শনিবার   ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪   পৌষ ১৪ ১৪৩১

অপারেশন করতে গিয়ে রাইফেলের গুলি আটকে যাওয়ায় চরম ভয় পেয়েছিলাম  

বীর মুক্তিযোদ্ধা মহিউদ্দিন আহম্মেদ রতন

প্রকাশিত: ১৩ ডিসেম্বর ২০২২  

 

একাত্তরে ডিসেম্বর মাসে আমরা মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানীদের পরাজিত করে বিজয় অর্জন করেছিলাম। নতুন প্রজন্মকে মহান মুক্তিযুদ্ধের কথা তুলে ধরার জন্য এই বিজয়ে মাসে ‘দৈনিক যুগের চিন্তা’য় একাত্তরে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অপারেশনের কাহিনী তুলে ধরা হচ্ছে। আজ ছাপা হলো বীর মুক্তিযোদ্ধা মহিউদ্দিন আহম্মেদ রতনের লেখা পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে রাইফেলের গুলি আটকে ভয় পেয়ে যাওয়ার কাহিনী।  

 

 

বীর মুক্তিযোদ্ধা মহিউদ্দিন আহম্মেদ রতন : ১৯৭১ সালে আমি ছিলাম তোলারাম কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র। তখন ছাত্র রাজনীতিতেও ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গিয়েছিলাম। ফতুল্লা ছাত্রলীগের সহ সম্পাদক এবং যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলাম।  ১৯৭১ সালে সাতই মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের জনসভায় উদাত্ত কন্ঠে ঘোষণা করেন ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। বঙ্গবন্ধুর সেই বক্তৃতা শুনে আমরা স্পষ্ট বুঝে যাই যে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেই আমাদের দেশকে মুক্ত করতে হবে। ২৫ শে মার্চ পাকিস্তান বাহিনী যখন ঢাকায় প্রথম গণহত্যা শুরু করে তখনই বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষনা করেন। এরপর পাকিস্তানী সৈন্য ঢাকা থেকে বিভিন্ন জেলায় ছড়িয়ে পড়ে। তারা হামলা করে মানুষ হত্যার পাশাপাশি মানুষের ঘরবাড়ি ধ্বংস করে দেয়।

 

 

ঢাকায় গণহত্যা শুরুর পরপরই আমরা নারায়ণগঞ্জে ছাত্র-জনতা ঐক্যবদ্ধ হয়ে পাকিস্তান বাহিনীকে প্রতিরোধ করার সিদ্ধান্ত নেই। আমরা নিশ্চিত হয়েছিলাম যে, ঢাকার পরই পাকিস্তানীরা ঢাকার খুব কাছের শহর নারায়ণগঞ্জে হামলা করবে।  আমরা ছাত্র-জনতা ২৬ মার্চ সারাদিন শহরের ২নং রেল গেইট এলাকায় সমাবেশ করে পাকিস্তানীদের প্রতিরোধে প্রস্তুতি নিতে শুরু করি। সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে গিয়ে আমরা ছাত্রনেতারা জেলা প্রশাসকের অফিসের মালাখানা ভেঙ্গে সব বন্দুক ও রাইফেল লুট করে নিয়ে আসি।

 

 

২৭ শে মার্চ পাকিস্তান বাহিনী ঢাকা থেকে বিপুল অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে নারায়ণগঞ্জের দিকে রওয়ানা হয়। এ খবর পেয়ে আমরা ছাত্র-জনতা শহরে ঢোকার পথে মাসদাইরে অস্ত্র নিয়ে অবস্থান নেই। এসময় একটি রেল বগি উল্টে সড়কের উপর ফেলে রাখা হয়।  দুপুরে পাকিস্তান বাহিনী মাসদাইরে এসে আমাদের বাধার মুখে পড়ে। পাকিস্তান বাহিনীর সঙ্গে আমাদের ৪/৫ ঘন্টা গোলাগুলী হয়। আমাদের গুলীতে বেশ কয়েকজন পাকিস্তানী সেনা নিহত হয়।

 

 

এক পর্যায়ে পাকিস্তান বাহিনীর কামানের গোলা ও মেশিনগানের ব্রাশফায়ারের সামনে আমাদের টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়ে। তবুও ২৭শে মার্চ সারাদিন আমরা পাক বাহিনীকে নারায়ণগঞ্জে প্রবেশ করতে দেইনি। কিন্তু সন্ধ্যার পর ধীরে ধীরে পাকিস্তানীদের কামানের গোলা এবং মেশিন গানের গুলির কাছে টিকতে না পেরে আমরা পিছু হটতে শুরু করি। সারাদিন পাকিস্তান বাহিনীকে মাসদাইরে আটকে রাখতে পারাও আমাদের জন্য বড় সাফল্য ছিল। সারাদিন পাকিস্তান বাহিনীকে নারায়ণগঞ্জের প্রবেশ করতে না দেয়ার ফলে নারায়ণগঞ্জের লোকজন যে যেভাবে পেরেছে পালিয়ে নিরাপদ আশ্রয় চলে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছিল। যদি সেইদিন পাকিস্তান বাহিনীকে সারাদিন আটকে রাখা সম্ভব না হতো তাইলে তারা সরাসরি নারায়ণগঞ্জের ঢুকে অসংখ্য মানুষকে হত্যা করতো।

 

 

পাকিস্তানী বাহিনী কামান-মেশিনগানসহ বিপুল সংখ্যক অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে নারায়ণগঞ্জ দখল করে নেয়ার পর আমরা যারা মাসদাইরে প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলাম তারা ভাবলাম, এখন নারায়ণগঞ্জে থাকা আমাদের জন্য নিরাপদ নয়।  কারণ পাকিস্তান সেনাবাহিনী নারায়ণগঞ্জে ঘুরে ঘুরে তল্লাশি করে যারা পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলাম তাদের খুঁজে বের করে মেরে ফেলবে।

 

 

আমি ৩০ শে মার্চ নারায়ণগঞ্জ থেকে পালিয়ে মুন্সিগঞ্জের দিঘীরপাড়ে চলে যাই। সেখানে আমাদের এক আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নেই। সেখানে গিয়ে আমরা পরিকল্পনা করতে থাকি কিভাবে প্রশিক্ষন নিয়ে পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা যায়। কয়েক দিন পর আমরা বেশ কয়েকজন যুবক দিঘীরপাড় বাজারে বসে পরামর্শ করলাম যে করেই হোক আমরা ভারতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেব। আমরা তখন ভারত যাওয়ার সুযোগ খুঁজতে থাকি। কোন পথে ভারত যাওয়া যায় সে সম্পর্কে খোজ-খবর নেই। এরই মধ্যে আমরা ভারত যাওয়ার পথের ঠিকানা জেনে যাই।

 

 

একদিন আমরা ১০-১৫ জন যুবক দিঘীরপাড় থেকে নৌকা ভাড়া করে কুমিল্লার হোমনায় গিয়ে পৌঁছি। হোমনা থেকে কখনো হেঁটে কখনো নৌকায় আমরা ত্রিপুরার কোনাবন সীমান্ত দিয়ে ত্রিপুরায় প্রবেশ করি। সেখান থেকে জীপে চড়ে ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলায় পৌছি। তখন পথে পথে হাজার হাজার মানুষ বাংলাদেশ ছেড়ে ত্রিপুরা প্রবেশ করছিল।

 

 

আগরতলায় গিয়ে আমরা প্রথম কংগ্রেস ভবনে যোগাযোগ করি। সেখান থেকে আমাদের জয়বাংলা অফিসে পাঠানো হয়। জয় বাংলা অফিসে আমরা নেতাদের কাছে শীঘ্রই অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশে ফিরে গিয়ে পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার ইচ্ছা প্রকাশ করি। জয় বাংলা অফিস থেকে আমাদের পাঠানো হয় গোকুলনগর নামক একটি স্থানে। সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিংয়ের জন্য বাছাই করা হতো। সেখান থেকে আমাদের বাছাই করে সামরিক প্রশিক্ষণের জন্য আসামের শিলচরে লায়ালপুরে সামরিক ক্যাম্পে পাঠানো হয়।

 

 

সেখানে ভারতে ভারতীয় সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তারা আমাদের অস্ত্র প্রশিক্ষণ দেন। সেই ক্যাম্পে আমাদের ২৩ দিন প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। কিভাবে অস্ত্র চালাতে হয়, অস্ত্র কিভাবে বহন করতে হবে, কিভাবে বোমা নিক্ষেপ করতে হবে, বোমা তৈরি করতে হবে এসব আমাদেরকে হাতে-কলমে শিক্ষা দেয়া হয়।

 

 

প্রশিক্ষণ শেষ হওয়ার পর আমাদের বিপুল পরিমাণ অস্ত্র গোলাবারুদ দিয়ে বাংলাদেশের প্রবেশ করে পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার নির্দেশ দেয়া হয়। আমরা প্রথমে মেলাঘর ক্যাম্পে যাই সেখান থেকে সোনামুড়া সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশের প্রবেশ করি।এরপর পায়ে হেঁটে এবং নৌকায় চড়ে মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া পর্যন্ত আসি। গজারিয়া থেকে কাঠপট্টি এসে জালুয়াপাড়া সরকারি স্কুলে অবস্থান নেই।

 

 

আমরা প্রশিক্ষণ নিয়ে আসার পর পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে যে কয়েকটি অপারেশনে অংশগ্রহণ করেছি তার মধ্যে একটি বড় অপারেশন ছিল মাওয়া বাজার এলাকায় পাকিস্তান বাহিনীর উপর হামলা। তখন আমাদের ক্যাম্প ছিল বালিগাঁওয়ে। একদিন বালিগাঁও ক্যাম্পে খবর আসে যে মাওয়া বাজারের রাজাকার এবং সেনাবাহিনী একটি সভা করবে। পাকিস্তানের পক্ষে এবং মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে লোকজনকে বোঝানোর জন্য সেই সভা আহবান করা হয়েছিল। এই খবর এই খবর পেয়ে আমরা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর উপর হামলা করার সিদ্ধান্ত নেই।

 

 

পরিকল্পনা অনুযায়ী আমরা একটি স্পিডবোটে করে পদ্মা পাড়ি দিয়ে মাওয়া বাজারের কাছে যাই। সেদিন বাজারে হাট বার ছিল, আমরা নৌকায় করে মাওয়া বাজারে নামি। আমাদের মুক্তিযোদ্ধা দলটিকে দেখে লোকজন বাজার ছেড়ে চলে যায়। রাজাকার ও পাকিস্তানের সৈন্যরা একটি লঞ্চের মধ্যে ছিল। এ সময় তারাও জেনে যায় যে, মুক্তিযোদ্ধারা তাদের উপর হামলা করতে আসছে। এ খবর জানার পর তারা সেখান থেকে পালিয়ে যেতে শুরু করে। কিন্তু আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম তাদেরকে পালিয়ে যেতে দেব না, যেভাবেই হোক তাদের উপর হামলা করে তাদের ধ্বংস করব। তারা যখন লঞ্চ ঘুরিয়ে অন্যদিকে পালিয়ে যাচ্ছিল আমরা তখন রাস্তায় রাস্তা দিয়ে দৌড়ে লঞ্চকে ফলো করতে থাকি। পরিকল্পনা করি আমাদের সুবিধাজনক স্থানে তাদের উপর হামলা করবো। এক পর্যায়ে আমরা কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা পাকিস্তান সেনাদের  লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ শুরু করি। পাকিস্তান বাহিনীও লঞ্চ থেকে পাল্টা গুলিবর্ষন করে।

 

 

আমার হাতে তখন রাইফেল ছিল, আমি রাইফেল থেকে গুলি করতে করতে একসময় খেয়াল করি রাইফেলের গুলি শেষ হয়ে গেছে। পরে দ্বিতীয় ম্যাগাজিন ফিট করি। দ্বিতীয় ম্যাগাজিনের গুলিও শেষ হয়ে যায়। তৃতীয় ম্যাগাজিন ফিট করে গুলিবর্ষন করার সময় খেয়াল করি, গুলি বের হচ্ছে না। পরে পরীক্ষা করে দেখি ব্যারেল জাম ও গরম হয়ে গেছে। ইতিমধ্যে গোলাগুলির কারনে বারুদের গ্যাস আমার মুখে-বুকে ঢুকে পড়ে। আমার নিশ্বাস বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। আমি ডানে-বাঁয়ে তাকিয়ে দেখি যে আমার সহযোদ্ধারা কেউ নেই। তখন আমি ভীষণ চিন্তায় পড়ে যাই, তারপর অস্ত্র কাধে  নিয়ে দৌড়ে দূরে সরে যাওয়ার চেষ্টা করি। কিন্তু একটি ক্ষেতে কাঁদায় আমার পা আটকে যায়। আমি পা তুলে আর হাঁটতে পারছিলাম না। আমার মনে হচ্ছিল আমি সেখান থেকে আর উঠতে পারবো না. আমার হয়তো মৃত্যু হবে। আমি চরম ভয় পেয়ে যাই।

 

 

কিছুক্ষণ পরে দেখি নদীর পাড় থেকে কে যেন আমার নাম ধরে ডাকছে। সে কাছে এলে চিনতে পারি সে আনসার সদস্য, আমাদের মুক্তিযোদ্ধা। সে আমাকে বলে, আমাকে শক্ত করে ধরুন, আমি আপনাকে না নিয়ে যাব না। বাঁচলে দুজনেই বাঁচবো না বাঁচতে দুজনেই মরবো। এই কথা বলে সে আমাকে ক্ষেতের কাঁদা থেকে টেনে কাঁধে তুলে পাশের জমিতে নিয়ে যায়। এভাবে আমরা দুজনে বেঁচে যাই।

 

 

এদিকে পাকিস্তান বাহিনী ভেবেছিল যে আমরা মুক্তিযোদ্ধারা বিশাল বাহিনী নিয়ে তাদের চারিদিক থেকে ঘিরে ফেলেছি, এই ঘেরাও থেকে তারা আর বেঁচে ফিরতে পারবে না। এমন ভেবে তারা দ্রুত লঞ্চ চালিয়ে অন্যদিকে পালিয়ে যেতে শুরু করে। যেহেতু আমাদের গুলি ফুরিয়ে গিয়েছিল এবং সে কারনে আর পাকিস্তান বাহিনীর পিছু ধাওয়া করতে পারছিনা তা পাকিস্তান বাহিনী বুঝতে পারেনি। তারা জীবন বাঁচাতে দ্রুত লঞ্চ নিয়ে পালিয়ে  যায়।

এস.এ/জেসি

এই বিভাগের আরো খবর