শুক্রবার   ১৫ নভেম্বর ২০২৪   অগ্রাহায়ণ ১ ১৪৩১

বক্তাবলী আতংক

আর কতো লাশে বন্ধ হবে টেঁটা যুদ্ধ

প্রকাশিত: ১১ আগস্ট ২০১৮  

ফরিদ আহম্মেদ বাধন (যুগের চিন্তা ২৪) : ফতুল্লার বক্তাবলীর আকবর নগরের দূর্ধর্ষ সন্ত্রাসী সামেদ আলী হাজীর বাহিনীর হাতে নির্মমভাবে খুন হয়েছে জয়নাল আবেদীন মন্ডল নামের একজন মাটি ব্যবসায়ী। বৃহস্পতিবার দিবাগত শুক্রবার ভোরে টেঁটাবিদ্ধ জয়নাল ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীণ অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছেন।

তাঁর মৃত্যুর খবরে শুক্রবার সকালে সামেদ আলীসহ ৬টি বাড়িতে হামলা, ভাংচূড় অগ্নি সংযোগ করেছে প্রতিপক্ষের লোকজন। এসময় হামলাকারীরা সামেদ আলীর মালিকানাধীন ১০/১২টি ট্রলার ছিনতাই করে নিয়ে গেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ঘটনার পর এলাকা ছেড়ে পালিয়েছে সামেদ আলী ও তার বাহিনীর সদস্যরা।

এলাকায় থমথমে ভাব বিরাজ করছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে বলে জানিয়েছে থানা সূত্র। তবে জয়নালের নিহতের পর রহিম হাজী বাহিনীর সদস্যরা এলাকায় মহড়া দিয়ে যাচ্ছে বলেও আকবরনগরবাসী জানায়।

জয়নাল আবেদীনের মৃত্যুর ঘটনায় তার স্ত্রী ফাতেমা বেগম বাদী হয়ে বাদী হয়ে ফতুল্লা মডেল থানায় সামেদ আলী(৬০), রাজিব (২৬), আরিফ (৩০), গনি (৩৬), সজিব (২২), হৃদয় (১৮), আবুল হোসেন (৩৬), আলমগীর (৪২), আতিক (১৮), দিলু (৪৫), আলী হোসেন (৫৫), সুজন (২৫), সালাম (৫০), জুয়েল (২৬)সহ অজ্ঞাতনামা ২০/২৫ জনকে আসামী করে একটি মামলা দায়ের করেছেন। আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে আকবর এলাকায় টেঁটা যুদ্ধ থামবে কবে, এমন প্রশ্ন  এখন এলাকার সাধারণ মানুষের। তবে এ হত্যাকান্ডের ঘটনার পরপরই এলাকা ছেড়ে পালিয়ে গেছে সামেদ আলী ও তার বাহিনীর সদস্যরা।

ফতুল্লার পশ্চিম, কেরানী গঞ্জের দক্ষিন ও মুন্সিগঞ্জের  উত্তর দিক অবস্থিত বক্তাবলীর আকবর নগর এলাকা। এই এলাকাটিতে কখনো কেরানীগঞ্জ, কখনো মুন্সিগঞ্জ আবার কখনো নারায়ণগঞ্জের রাজনৈতিক ব্যাক্তিদের দ্বারা প্রভাবশালীরা করে বেড়ায় নানা অপকর্ম। আকবর নগর ও এর আশপাশের এলাকায় রয়েছে প্রায় অর্ধশত ইটভাটা। এই সমস্ত ইটভাটাকে কেন্দ্র করে প্রভাবশালী মহল আধিপত্য বিস্তারে একে অপরের উপর হামলা করে ধারালো অস্ত্র শস্ত্র নিয়ে।

তাদের প্রধান হাতিয়ার টেঁটা, বল্লম। দীর্ঘ এক যুগেরও বেশি সময় টেঁটা যুদ্ধে প্রায় ২০জন পঙ্গুত্ব বরণ করেছে। নিহত হয়েছে বেশ কয়েকজন। টেটা যুদ্ধে দিন দিন বেড়েই চলছে লাশের মিছিল। প্রশাসন একাধিকবার উল্লেখিত অভিযান চালিয়েও ঐ এলাকা থেকে নিশ্চিহ্ন করা যায়নি মানুষ মারার হাতিয়ার টেঁটা। প্রভাবশালী মহলকে টেঁটাযুদ্ধ থেকে নিবৃতও করতে পারেনি প্রশাসন।

আকবর নগর এলাকায় ৩টি জেলার দূর্দান্ত প্রভাবশালী মহল ঐ এলাকার স্থানীয় প্রভাবশালীদের দিয়ে টেঁটা যুদ্ধ বাঁধিয়ে থাকে। বলা চলে ঘেষণা দিয়েই উন্মুক্ত মাঠে আকবর নগর এলাকার প্রভাবশালীরা করে থাকেন টেঁটা যুদ্ধ। এর আগে আকবর নগর এলাকার খলিলকে ইট ভাটায় জীবন্ত পুড়িয়ে মারে একই এলাকার মোতালেব। সেই ঘটনাও রাজনৈতিক নেতাদের ছত্র ছায়ায়  হয়েছিল বলে অভিযোগ রয়েছে।

এক সময় খলিল হত্যাকান্ড ধামাচাপা পড়ে যায়। মোতালেব যাতে এলাকায় প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য সামেদ আলী নিজেই একটি বাহিনী গড়ে  তোলে। সামেদ আলী শুরু করেছিল বিভিন্ন বালু ও মাটি বাহী ট্রলার থেকে চাঁদাবাজী। সামান্য সব্জি  বিক্রেতা থেকে ইটভাটার মাটি মহালে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ করে,সামেদ আলী এখন টাকার কুমিরে পরিনত হয়েছে।

 নারায়ণগঞ্জ জেলার ফতুল্লা, কেরানীগঞ্জ ও মুন্সিগঞ্জের সিরাজদীখান এলাকার রাজনৈতিক নেতাদের শেল্টারেই দিন দিন বেপরোয়া হয়ে উঠেছে সামেদ আলী ও তার বাহিনীর সদস্যরা। এমন অভিযোগ আকবর নগরবাসীর। আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করেই বৃহস্পতিবার সামেদ আলী হাজী ও রহিম হাজীর লোকজনদের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়।

সামেদ আলীর লোকজন  রহিম হাজীর ভাতিজা নবী হোসেনকে প্রথমে মারপিট ও  টেঁটাবিদ্ধ করে। আর এ ঘটনার পরপরই রহিম হাজীর লোকজন সামেদ আলী পক্ষের লোকজনদের বাড়িঘরে হামলা, লুট ও ভাংচূর করে। এই ঘটনার পরপরই সামেদ আলীর লোকজন রহিম হাজীর লোকজনদের এলাকায় খুঁজতে থাকে। এবং রহিম হাজীর লোকজনদের উপর টেঁটা নিয়ে হামলা করে।  

বৃহস্পতিবার দুই পক্ষের হামলায় যারা আহত :

বৃহস্পতিবার সামেদ আলী হাজী ও রহিম  হাজীর লোকজনদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে আহত হয়েছেন, কেরানীগঞ্জ জেলার জলীল মন্ডলের ছেলে জয়নাল মন্ডল, নুরুল ইসলামের ছেলে জিহাদ, রেয়াজ আলীর ছেলে আসলাম  শেখ, বুইদ্দা মিয়ার ছেলে ইসরাফিল, রিয়াজলের স্ত্রী আউশি বেগম, হাজী রমজান আলীর ছেলে আলমগীর হোসেন, হাজী ফুল চাঁন মাতবরের দুই ছেলে কবির হোসেন ও নবী হোসেন, মামুনের ছেলে রায়হান, মৃত তাহের আলীর স্ত্রী নাসিমা বেগম, সামেদ আলীর ছেলে রনি, ইসরাফিল, রায়হান, আসলাম প্রমুখ।

যে ভাবে জয়নালের উপর হামলা: :

ঢাকার কেরানীগঞ্জের পূর্ব জাজিরা গ্রামের মৃত আব্দুল জলিল মন্ডলের ছেলে জয়নাল মন্ডল। জয়নাল ইটভাটার একজন মাটির কন্ট্রাক্টার ছিল। রহিম হাজীর ইটভাটায় জয়নাল মাটির কন্ট্রাক্টারীর কাজও করে। বেশ কয়েকদিন যাবৎ সামেদ আলী ও তার লোকজন জয়নাল আবেদীনের কাছে ১০ লাখ টাকা চাঁদা দাবী করে আসছিল।

চাঁদা দিতে বরাবরের মতোই অসম্মতি জানায় জয়নাল। এতে ক্ষিপ্ত ছিল সামেদ আলী। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পর রহিম হাজীর ইটভাটা সংলগ্ন নদীর পাড়ে ট্রলারে উঠার প্রস্তুতি নেয় জয়নাল। সে ট্রলারে উঠার সময় সন্ধ্যার ঘটনার সূত্র ও ১০লাখ টাকার চাঁদা না পেয়ে সামেদ আলী হাজীর নির্দেশে, জয়নালের উপর হামলা চালায় বেশ কয়েকজন।

এসময় জয়নালের কপালে একটি টেঁটা বিদ্ধ হয়। জয়নালকে বাঁচাতে গিয়ে টেঁটা বিদ্ধ হয় ইসরাফিল,ট্রলার চালক রায়হান ও আসলাম। জয়নালকে মৃত ভেবে হামলাকারীরা নদীর পাড়েই আহতদের ফেলে রেখে যায়। খবর পেয়ে জয়নালের স্বজনরা তাকে আহতবস্থায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেয়। বৃহস্পতিবার দিবাগত শুক্রবার ভোর সাড়ে ৪টার সময় জয়নাল আবেদীন মন্ডল মৃত্যুবরণ করে।

জয়নালের স্ত্রীর মামলা :

জয়নাল নিহতের ঘটনায় তার স্ত্রী ফাতেমা আক্তার শুক্রবার বিকেলে বাদী হয়ে ফতুল্লা মডেল থানায় সামেদ আলী হাজীকে প্রধান করে একটি মামলা দায়ের করেছে। নিহতের স্ত্রীর দাবী,প্রায় ১ মাস আগে থেকেই সামেদ আলী জয়নালের কাছে ১০ লাখ টাকা চাঁদা দাবী করেছিল।

চাঁদা না পেয়ে সামেদ আলীর নির্দেশে রাজিব, আরিফ, গনি, সজিব, হৃদয়, আবুল হোসেন, আলমগীর, আতিক, দিলু, আলী হোসেন, সুজন, সালাম, জুয়েলসহ অজ্ঞাতনামা ২০/২৫ জন তাঁর স্বামীকে মারপিটসহ কপালে টেঁটাবিদ্ধ করে। নিহত জয়নাল ১ কন্যা ও ১ ছেলে সন্তানের জনক বলে জানা গেছে।

সামেদ আলীর বাড়িতে হামলা :

জয়নাল নিহতের ঘটনায় সংবাদে শুক্রবার সকালে সামেদ আলীর বাড়িতে হামলা চালায় রহিম হাজীর লোকজন। এসময় সামেদ আলীর  অধিনস্ত ৪/৫ টি বাড়িতে অগ্নি সংযোগ করাসহ গবাদীপশু লুট করার অভিযোগ উঠেছে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে।

এছাড়াও সামেদ আলীর ১০/১২টি ট্রলারও  প্রতিপক্ষের লোকজন ছিনতাই করে নিয়ে গেছে বলেও অভিযোগ। অপরদিকে,সামেদ আলী হাজীর পক্ষের শরীফের পিকআপ ভ্যান, শহীদ ও সামসুলের বাড়ী, রাহিমার বাড়ী, দিলুর ২ টি বাড়িতে অগ্নি সংযোগসহ ভাংচূরের ঘটনা ঘটেছে।

বর্তমানে এলাকায় থমথমে ভাব বিরাজ করছে বলে জানিয়েছে স্থানীয়রা। অপ্রীতিকর পরিস্থিতি এড়াতে জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে ২ প্লাটুন পুলিশ মোতায়েন রয়েছে বলে নিশ্চিত করেছে থানা সূত্র।

আকবর নগর এলাকাবাসীর বক্তব্য :

বক্তাবলী চরাঞ্চল আকবর নগরের মূর্তিমান আতংকের নাম সামেদ আলী হাজী। ক্ষমতাসীন দলের লোক পরিচয়ে সামেদ আলী আকবরনগর এলাকায় নানা অপকর্ম করে যাচ্ছে দিনের পর দিন। সামেদ আলীর ছেলেদের সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের কারণে পুরো এলাকার জনগন এক প্রকার জিম্মি হয়ে পড়েছে। সম্প্রতি সামেদ আলীর  সাথে দ্বন্ধে জড়িয়ে পড়ে একই এলাকার রহিম হাজী।

খলিল হত্যা মামলার প্রধান আসামী মোতালেবকে সম্প্রতি এলাকায় ফিরিয়ে আনে রহিম হাজী। আর এ নিয়েই মূলত দ্বন্ধের সৃষ্টি। কারণ মোতালেবকে ১০/১২ বছর খলিল হত্যাকান্ডের পর,এলাকা ছাড়া করে রেখেছিল সামেদ আলী ও তার লোকজন। মোতালেব এলাকায় ফিরে আসার পরই গত কয়েক মাস ধরে চলছে আকবর নগরে উত্তেজনা।

রহিম  হাজীও এলাকায় আধিপত্য বিস্তারে মোতালেবকে তার সাথে রাখতে একটি বাহিনী গড়ে তোলে। প্রায় ১ মাস আগে রহিম ও সামেদ আলীর  বাহিনীর সদস্যের সাথে সংঘর্ষ হয়। এই সংঘর্ষের পর ফতুল্লা মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ শাহ মোহাম্মদ মঞ্জুর কাদের উভয় পক্ষকে থানায় ডেকে এনে আপোষ মিমাংসা করে দেয়।

আপোষ করে দেয়ার এক মাস যেতে না যেতেই সামেদ আলী হাজীর বাহিনীর হামলায় টেঁটা বিদ্ধ হয়ে মৃত্যু বরণ করে জয়নাল মন্ডল। টেটা যুদ্ধ নিয়ে শংকিত এখন আকবরনগরবাসী।  তাদের প্রশ্ন কবে নাগাদ শেষ হবে টেঁটা যুদ্ধ। আর কত যুগ আকবর নগর থাকবে অশান্ত। আগামী প্রজন্ম টেঁটা যুদ্ধ থেকে মুক্ত হবে কিনা এ নিয়েও তারা শংকা প্রকাশ  করেছেন।  

বক্তাবলী ইউপি চেয়ারম্যান শওকত  আলী যা জানান :

একমাত্র আমার ইউনিয়নের আকবর নগর এলাকা ছাড়া সব এলাকায় শান্তি শৃঙ্খলা রয়েছে। শুধু আকবর নগরে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে সংঘর্ষ ঘটে থাকে। কারো কথায় তারা মানতে নারাজ। প্রশাসনও দ্বন্ধ সংঘাত মিটাতে উদ্যোগ নিয়েছে একাধিকবার। তারা অভিযানও চালিয়েছে। কিন্তু ঐ গ্রামের  কিছু মানুষের জন্য হাজার হাজার মানুষের আতংকে দিন কাটে।

যে পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ ঘটেছে দুটি দলই খারাপ। যে জয়নাল মৃত্যু বরণ করেছে, সে ছিল একজন মাটি ব্যবসায়ী। দুই পক্ষের দ্বন্ধে একজন সাধারণ মানুষ মারা গেল।  আশা করি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আকবর নগরে সন্ত্রাসী কর্মকান্ড বন্ধে জোর পদক্ষেপ নেবে।

ফতুল্লা মডেল থানার ওসি মঞ্জুর কাদের যা বললেন :

আকবর নগর এলাকায় যে সংঘর্ষ হয়,তা মূলত আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করেই। এটা ঐ অঞ্চলের মানুষের বংশগত দ্বন্ধ বলা চলে। তবে জয়নাল নিহতের ঘটনায় তার স্ত্রী বাদী হয়ে একটি এজাহার দিয়েছে। অপ্রীতিকর পরিস্থিতি মোকাবেলায় পুলিশ প্রস্তুত রয়েছে। প্রতিপক্ষের লোকজন  কয়েকটি বাড়িতে হামলা চালিয়েছে বলে জানতে পেরেছি। ঘটনা যে ঘটাবে তার বিরুদ্ধেই আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।

 

 

 

 

 

এই বিভাগের আরো খবর