রোববার   ২৪ নভেম্বর ২০২৪   অগ্রাহায়ণ ১০ ১৪৩১

আবাসিক এলাকায় ইটভাটা যেন মৃত্যুর গ্যাস চেম্বার

লতিফ রানা

প্রকাশিত: ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩  

 

# এসব ইটভাটা মারাত্মক বায়ুদূষণের বড় উৎস

 

 

দিগন্ত বিস্তৃত ফসলের ক্ষেত। তার পর গ্রাম আবারও সেই খেত। আর অবারিত খোলা সবুজ এই ক্ষেতের উপর দিয়ে যখন বাতাস বয়ে যায় তখন নদীর ঢেউয়ের মতো এখানকার সবুজ গাছের উপর যে ঢেউ খেলে যায় তখন কি যে এক অপরূপ দৃশ্যের তৈরি হয় তা চোখে না দেখলে বুঝানো সম্ভব নয়। প্রকৃতির এই দৃশ্যের প্রেমে পড়েই কবির হৃদয় মন কবিতায় ডুবে যায়। আর এক সময় এমনই এক দৃশ্য বিরাজ করতো নারায়ণগঞ্জ জেলার বন্দর উপজেলার ইউনিয়ন পরিষদের এলাকাগুলোতে। স্নিগ্ধ-শ্যামল প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যে ভরা এই এলাকাটি এক সময় সুজলা, সুফলা, শস্য-শ্যামলা আমাদের এই দেশের সৌন্দর্য্যরে প্রতীক হিসেবে শক্ত অবস্থানে ছিল।

 

তবে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ কিছু অর্থলোভী নেতাদের সাথে যোগসাজশ করে স্থানীয় কিছু অসাধু ব্যক্তি সেই নির্মল ও বিশুদ্ধ বাতাসকে বিষাক্ত ও দূষিত করতে সকল প্রকার চেষ্টায় মগ্ন হয়ে পড়েছেন। এখানে নিয়ম বহির্ভূতভাবে একের পর এক গড়ে উঠছে ইটভাটা। নতুন সভ্যতা তৈরির ভূমিকা রাখার নামে ধ্বংস করে যাচ্ছে বাঙ্গালীর ইতিহাস ও ঐতিহ্যের প্রতিনিধিত্ব করা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য ও পরিবেশ। নির্মল অক্সিজেনে সমৃদ্ধ এখানকার বাতাসের সাথে কার্বন-ডাই-অক্সাইড মিশিয়ে ধ্বংস করা হচ্ছে মানুষের বাঁচার অধিকার।

 

বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, দেশের পরিবেশ সংরক্ষণ আইন-২০১০ ও ইটভাটা নিয়ন্ত্রণ আইন-২০১৩ অনুযায়ী বসতি এলাকা, পাহাড়, বন ও জলাভূমির এক কিলোমিটারের মধ্যে কোনো ইটভাটা নির্মাণ করা যাবে না। এমনকি কৃষিজমিতেও কোনো ইটভাটা বৈধ হিসেবে গণ্য হবে না। এসব ইটভাটা বায়ুর মারাত্মক দূষণ হওয়ার বড় কারণ। অন্যদিকে বায়ুদূষণরোধে নানা পদক্ষেপের ঘোষণা দিয়েছে সরকার। এরই মধ্যে উচ্চ আদালত ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে বেশ কয়েকটি অবৈধ ইটভাটা বন্ধ করতে নির্দেশ দিয়েছেন।

 

কিন্তু বন্দরের ৫টি ইউনিয়ন পরিষদ এলাকার মধ্যে তিনটি ইউনিয়ন পরিষদই এখন অবৈধ ইটভাটা কারণে বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। প্রথমত এগুলো নির্মাণ করা হয়েছে আবাসিক এলাকার কৃষি জমির উপর। তার উপর এগুলোর মধ্যে নেই কোন পরিবেশবান্ধব আধুনিক প্রযুক্তি, নেই পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র। বিভিন্ন সময় এখানকার ইটভাটাগুলোতে অভিযান চালিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়। কিন্তু তার পরই আবার সেসব ইটভাটা প্রকাশ্যেই চালু হয়ে যায়।

 

স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা যায় বন্দর উপজেলার অবস্থিত পাঁচটি ইউনিয়নের (কলাগাছিয়া, বন্দর, মুসাপুর, ধামগড় ও মদনপুর) মধ্যে মুসাপুর, ধামগড় ও মদনপুর এই তিনটি ইউনিয়নের আবাসিক এলাকার যত্রতত্র অবৈধভাবে গড়ে উঠে ইটভাটা। এই তিনটি ইউনিয়নে অর্ধশতাধিকেরও বেশি ইটভাটা তৈরি হয়েছে বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে। এর মধ্যে মুসাপুর ইউনিয়ন পরিষদেই আছে প্রায় ২৫ টির মতো।

 

এসব এলাকার ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, মেম্বারসহ স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিরা এসব ইটভাটার মালিক। এখানকার ইটভাটাগুলোর কিছু অন্যের জায়গা লিজ নিয়ে আবার কিছু কিছু ইটভাটা অন্যের জায়গা অবৈধভাবে দখলে নিয়ে তৈরি করা হয়েছে বলেও জানা যায়। স্থানীয় প্রভাশালীরা এসব ইটভাটার মালিক হওয়ায় এখানে প্রশাসনের চোখে সহজেই ফাঁকি দেওয়া সম্ভব হয় বলে স্থানীয়দের অভিমত। তারা এসব প্রভাবশালীদের ভয়ে মুখ খুলতে পারে না।

 

গতকাল বিকেলেও বন্দর উপজেলার মুসাপুর ইউনিয়ন এলাকায় সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, রাস্তার দুই পাশে যেদিকে চাই সেদিকেই ইটভাটা। একের পর ইটভাটার চিমনি উকি মারছে আকাশের দিকে। তাই চারদিকে দেখা যায় শুধু ধোঁয়ার কুণ্ডলী। ইটভাটার উঁচু চিমনির মুখ দিয়ে নির্গত হওয়া কালো ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। এই কালো ধোঁয়া বের হওয়ার সাথে সাথে তার চারপাশের এলাকাটা ধোঁয়ায় অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়ছে। স্থানীয়রা জানায় এসব এলাকা স্বাধীনতার বহু পূর্ব থেকেই আবাসিক ও কৃষি জমি হিসেবে ছিল। এখানকার মানুষের প্রধান জীবিকাই ছিল কৃষি কাজ।

 

তাই একদিকে একাধারে বেশ কিছু জমি তারপর গ্রাম আবারও বেশি কিছু জমি আবারও গ্রাম। এভাবেই এখানকার গ্রামের গাছ-গাছালির সাথে বিস্তুত কৃষি জমির সবুজ ঘাসে মিলে মিশে একাকার হয়ে যেত। এসব জমিতে ফসলি জমি ছাড়াও চাষ হতো শাক-সবজির। চাষাবাদ ও সবজির মৌসুম ছাড়া অন্যান্য সময় এখানে গরু-ছাগল এখানকার মাঠে ঘাস খেয়ে বেড়াতো। কিন্তু এখন এখানে এসব চাষাবাদের কোন চিহ্নও নেই। ইটভাটার সৃষ্ট ধোয়ার কারণে এখানকার বাতাস ভারি হয়ে গেছে। স্থানীয়রা নিশ্বাসে সমস্যাসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। রাস্তা ঘাটে নির্মল বাতাসতো দূরের কথা ধূলাবালির জ্বালায় রাস্তাঘাটে চলাফেরা কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে।

এস.এ/জেসি

এই বিভাগের আরো খবর