই বৎসরের মধ্যে বাংলাদেশে আরো ২০ শতাংশ বনায়ন করা হবে। এখন ২০২২ম আমরা জানি না কুড়ি শতাংশ বনায়ন বৃদ্ধির লক্ষ্য পূরণ হয়েছে কিনা। এবং অন্য নতুন লক্ষ্য নির্ধারণ হয়েছে কিনা। এমনিতেই পরিবেশের মানদন্ডে বনাঞ্চলের পরিমাণ অনেক কম। আশানুরূপ নূতন বন সৃষ্টি করা হচ্ছে না বরং খবরে প্রকাশ পায় সামান্য উপলক্ষে নিয়মিত বন ধ্বংস হচ্ছে। সে বের কোন প্রতিকার করা হয় না। বন ধ্বংস করার অনুমোদন পাওয়া যায়। এটা কোন মাত্রার পরিহাস, তা পরিমাপের জন্য বোধ করি একটি গবেষণা প্রকল্পের নিতান্ত প্রয়োজন।


গত ৭ই জুন কক্সবাজারের রামুর সংরক্ষিত বনাঞ্চলে ২০ একর জমি অর্থাৎ বনভূমি বরাদ্দ দেয় বাংলাদেশ বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়। উদ্দেশ্য বাফুফে ফুটবলের এতই উন্নতি করেছে,আরও উন্নতির জন্য একটি কারিগরি ট্রেনিং সেন্টার নির্মাণ করতে হবে। সেই সুবাদে তাদের সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ২০ একর জমি বরাদ্দ দেয়া হয়।


কক্সবাজারে মোট বনভূমি রয়েছে প্রায় আড়াই লাখ একরের কিছু বেশি। তার মধ্যে প্রায় পঞ্চাশ হাজার একর অবৈধ দখলে আছে। আবার রোহিঙ্গাদের জন্য প্রায় সাত হাজার একর বনভূমি উজার হয়ে গেছে। সরকারিভাবে এই সংরক্ষিত বনাঞ্চল থেকে প্রায় সাড়ে চৌদ্দ হাজার একর বনভূমি বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের বরাবর বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। পরিবেশবাদী বিভিন্ন সংগঠনের আশঙ্কা, এভাবে সংরক্ষিত বনভূমি ইজারা দিলে ভূমিদস্যুরা উৎসাহিত হবে। এমনিতেই ভূমিদস্যুর উৎপাতে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নানারকম উপায়ে পরিবেশ বিপর্যয় ঘটছে: প্রতিবেশ হুমকির মুখে। পরিবেশবাদী সংগঠনের একটি যৌথ সংবাদ সম্মেলনে গ্রীন কক্সবাজারের সভাপতি লিখিত বক্তব্যে জানান, “টেকনিক্যাল সেন্টার নির্মাণের জন্য যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় সরকারের ভূমি মন্ত্রণালয়ের কাছে আবেদন করেছিল। পরে সেই আবেদন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু মন্ত্রণালয় ভূমি বরাদ্দের বিষয়ে সরেজমিন তদন্ত করে মতামত দিতে বন বিভাগকে অনুরোধ করে। পরে বন বিভাগ জানায়, প্রস্তাবিত স্থান বরাদ্দ দেওয়া সমীচীন হবে না। টেকনিক্যাল সেন্টার নির্মিত হলে ওই এলাকার বন, বন্যপ্রাণী, জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হওয়া, পরিবেশ ও প্রতিবেশ ব্যবস্থা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে “


এরপরও টেকনিক্যাল সেন্টারের জন্য সংরক্ষিত বনভূমি বরাদ্দ হয়ে গেল। এখানেও সেই আলাদিনের চেরাগের দৈত্যের কারসাজি রয়েছে বলেই ধারণা করা অমূলক নয়। বনবিভাগ সরেজমিন তদন্ত প্রতিবেদনে স্পষ্ট ভাবে আপত্তি জানানোর পরেও বাফুফে বনাঞ্চল বরাদ্দ পেয়ে যায়। এ যেন অনেকটা মাঠে নামলাম, বাহ! ফু দিলাম, ফেলে দিলাম। বাহ করে ফু দিয়ে ফেলে দেয়ার ক্ষমতা যাদের আছে তাদের নাম বাফুফে হতেই পারে। 

বলিহারি! আমাদের মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাগণও জানেন না একটি দেশে কত শতাংশ বন থাকা প্রয়োজন। কত শতাংশ বাস্তবে আছে। কিভাবে তা সংরক্ষণ করা দরকার। সংরক্ষণ ও উন্নয়ন ব্যবস্থা কোন পর্যায়ে আছে। আর জানেন না বলেই তারা বন জঙ্গল সাফ করে সুদৃশ্য সুউচ্চ অত্যাধুনিক ভবন নির্মাণের প্রকল্প প্রস্তাবের পক্ষ নিয়ে থাকেন। কক্সবাজারকে এমনিতেই পঙ্গু করে দেয়া হয়েছে কর্পোরেট কালচার এর নামে। সেখানে প্রতিটি সরকারি বেসরকারি সংস্থা নিজস্ব রেস্ট হাউস, ভবন ইত্যাদি তৈরি করেছে। মিটিং এর নামে এই সব স্থাপনা বিনোদন, ভ্রমণ কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়। কক্সবাজারের মনোরম সৈকত কংক্রিটের আবরণে বিপর্যস্ত, ক্ষতিগ্রস্ত। সেই কক্সবাজারের উপর খোদ মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত দিয়েছে সংরক্ষিত বনাঞ্চলের আরো বিশ একর ধ্বংস করে দেয়ার। আমরা সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হলে যাকে সালিশ মানবো, তিনি যদি নিয়মবিধি ভঙ্গ করেন,তাহলে আর আমাদের যাওয়ার জায়গা থাকে না। দাঁড়াবার জায়গা থাকে না, বলার জায়গা থাকে না।

 

পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো সোচ্চার হয়েছে এই অবিবেচক প্রকৃতি ও প্রতিবেশ বিধ্বংসী সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে। বলা হচ্ছে এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে দেশের সংবিধানকেও গুরুত্বহীন বিবেচনা করা হচ্ছে। বাফুফের কর্মকর্তারা যেন এ দেশের বাসিন্দা নয়, তারা জানেন না সংরক্ষিত বন কি, বনের গুরুত্ব কি, তাদের কাছে একমাত্র বিষয় ৩৫ কোটি টাকা, একটি ট্রেনিং সেন্টার। সরকারের বরাদ্দ দেওয়া জায়গার উপর তারা ভবন নির্মাণ করবেন, সরকার কোথায় জমি বরাদ্দ করবেন এটা নিয়ে তাদের কোন মাথাব্যথা নেই। পরিবেশ প্রতিবেশ ধ্বংস করে বাফুকের উন্নতি ঘটলে দেশের উন্নতি যে ঘটবে না, জনস্বার্থে কোনও কাজে আসবে না, এই বোধ মন্ত্রণালয় এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের যত তাড়াতাড়ি হবে ততই পরিবেশবাদী তথা দেশের জনগণ হাফ ছেড়ে বাঁচবে।

 

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমগ্র বিশ্বে পরিবেশের বিপর্যয় ঘটেছে, প্রায়ই দেখা দিচ্ছে দাবদাহ, দাবানল। এ সব কিছুর অন্যতম প্রধান কারণ কার্বন-ডাই-অক্সাইড বৃদ্ধি। তা কমিয়ে আনা বা ভারসাম্য রক্ষার জন্য গাছের বিকল্প নাই। সবাই চেষ্টা করছে প্রাকৃতিক বনাঞ্চল সংরক্ষণ করার এবং কৃত্রিমভাবে বনাঞ্চল সৃষ্টি করছে। দেশের কর্তাব্যক্তিরা এসব বিষয় জানেন না বিশ্বাস করা কঠিন, বরং বিশদ ভাবেই জানেন। জেনে বুঝেও এ দেশের প্রতি, দেশের মানুষের প্রতি, তাদের দায়িত্বের প্রতি সুবিচার করছেন না। কেন করছেন না, সে ভিন্ন অলোচনা। বনের বরাদ্দ বাতিল করে বিকল্প ব্যবস্থার মাধ্যমে পরিবেশ,প্রতিবেশ রক্ষা করতে হবে। তবেই জনস্বাস্থ্য তথা বিশ্ব প্রতিবেশ উন্নত ও টেকসই হবে। কেআর/জেসি
 

এই বিভাগের আরো খবর