রোববার   ২৪ নভেম্বর ২০২৪   অগ্রাহায়ণ ১০ ১৪৩১

ওয়াহিদ রেজা-বন্ধুর প্রতি শব্দতর্পণ

করীম রেজা

প্রকাশিত: ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২  

জল, হাওয়া আর আলোর শরীকানাটুকু চিরতরে আমাদের জন্যই বোধ করি ছেড়ে দিয়ে গেল। গেল কোথায় মাটির গভীর অন্ধকারে। এইভাবে আচমকা তার চির-অন্তর্ধান স্বজন, বন্ধু এবং আত্মীয়দের জন্য মেনে নেয়া কঠিন। ওয়াহিদ রেজা আর তার চেম্বারে বসবে না, সিগারেট ধরিয়ে স্বভাবজাত ভঙ্গিতে আড্ডার আসরটি একাই জমিয়ে রাখবে না, ভাবতে কেমন লাগছে, তা প্রকাশের ভাষা নেই।


ওয়াহিদ রেজার সঙ্গে এই ফেব্রুয়ারির ১ তারিখে আরেক বন্ধু ইউসুফ আলী এটমের বাসায় একসঙ্গে সময় কাটানোর কথা। আগের রাতেই কথা হয়েছিল স্বপন ১০টার মধ্যে এটম ভাইয়ের বাসায় যাবে। স্বপন ছিল ওয়াহিদ রেজার ডাকনাম। লেখালেখির বাইরে তার আরেকটি পরিচয় ছিল ডাক্তার হিসেবে। ডাঃ এম এ রাব্বি ।

 

মুখ ও দন্তরোগের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ছিলেন। তার বাবাও খ্যাতিমান দন্তচিকিৎসক ছিলেন। রুটি রুজির স্বার্থে বাবার পেশাই বেছে নিয়েছিল সে। বয়সে বছর কয়েকের বড় হলেও তুই তুকারির সম্পর্কই ছিল আমার সাথে। দীর্ঘদিন প্রবাসে থাকার কারণে যোগাযোগ ছিল না। শুধু ওয়াহিদ রেজা নয়, অনেকের সঙ্গেই। বিদেশের সম্পর্ক চুকিয়ে বুকিয়ে এসে সবার সঙ্গেই আস্তে আস্তে পুরনো সম্পর্ক ঝালাই করছিলাম। এই পর্যায়ে এমন একজনকে হারালাম, যার অভাব আজীবন থাকবে।


আমার রওনা হতে একটু দেরি হয়েছিল। ভাবছিলাম ওয়াহিদ রেজা হয়তো গিয়ে আমার অপেক্ষায় বসে আছে। যাহোক এটম ভাইয়ের বাসায় গিয়ে দেখি সে তখনও পৌঁছায়নি। আমি শীতলক্ষা পাড়ি দিয়ে প্রায় যথাসময়ে গিয়ে উপস্থিত হলাম আর সে তখন পর্যন্ত শহর থেকে ইসদাইর যেতে পারল না। ফোন করলাম একটু চোটপাট করার মত করেই।

 

ও বলল কয়েক মিনিটের মধ্যেই বাসা থেকে বের হচ্ছে। রাতে ঘুমের বিঘ্ন ঘটেছে তাই দেরি। বেশ কিছুক্ষণ পর ফোন করে রাস্তার হদিস জানতে চাইল। বুঝলাম ‘পথিক পথ হারাইয়াছে’, নতুন গজিয়ে ওঠা সম্প্রসারিত শহর তলির বাসার পথ ঠিক চিনতে পারছে না। যাই হোক রাস্তার বিবরণ দিয়ে আমি আর এটম ভাই বাড়ির পাশে তার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে, কিছুক্ষণের মধ্যেই তার সরব আগমন।


ঘরে বসে বিলম্বের হেতু এবং আগের রাতে দেরিতে ঘুমুতে যাবার ব্যাখ্যা। চাচাতো এক ভাই-বন্ধুর পাল্লায় পড়ে বাসায় ফিরতে বেশ দেরি। ভাল ঘুম হয়নি, তখনও মাথা ভার। এরপরও আমাদের গল্প আড্ডায় কোন ব্যত্যয় হয়নি তার মজলিশি ব্যক্তিত্বের গুনে। ইতোমধ্যে এটম ভাই ফোন করে আরেক পুরনো বন্ধু শামসুল আরেফিনকে নিয়ে এলো ।

 

চারজনে দীর্ঘ দীর্ঘ দিন পর একসাথে হওয়া। অতীতের স্মৃতি রোমন্থন আড্ডা আরও জমিয়ে তোলে হাসির তোড়ে, হুল্লোড়ে। আড্ডার ফাঁকে চলছিল বই মেলায় প্রকাশিতব্য একটি বিজ্ঞান-কল্প-গল্পগ্রন্থের প্রুফ সংশোধনের কাজ। ওয়াহিদ রেজা বইটি সম্পাদনা করছে। একত্রিত হওয়ার মূল উদ্দেশ্য যদিও প্রকাশনা কিন্তু বেশ জমিয়ে আড্ডাও চলে । দুপুরে সেদিন একসঙ্গে খাওয়া হয়নি অনিবার্য কারণে। সেই ছিল আমাদের শেষ দেখা, বুঝতে পারিনি। এমনকি কেউ কখনো বুঝতে পারে!


ওয়াহিদ রেজা সম্পর্কে অনেকেই আমার চেয়ে বেশি জানবেন। যারা দীর্ঘ সময় তার সাহচর্য পেয়েছেন। ৭০ দশকের মাঝামাঝি সময়ে আমার সঙ্গে তার সম্পর্কের সূত্রপাত। তোলারাম কলেজে সহপাঠী-বন্ধু বাকী বিল্লাহর মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক পরিচয়। কিন্তু এরও আগে ওয়াহিদ রেজার সঙ্গে আমার অপরিচয়ের আনুষ্ঠানিকতা। চান মিয়া নামে তার বাবার একজন সহকারি ছিলেন।

 

আমার এক আত্মীয় দাঁতের চিকিৎসা করাতে গিয়ে চান মিয়ার সঙ্গে বিতন্ডায় জড়িযে যায়। আমিও তাতে অংশ নেই। চেম্বারে এক কোনায় বসে থাকে এক যুবক বইয়ের পাতায় নিবিষ্ট, আগেও দেখেছি । কিন্তু সেদিন সেই যুবক বইয়ের পাতা থেকে মুখ তুলে আমাদের সঙ্গে তর্কে জড়িযে পড়ে। কলেজে নব পরিচিত সেই যুবকই ওয়াহিদ রেজা। অসাধারণ আন্তরিকতায় বন্ধুত্বের সম্পর্ক নিবিড় হতে সময় লাগেনি। সেদিনের সেই তর্কাতর্কি আমাদের জীবনে কোনই প্রভাব ফেলেনি।


৭০ দশকের সেই সময়কালে আমরা নারায়ণগঞ্জের সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রধান ধারার অন্যতম চালিকা শক্তি ছিলাম। পল্লব সাহিত্য চক্রের নিয়মিত সাহিত্য সভা বসত নিমতলায় । রিক্সা শ্রমিক ইউনিয়নের অফিস ছিল বাবুরাইলের নুরুল হক ভাইয়ের হার্ডওয়ার দোকানের উপরে নিমতলা এলাকায়। কাঠের পাটাতনের দোতলার ঘরে। সেখানে আমরা নিয়মিত উপস্থিত হতাম দলবদ্ধ হয়ে ।

 

শামসুল আরেফিন, আলী এহসান, হালিম আজাদ, রঘু অভিজিত, বাকী বিল্লাহ, বজলুর রায়হান,ইউসুফ আলী এটম, আফসার বিন আব্বাস,আমিনুল ইসলাম কবিভূষণ, হানিফ উল কবীর, নজরুল ইসলাম মিন্টু, আবুল কালাম আজাদ, সুভাষ দেব, আমি এবং আরও অনেকে। ঢাকা থেকে প্রায় নিয়মিত উপস্থিত হত ইমদাদুল হক মিলন, রুদ্্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, কামাল চৌধুরি, শেখ তোফাজ্জল হোসেন, আবু সাইদ জুবেরি সহ অনেকে। সবার নাম মনে করতে না পারার অক্ষমতা আমার, বোধ করি ক্ষমার্হ। সেখানে ওয়াহিদ রেজা কবিতা বা গল্প পাঠ করত।

 

তার মধ্যে সবসময়ই এক ধরণের উত্তেজনা বিরাজ করত। আমার কাছে তা অফুরন্ত প্রাণচাঞ্চল্য বলে মনে হত, সংক্রমিত হতাম। কবিতার অক্ষরে অক্ষরে সেই চঞ্চলতা ছড়িয়ে থাকত। চেতনে অবচেতনে তার মত লেখারও চেষ্টা করেছি কখনও কখনও। পরে সে কবিতার চেয়ে গদ্যচর্চাই অধিক করেছে। ওয়াহিদ রেজার সংক্রমণক্ষম উচ্ছলতা আজীবন অটুট ছিল। প্রাণোচ্ছল সেই স্মৃতিময় চঞ্চলতা থেমে গেছে, ভাবতেই নিজের ভিতর কেমন স্থবিরতা অনুভব করি।
কয়েক সপ্তাহ আগে, শীতের শেষ ভাগে আমি আর এটম ভাই ওয়াহিদ রেজার চেম্বারে গিয়েছি। এটম আর ওয়াহিদ রেজা মিলে প্রুফ দেখবেন। তার আগে এটম ভাই একটি টিফিন বাক্স বের করলেন।

 

ভেতরে শীতের পিঠা আর গাছের কয়েকটি ফল। খেজুর রসের পিঠা ডাক্তারি বারণের কথা বলে খেল না। আমাদেরকেই খাওয়ালো। ফেস বুকের কিছু স্ট্যাটাস ও অন্যদের কমেন্ট নিয়ে অনেক হাসাহাসি করলাম। বিশেষ করে জেনারেল এরশাদ সম্পর্কে একটি স্ট্যাটাসে বিচিত্র সব মন্তব্য লেখা হচ্ছিল। পর পর কয়েকদিন তার চেম্বারে আমরা খুব প্রাণবন্ত সময় কাটিয়েছি এই ফেব্রুয়ারিতে। সেই সব স্মৃতি আমাদের সবাইকে খুব তাড়িয়ে ফিরবে। শুধু ওয়াহিদ রেজার কাছেই আজ সেই সব স্মৃতি সবচেয়ে বেশি মূল্যহীন আর অর্থহীন।


পল্লব-এর সাহিত্য আড্ডাটি একসময় নিস্তেজ হয়ে পড়ে। তখন আমরা বন্ধুরা সবাই মিলে অগ্রজপ্রতীম ফজলুল বারীর সহায়তায় নতুন একটি সাহিত্য সংগঠন গড়ে তুলি। ফজলুল বারী আগে সাহিত্য বিতানের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। সাহিত্য বিতানের গতি স্তিমিত হলে শাপলা নামে একটি সংগঠন আত্মপ্রকাশ করে, যেখানে আমাদের অগ্রজসমরাই ছিলেন।

 

প্রাথমিক পর্যায়ে ওয়াহিদ রেজা, বাকী বিল্লাহ এবং আমাকে ( আরো কেউ ছিল কিন্তু এ মুহুর্তে তাদের নাম মনে করতে ব্যর্থ) সংগঠনের নাম নির্ধারণ এবং গঠণতন্ত্র রচনার দায়িত্ব দেয়া হয়। বিষয়টি এই কারণে আমার স্মৃতিতে অত্যন্ত উজ্জ্বল যে সংগঠনের মূল নাম প্রাথমিক প্রস্তাব করে ওয়াহিদ রেজা। আর আমি ওয়াহিদ রেজার প্রস্তাবিত নাম ঈষৎ পরিবর্তন করার প্রস্তাব করলে সবাই এক কথায় মেনে নিয়েছিলাম। অন্যান্য নামের মধ্যে ওয়াহিদ রেজার প্রস্তাব ছিল ‘মণিক্ষর’ ।

 

আমি মণি বাদ দিয়ে শুধু ‘অক্ষর’ রাখার কথা বললে সবাই তা গ্রহণ করে। এইভাবে আমরা অক্ষর নিয়ে নতুনভাবে যাত্রা শুরু করি। সমসাময়িক কালে ‘পলাশ’ নামে আরেকটি নতুন সংগঠন আত্মপ্রকাশ করে। তখন নারায়ণগঞ্জে মূলধারার সাংস্কৃতিক কার্যক্রম চলছিল মূলত অক্ষর ও পলাশের সক্রিয়তার দ্বারা, শাপলা সীমিত পর্যায়ে হলেও সক্রিয় ছিল অবশ্যই।

 

বারীভাইয়ের আগ্রহে অক্ষরের উদ্যোগে ১৯৭৭-৭৮ সনে ‘অফিস আদালতে বাংলা প্রচলন ও পাঠাভ্যাস সমীক্ষা’ শীর্ষক একটি জরীপ কার্যক্রম পরিচালিত হয়। ওয়াহিদ রেজাসহ আমরা সবাই মাঠপর্যায়ে কঠোর পরিশ্রম করে তথ্য সংগ্রহ করি। স্বাধীন বাংলাদেশে এই শ্রেণীর সমীক্ষা কার্যক্রম জানামতে এটাই প্রথম। সেই প্রথম কাজে ওয়াহিদ রেজার ভূমিকা অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য।

 

তথ্য প্রক্রিয়া করে সমীক্ষা রিপোর্ট প্রনয়ণ করতে হবে। তখনতো আর কম্পিউটার বলে কিছু ছিল না। এমনকি উপযুক্ত জায়গাও আমরা পাচ্ছিলাম না, যেখানে এক সঙ্গে ১৫/২০ জন পাশাপাশি বসে তথ্যসমূহের পরিসংখ্যান প্রস্তুত করতে পারি। ওয়াহিদ রেজা এগিয়ে এলেন, আমরা জায়গা পেলাম। রাতের বেলা তাঁর পিতার চেম্বারের কয়েকটি টেবিল লম্বা করে মিলিয়ে চারপাশে বসার ব্যবস্থা করা হয়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ব বিভাগের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক হাফিজুল্লার তত্বাবধানে আমরা এই দুরূহ কাজ অত্যন্ত সফলভাবে সম্পন্ন করি।

 

কাজটি একঘেয়েমি পূর্ণ, তারপরও ওয়াহিদ রেজার স্বভাবজাত মজলিশি কথাবার্তার কারণে একঘেয়েমির মুহুর্তগুলো হয়ে উঠত প্রাণময়, নির্মল আনন্দে ভরপুর কৌতুকপূর্ণ। মাঝে মাঝে হালিম আজাদ, বাকী বিল্লাহ বা অন্যরাও ওয়াহিদ রেজার সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিরস, ভাবগম্ভীর একটি কাজের আবহে হাসিখুশির পরিবেশ সৃষ্টিতে সহায়তা করত।

 

তবে ওয়াহিদ রেজার তুলনা সে নিজেই, তার কথা বলার ভঙ্গি কিংবা কন্ঠস্বর সব মিলিয়ে পরিবেশনের একটি আকর্ষণীয় ঢঙ ছিল,যা নারীপুরুষ নির্বিশেষে সকলকে আকর্ষণ করত। তার চলায়, বলায় একধরণের উত্তেজনা বিরাজ করত। সাহিত্য পাঠ অথবা সাধারণ আলাপচারিতার সময়ও স্বভাবজ উত্তেজনা টগবগ করত। পরবর্তীকালে সম্ভবত ১৯৭৭ বা ৭৮ সালে ওয়াহিদ রেজা অক্ষরেরই কয়েকজন প্রধানত বাকী বিল্লাহ, হালিম আজাদ, ইউসুফ আলী এটম, বজলুর রায়হানকে নিয়ে ‘ড্যাফোডিল’ নামে আজকের ভাষায় লিটল ম্যাগ প্রকাশ করতে শুরু করে।

 

সাংগঠনিক দক্ষতা ছিল ওয়াহিদ রেজার। তার সাথে যুক্ত হয়েছিল হালিম আজাদ, বাকী বিল্লাহ, এটম ভাই, বজলুর রায়হানের মত নিবেদিত প্রাণ একনিষ্ঠ সংগঠক ও কর্মী। পরে আরও অনেকেই যুক্ত হয়েছিল ড্যাফোডিলের সঙ্গে। ওয়াহিদ রেজা জার্মানি চলে গেলে বা চলে যাবার আগে সম্পাদক হিসেবে হালিম আজাদ দায়িত্ব নেয়। হালিম আজাদ ওয়াহিদ রেজার পারিবারিক স্বজন। ওয়াহিদ রেজার অকাল প্রয়াণ তার প্রাণে অপূরণীয় ক্ষত তৈরি করেছে । দাফনের আনুষ্ঠানিকতার দিন হালিম আজাদের চেহারা দেখে আমি মনে মনে আৎকে উঠেছি।

 

আমার ন্যায় আরও অনেকেই আঘাত সয়ে নিতে নীরব হয়ে গেছে। সম্ভবত ওয়াহিদ রেজার উদ্যোগে হালিম আজাদ, বাকী বিল্লাহ, বজলুর রায়হান, এটম সবাই মিলে দুই বাংলার লেখকদের নিয়ে ‘শ্লোগান’ সংকলন প্রকাশ করে ১৯৭৮ সনে শ্রেষ্ঠ পুরস্কার অর্জন করে বাংলা একাডেমি থেকে। চারারগোপে রেললাইনের পাশে টিনবাঁশের কিছু দোকান ঘর ছিল।

 

তেমন একটি ঘরের চায়ের দোকানে বসে ওয়াহিদ রেজা আর বাকী বিল্লাহ শ্লোগানের সম্পাদনার কাজ করছিল। আমাকে ডেকে নিয়েছিল এবং আমার মুদ্রিতব্য লেখাটি নিয়েও আলোচনা হয়। তারা দুজনই একটি শব্দের পরিবর্তনের পক্ষে। ভায়োলিন সুবাস বা এই জাতীয় কিছু লিখেছিলাম, ওরা চায় ভায়োলিন সুর লিখতে। আমি অনিচ্ছাসত্বেও বন্ধুত্বের খাতিরে তা মেনে নিই। হয়তো নামিদামি লেখক হলে ওরা বলতে পারত আমার লেখাও ওরা সম্পাদনা করেছে। কিন্তু আমি আজ বহু দূরের মানুষ হয়ে গেছি।


আমরা প্রায়ই নিয়মিত সাহিত্য সভার বাইরে বোহেমিয়ান রকমের আড্ডায়ও মেতে উঠতাম। একসময় বন্ধু সুভাষ পড়াশুনার সুবিধার্থে মিশন পাড়ায় মেসবাসী হয়। একদিন সুভাষের মেস সংলগ্ন পাকা ঘাটে বসে আবৃত্তি, কবিতা পাঠে গভীর রাত পর্যন্ত আড্ডা দেই। তারপর চাষাড়ার নির্জন রাস্তায় গলা ছেড়ে গান গাইতে গাইতে হাঁটা। আড্ডা তবুও শেষ হতে চায় না।

 

শায়েস্তা খান সড়ক ধরে আবার বসে পড়ি রেল স্টেশনের ওভারহেড ব্রিজে। তারপর সবাই এগিয়ে দিতে আসে আমাদের নদীর ঘাট পর্যন্ত। আমরা তিনজন আলী এহসান(পিয়ার আলী), শামসুল আরেফিন এবং আমি থাকি বন্দরে। আমরা তিনজন পথচলার সময় কথাবর্তার সুবিধার জন্য আরেফিনকে মাঝখানে রেখে হাঁটতাম। দৈর্ঘ্যে সে আমাদের দুজনের তুলনায় লম্বা ছিল। হঠাৎ একটি কবিতা লিখলাম-আমরা তিনজন শহিদ মিনার.. প্রতিটি বিকেল ফুল হয়ে ঝরে আমাদের পদতলে-এই রকম কিছু লাইন ছিল কবিতায়।

 

সম্প্রতি জেনেছি ঐ কবিতার কারণে নাকি আমাদের বন্ধুদের মনে একধরণের বিচ্ছিন্নতা বোধ তৈরি হয়। ফলেই ড্যাফোডিল বা দারুচিনির সৃষ্টি। কবিতা রচনায় আমার বিশেষ কোন উদ্দেশ্য ছিল না, নিছক একটি ভাব অবলম্বন ছাড়া। কিন্তু আজ ভাবতে খুব কষ্ট হচ্ছে। আমি এখনও এবং তখনও বন্ধুদের কাউকে আলাদা করে দেখিনি। কারো মনে আঘাত দেওয়া বা কাউকে বিশেষভাবে মর্যাদা দেয়া তেমন কোন বিষয়ই ঐ কবিতা লেখার প্রেরণা হিসেবে কাজ করেনি।

 

এই সুবাদে সবার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিতে চাই। কারো সঙ্গে এ বিষয়ে কোন আলোচনা হয়নি বা কেউ কখনো আমাকে কোন প্রশ্ন বা কিছু বলেনি। ওয়াহিদ রেজা যদি এই কারণে কোন মনোকষ্ট পেয়ে থাকে, আজ তার কাছে এই বিষয়ে ক্ষমা চাওয়ার কোনও সুযোগ থাকল না। এ বেদনা একান্তই আমার। আজীবনের এই অপরাধবোধ ও ক্ষত নিবারণের কোনও উপায় বোধ করি নেই।

 

 ওয়াহিদ রেজা মানুষ ছিলেন। দোষে গুনে। প্রথাবিরোধী বলেন অনেকে। প্রথাবিরোধী মানেই প্রতিবাদী। ন্যায়ের পক্ষে উচ্চকন্ঠ ছিলেন। স্বভাবে একগুঁয়েও ছিলেন। আর এই কারণেই বোধ করি অনেকের সঙ্গে ওর মতভেদ, মতানৈক্য বা মতান্তর হয়েছে। ঘনিষ্ট কেউ হয়তো দূরে চলে গেছে, কেউ হয়তো অভিমান বুকে পুষে রেখেও সম্পর্ক টিকিয়ে রেখেছে। তাই একসময় দেখতে পাই ইউসুফ আলী এটম আরও কয়েকজনকে নিয়ে ‘দারুচিনি’ নামে আরেকটি লিটল ম্যাগ প্রকাশ শুরু করে।

 

ওয়াহিদ রেজা যা ভাবতেন তাই করতেন, বিপদ হবে জেনে পিছপা হতেন না। প্রচুর পড়াশুনো ছিল, তার অনুবাদ ও মৌলিক সাহিত্য কর্ম তার জ্ঞানের গভীরতার পরিচায়ক। ৩৫ টির মত গ্রন্থ রচনা ও প্রকাশিত হয়েছে। অপ্রকাশিত রচনা যা রয়েছে, তা সংগ্রহ ও প্রকাশের ব্যবস্থা করার উদ্যোগ নিতে হবে। আলোচনা ও স্মৃতিতর্পণ তখনই সার্থক হবে।

 

এপার বাংলা ওপার বাংলা মিলিয়ে লেখক এবং পাঠকের সঙ্গে তার নিবিড় যোগাযোগ ছিল লেখক জীবনের একেবারে প্রথম পর্যায় থেকেই। ইদানিংকার ফেসবুক স্ট্যাটাসও সেই সাক্ষ্য দেয়। ফেস বুকের সমস্ত স্ট্যাটাস সংকলনে তার মানসচিত্রটি পাওয়া যেতে পারে।

 

তাকে নিয়ে বলার কথা অনেক। তার পরিবার, স্বজন-বন্ধুরা অকাল মৃত্যুশোক কাটিয়ে ওঠার শক্তি অর্জন করুক, এই মুহুর্তে এই প্রত্যাশা। বিদায়, বন্ধু, বিদায়।
লেখক : কবি ও শিক্ষাবিদ, শধৎরসৎবুধ৯@মসধরষ.পড়স