শনিবার   ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪   পৌষ ১৪ ১৪৩১

আমার আঁকা ম্যাপ ও ড্রয়িং অনুযায়ী নারায়ণগঞ্জে বিমান হামলা হয়েছিল

বীর মুক্তিযোদ্ধা এমএ খালেক

প্রকাশিত: ১৮ ডিসেম্বর ২০২২  

 

একাত্তরে ডিসেম্বর মাসে আমরা মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানীদের পরাজিত করে বিজয় অর্জন করেছিলাম। নতুন প্রজন্মকে মহান মুক্তিযুদ্ধের কথা তুলে ধরার জন্য এই বিজয়ে মাসে ‘দৈনিক যুগের চিন্তা’য় একাত্তরে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অপারেশনের কাহিনী তুলে ধরা হচ্ছে। আজ ছাপা হলো বীর মুক্তিযোদ্ধা এম এ খালেকের আকাঁ  ম্যাপ ও ড্রয়িং অনুযায়ী গোদনাইলে বাংলাদেশ বিমান সেনাদের বিমান হামলার কাহিনী।  

 

বীর মুক্তিযোদ্ধা এমএ খালেক : আমার জীবনের পরম সৌভাগ্য যে মুক্তিযুদ্ধকালে আমি শীতলক্ষ্যা নদীর দুই পাড়ের বিভিন্ন স্থাপনার যে ম্যাপ ও ড্রয়িং করে দিয়েছিলাম সেই ম্যাপ-ড্রয়িং অনুযায়ী পাকিস্তান বাহিনীর উপর ভারত ও বাংলাদেশের বিমান সেনারা বিমান হামলা করেছিলেন। সেই বিমান হামলার পর পাকিস্তান বাহিনী সম্পূর্ণ কাবু হয়ে  আত্মসমর্পন করতে বাধ্য হয়েছিল। সে ঘটনা আমার জন্য একটি গৌরবের বিষয়। স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও সেসব কথা মনে হলে আসলেই আমি অত্যন্ত গৌরব বোধ করি।

 

১৯৭১ সালে আমি ঢাকা আর্ট কলেজে ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র ছিলাম। তখন পাকিস্তানিদের শাসন-শোষনের বিরুদ্ধে সারা বাংলাদেশের তীব্র আন্দোলন গড়ে ওঠেছিল। সে আন্দোলন ধীরে ধীরে চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে যায় ১৯৭১ সালে। ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে জ্বালাময়ী ভাষণ দেয়ার পর পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ করে দেশকে স্বাধীন করার একটি চেতনা দেশবাসীর মনে স্থান করে নেয়। এরপর পরপরই আসে কালো রাত ২৫ শে মার্চ। পাকিস্তানিরা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ঢাকায় নিরীহ মানুষের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং গণহত্যা শুরু করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখন স্বাধীনতা ঘোষণা করে বাঙালি জাতিকে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ার নির্দেশ দেন। সেই নির্দেশ অনুযায়ী সারাদেশে পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয় এবং দলে দলে মানুষ ভারতে গিয়ে অস্ত্র প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে।

 

আমি তখন থাকতাম নারায়ণগঞ্জের গোদনাইল গ্রামে ঢাকেশ্বরী কটন মিলের কোয়ার্টারে। সেখানে আমার বাবা চাকরি করতেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ার পর আমিও প্রস্তুতি নিতে শুরু করি কিভাবে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে ভারতে যাওয়া যায়। এক পর্যায়ে আমি কারো সাথেই কোন আলোচনা না করে আগরতলা চলে যাই। আগরতলা যাওয়ার পথ খুব একটা জানা ছিল না। কিন্তু পথে বেরিয়ে দেখি অনেক মানুষই আগরতলার দিকে যাচ্ছে। তাদের সাথে সাথে আমিও আগরতলা চলে যাই।

 

আগরতলা গিয়ে ক্রাফ্টাস হোস্টেলে উঠি। সেখানে গিয়ে আমাদের এলাকার শ্রমিক নেতা আশেক আলী মাস্টারকে পেয়ে যাই। আশেক আলী মাস্টার আমাকে ক্রাফ্টস হোস্টেলে থাকার ব্যবস্থা করে দেন। সেখানে আরো ছিলেন ন্যাপ নেতা অধ্যাপক মুজাফফর আহমদ, জ্ঞান চক্রবর্তী,কমরেড মোহম্মদ ফরহাদ, মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, মতিয়া চৌধুরী, আমাদের এলাকার সুনীল রায় এবং আগরতলার নেপাল নাগ প্রমুখ। তাদের পেয়ে আমি অত্যন্ত স্বস্তি বোধ করি।আমি যে ঢাকা আর্ট কলেজের ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র সেটা আমাদের এলাকার রাজনৈতিক নেতারা জানতেন। এক পর্যায়ে মুক্তিযুদ্ধ অত্যন্ত প্রকট আকার ধারণ করার পর বাংলাদেশে পাকিস্তান বাহিনীর উপর বিমান হামলা করার সিদ্ধান্ত নেন মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী প্রবাসী সরকার।

 

একদিন সিনিয়র নেতারা আর্ট কলেজে পড়ার কারনে ছবি, ম্যাপ ও ড্রয়িং করতে পারি বলে আমাকে নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদীর দুই পাড়ে যেসব কলকারখানা রয়েছে এবং যে সব কলকারখানায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী ক্যাম্প করেছিল তার একটি ম্যাপ এবং ড্রয়িং করে দেয়ার জন্য বলেন। শীতলক্ষ্যা পারে বিভিন্ন কলকারখানা কোথায় আছে এবং কোন কারখানার ভিতরে বা কোন প্রতিষ্ঠানের ভিতর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ক্যাম্প  আছে তা আমি ভারতে যাওয়ার আগেই জানতাম। আমাকে সেই শিল্প কারখানা ও পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ক্যাম্পের ম্যাপ তৈরি করার নির্দেশ দেয়ার পর আমি সেই কাজে মনোনিবেশ করি। ম্যাপ ও ড্রয়িং  তৈরি করার সহযোগিতার জন্য আগরতলার আর্ট কলেজের কয়েকজন ছাত্রকে আমার সাথে জুড়ে দেয়া হয়। আমি সেই সহযোগীদের নিয়ে শীতলক্ষ্যা পাড়ের শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর ম্যাপ এবং নকশা করতে শুরু করি।

 

এক পর্যায়ে আমার মনে হল আমি যদি আবার বাংলাদেশে এসে সেই এলাকা আবার ঘুরে দেখে যেতে পারি তাহলে হয়তো ম্যাপ আরো সুন্দরভাবে করা সম্ভব হবে। এজন্য আমি আর আশেক আলী মাস্টার বাংলাদেশ ফিরে আসি। আমি পুরো এলাকা ঘুরে ঘুরে দেখি এবং স্কেচ তৈরি করি। এই কাজ আমি মাত্র তিন দিনে শেষ করি। এইভাবে শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো পর্যবেক্ষণ এবং স্কেচ তৈরি করার পর তা নিয়ে আমি এবং আশেক আলী মাস্টার আবার আগরতলা ফিরে যাই।আগরতলা ফিরে আমি অত্যন্ত মনোযোগের সাথে আবার নতুন করে শীতলক্ষ্যা পাড়ের কলকারখানা এবং পাকিস্তান বাহিনীর ক্যাম্পের অবস্থানের ম্যাপ এবং ড্রয়িং করি । ১০ নভেম্বর আমার ম্যাপ ও ড্রয়িং করা শেষ হয়। তারপর একদিন আমি সেই ম্যাপ এবং ড্রয়িং নেতাদের হাতে তুলে দেই। তখন সেই ক্যাম্পে সিনিয়র নেতাদের অনেকেই ছিলেন।

 

এরপর কিছুদিন কেটে যায় এবং যৌথ বাহিনীর বিমান বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় বোমা নিক্ষেপ করে। নারায়ণগঞ্জে আমাদের এলাকা গোদনাইলে বার্মাইষ্ট্যার্ন তেল ডিপোতেও বোমা হামলা করে ডিপো ধ্বংস করে দেয়া হয়। আমি আমার ম্যাপ ও ড্রয়েংয়ে বার্মাইষ্টার্ন তেল ডিপো এবং সেখানে পাকিস্তান বাহিনী ক্যাম্প করে আছে তা নির্দিষ্ট করে দিয়েছিলাম। বিমান হামলা সফল হওয়ার কয়েক দিন পর ক্যাম্পে আমাদের এলাকার শ্রদ্ধেয় নেতা সুনীল রায় এসে আমাকে বলেন, তোমার ম্যাপ অনুযায়ী বিমান হামলা হয়েছে এবং অত্যন্ত সফল হামলা হয়েছে। তুমি অনেক ভালো কাজ করে দেখিয়েছো।

 

আমার তৈরি করা ম্যাপ এবং ড্রয়িং অনুযায়ী বিমান হামলা হয়েছে এবং সেই বিমান হামলা অত্যন্ত সফর হয়েছে সুনীলদার মুখে এসব কথা শুনে আমার অত্যন্ত আনন্দ হয়েছিল। স্বাধীনতার ৫০ বছর পর আজও সেই সাফল্যের কথা মনে হলে গর্বে আমার আমার বুক ভরে যায়।

এস.এ/জেসি
 

এই বিভাগের আরো খবর