মঙ্গলবার   ২২ অক্টোবর ২০২৪   কার্তিক ৭ ১৪৩১

গডফাদারের ব্যাড ভাতিজা!

সত্য পীর

প্রকাশিত: ২৭ আগস্ট ২০২৪  

 

 

কেউ বলতো ভাইজান। আবার কেউ বলতো বলতো ভাইয়া। তার বাবা ছিলেন নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের প্রয়াত সাংসদ নাসিম ওসমান। ওসমান পরিবারের মূর্তিমান আতংক ছিলেন তিনি। তাঁর কাজই ছিলো সন্ত্রাসী কর্মকান্ড। এলাকা ভিত্তিক সন্ত্রাসী বানানোর কারিগর  তাকে বল্লে অতুক্তি হবে না। আর এই স্বঘোষিত ডনের নামই হলো আজমেরী ওসমান। পুরো নারায়ণগঞ্জে এমন কোনো অপককর্ম নেই যা এই ধিকৃত ব্যাক্তি করেনি। খুন, টেন্ডারবাজী, গরুর হাটের শিডিউলবাজী, ঝুট সেক্টর থেকে চাঁদাবাজী থেকে শুরু করে এমন কোনো কর্ম নেই যা এই আজমেরী বাহিনী করেনি।

 

আজমেরীর পুরো নাারয়ণগঞ্জে যেসমস্ত থলিফা ছিলো তাদের মধ্যে ফতুল্লার ইসদাইরের নাসির, পঞ্চবটির পাগলা হামিদ ও সিদ্ধিরগঞ্জের চৌধূরী বাড়ি এলাকার আমির ছিলো তাঁর মূল হাতিয়ার। এমন অভিযোগ বছরের পর বছর থাকলেও প্রশাসন চোখে কালো চশমা পড়েছিলে। চাচা শামীম ওসমান ও সেলিম ওসমান ভাতিজার কু কর্মের কথা জানলেও কেউ টু শব্দটিও করেনি। আজমেরী ওসমানের তেমন কোনো ব্যববসা না থাকলেও শহরের এ প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত দামী ব্রান্ডের গাড়ি হাকিয়ে মহড়া দিতেন।

 

 কোটি কোটি চাঁদাবাজী করে মাঝে মধ্যে লোক দেখানো সমাজ সেবা করতেন এই দূর্ধর্ষ সন্ত্রাসী। আজমেরীর কলেজ রোডের ফ্লাটটিতে হাজার মানুষের আর্তনাদ দেয়ালে দেয়ালে আজো হাহাকার হয়ে ভেসে বেড়াচ্ছে। কতো সাধারণ ব্যবসায়ীকে জিম্মি করে কলেজ রোডে নিয়ে এসে যে টাকা আদায় করেছেন তার ইয়ত্তা নেই। এমন কথাই শেখ হাসিনার পতনের পর থেকে মানুষের মুখে মুখে চায়ের দোকান থেকে শহরময় চাউর হচ্ছে। এই দূর্ধর্ষ সন্ত্রাসী গ্রেফতার হলে বেড়িয়ে আসতো অনেক ভয়ানক তথ্য। তবে এখনো তিনি বাংলাদেশেই আছেন, দেশ ত্যাগ করতে পারেননি বলে কথা উঠছে।

 

পুরো নারায়ণগঞ্জকে ওসমান পরিবার নিজেদের পৈতৃক সম্পত্তি বলেই মনে করতো। ওসমান পরিবারকে অপ্রতিরোধ্য বলে মনে করলেও আসলেই শামীম ওসমান প্রকৃত অর্থে ছিলো একজন ভীতু। পর্দার বাইরে যতোই হুংকার দিতেন তিনি কিন্তু মূলত ভিতু ছিলেন তিনি।  অবস্থা বেগতিক দেখলেই হাসপাতালে চিকিৎসার ভান ধরা বা দেশের বাইরে অবস্থান নিতেন তিনি। এবারও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। ২০০১ সালে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর তিনি বোরকা পরে পালিয়ে গিয়েছিলেন।

 

 ২০০৮ সালে আওয়ামীলীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর তিনি আবার দেশে ফিরে আসেন। ২০০১ সালে আজমেরী ওসমান গা ঢাকা দিয়েছিলেন। এবারও হুংকার দিয়েছিলেন ঠিকই। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় আজমেরী তার বাহিনী নিয়ে শহরময় মহড়া দিয়েছিলেন। প্লানও করেছিলেন ছাত্র-জনতার উপর হামলা চালানোর । আজমেরী তাঁর বাহিনীকে ৪ আগষ্ট নির্দেশ দিয়েছিলেন ছাত্র- জনতার উপর হামলা চালিয়ে ছিলেন আজমেরী ও তার বাহিনীর লোকজন । তার নির্দেশে নারয়ণগঞ্জে ব্যাপক শোডাউনও করেছিলেন তার অনুগত ক্যাডার বাহিনী। 

 

তবে অবস্থা তেমন একটা সুবিধা করতে না পারায় আজমেরী বাহিনী নিজ ডেরায় ফিরে এসেছিলেন বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছেন। তবে ৫ আগষ্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন না হলে আজমেরী বাহিনীর পরিকল্পনা ছিলো ৬ আগষ্ট ছাত্র জনতার উপর হামলা করার। সরকার পতনের পর আজমেরী তার কলেজ রোডের বাসা থেকে  বের হয়েছেন ঠিকই কিন্তু বেশি দূর এগুতে পারেনি।

 

আজমেরী ওসমান জেলার এমন কোনো সেক্টর নেই যেখান থেকে অবৈধভাবে টাকা হাতিয়ে নেয়নি। এলাকাভিত্তিক সোর্সের মাধ্যমে খবর নিতেন বড় ব্যবসায়ী কে বা কারা। তাদের নামের তালিকা নিয়ে বাহিনীর মাধ্যমে সেই সব ব্যবসায়ীদের আজমেরী তার কলেজ রোডের বাসায় কৌশলে নিয়ে যেতেন। আর এরপরই শুরু হতো হুমকি ধামকি। এরপর বল পূর্বক টাকা আাদয়। একেকজন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে টাকা আাদায়ের পর পুরো বহর নিয়ে হজে¦ যেতেন এই দূর্ধর্ষ সন্ত্রাসী। হজ¦ থেকে ফিরে এসে আবার শুরু করতেন সন্ত্রাসী কর্মকান্ড। পুরো জেলায় যেভাবে ত্রাস সৃষ্টি করে গেছেন বিগত ১৫ বছর, এই গোয়েন্দা রিপোর্ট বা ডিজিএফ আইয়ের রিপোর্ট পর্যন্ত কারো দফতরে  কেউ দেননি। এর মূলে ছিলো অবৈধ টাকার খেলা।

 

আজমেরীর ঝুট সেক্টর মূলত নিয়ন্ত্রণ করতেন টোক্ইা নাসির। এই নাসিরের মাধ্যমে নারায়ণগঞ্জের সদর,ফতুল্লা, সাইনবোর্ড ও বন্দর এলাকার বিভিন্ন ঝুট সেক্টর নিয়ন্ত্রণ করতেন আজমেরী। নাসিরের ছিলো শতাধিক অনুসারী। এই অনুসারী নাসিরের কথায় বিভিন্ন এলাকায় লুট তরাজ থেকে শুরু করে বিভিন্ন সেক্টরে অরাজকতা সৃষ্টি করাই ছিলো তার কাজ। ফতুল্লার বিসিকের কাইল্যা রকমতকে পিটিয়ে আজমেরীর বাধ্য করা হয়। বিসিক ছিলো রকমতের নিয়ন্ত্রণে। তবে রকমতকে জোর পূর্বক আজমেরীর বায়াত করানো হয়।

 

 আর এর সুবাদে রকমত প্রতিমাসে আজমেরীকে ঝুট থেকে আসা লভ্যাংশ বাবদ ১৫ লাখ টাকা দিতেন বলেও সূত্রের দাবী। শুধু জুট সেক্টরই নয় কোণ,সুতা সেক্টরেও আজমেরী বাহিনীর দখলে ছিলো। দখলে ছিলো নিট এসোসিয়েশন থেকে শুরু করে ড্রেজার সেক্টরে এলাাকা ভিত্তিক সন্ত্রাসী ছিলো এই নাসিরের । টোকাই থেকে কোটিপতি হয়ে যাওয়া নাসির ছিলো সর্বে সর্বা। নাসিরের শেল্টারে ইসদাইর ও এর আশপাশের এলাকায় মাদক ব্যবসাও ছিলো। 

 

যার মোটা অংকেতর টাকা আজমেরী ওসমানের ফান্ডে জমা হতো নাসিরের মাধ্যমে। শহরের চানমারি বস্তিতে যে মাদক ব্যবসা হতো এরও নিয়ন্ত্রণ ছিলো নাসিরের। তবে প্রশাসন এই বস্তি উঠিয়ে দেয়ার পরও এলাকায় নাসিরের  মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করতো  একাধিক গ্রুপ।  চাষাঢ়া রেল স্টেশন এলাকায় মাদক ব্যবসাকে কেন্দ্র করে ফারুক নামের একজন রাজমিস্ত্রীর মৃত্যু হয়। এ হত্যাকান্ডের ঘটনায় ফতুল্লা মডেল থানায় ৩১ জনের নাম উল্লেখ করে একটি হত্যা মামলাও হয়েছিলো। রুবেল হত্যা মামলায় পৃুলিশের হাতে শিমুল, সম্রাট, সেলিম, আলী, রাকিব ওরফে টাইগার, বিজয়, মনির হোসেন ও শাহতাজ গ্রেফতার হয়েছিলো। যাদের নামে মামলা হয়েছিলো তারা সন্ত্রাসী নাসিরের আস্থাভাজন হিসেবে পরিচিতি ছিলো।

 

অপরদিকে সিদ্ধিরগঞ্জের আমির ছিলেন আজমেরী ওসমানের সেকন্ড ইন কমান্ড।  এই আমির সিদ্ধিরগঞ্জের এমন কোনো সেক্টর নেই যেই সেক্টরে আজমেরীর হয়ে সন্ত্রাসী কর্মকান্ড করেনি। আজমেরীকে সো অফ করে হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। অপরদিকে  গোদনাইলে রাষ্ট্রয়াত্ব জ¦ালানী তেল ডিপোতেও ছিলো আমির বাহিনীর আধিপত্য। যদিও ঐ  সেক্টর নিয়ন্ত্রণ করতো কাউন্সিলর মতি। কিন্তু আজমেরীকে প্রতি মাসে যে বখরা দিতে হতো তা আমীরের মাধ্যমেই দিতে হতো।

 

অপরদিকে, ফতুল্লার চাদনী হাউজিংয়ের পাগলা হামিদ প্রায় এক বছর আগে আজমেরীর বলয়ে গিয়ে ভিড়ে। পিজা শামীমকে হটিয়ে হামিদ তার অবস্থান আজমেরীর ঢেড়ায় পোক্ত করে তোলে। পাগলা হামিদের কারনে ফতুল্লার প্রতিটি সেক্টর বিগত এক বছরে উত্তাল হয়ে উঠে। এই পাগলা হামিদ এক সময় শাহ নিজামের ক্যাডার ছিলেন। এরপর ফতুল্লা থানা আওয়ামীলীগের সভাপতি সাইফ উল্লাহ বাদলের হয়ে নানা অপরাধ সংগঠিত করেছিলেন। বাদলের পর আজমেরীর হয়ে সে কাজ করা শুরু করে। 

 

ফতুল্লার বিভিন্ন ব্যবসায়ীদের আজমেরীর ডেরায় ধরে নিয়ে যেতে পাগলা হামিদ মুখ্য ভুমিকা পালন করেছে। অনেকটা অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছিলেন পাগলা হামিদ। আজমেরীর সাথে ১ বছরে এমনটাই মিশে গিয়েছিলেন পাগলা হামিদ এক পর্যায়ে নাসির ও আমীরকেও আজমেরীর কাছ থেকে দূরে সরানোর চেষ্টা করেছিলেন। সরকার পল্টি না খেলে হামিদের সেই আশাও পূর্ন হয়ে যেতো।  আজমেরী,পাগলা হামিদ,নাসিরসহ তাদের বাহিনীরা যাতে কখনো এই নারায়ণগঞ্জে পুনরায় সন্ত্রাসী কমৃকান্ড করতে না পারে এ ব্যাপারে জনগন সজাগ আছে বলেও নিশ্চিত করেছেন অনেকে।  

 

উল্লেখ্য, পাঁচ বছর আগে র‌্যাব এই হত্যায় তার সম্পৃক্ততার তথ্য নিশ্চিত করেছিল। ২০১৮ সালের ২ ডিসেম্বর হারুন অর রশীদ নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার হিসেবে যোগ দেয়ার পর আজমেরীকে প্রায় এক বছর দেখা যায়নি। তবে ২০১৯ সালের ৩ নভেম্বর হারুন বদলি হওয়ার পর আজমেরী আবার আগের রুপে ফিরে আসেন। দিনের বেলায় প্রকাশ্যে না এলেও আজমেরীর নামে হুমকিধামকি-চাঁদাবাজির অভিযোগ  রয়েছে বিস্তর। সম্প্রতি পুলিশের কাছে করা সাধারণ ডায়েরিতে বলা হয়েছে, আজমেরী নিজে উপস্থিত হয়ে তাকে হুমকি দিয়েছেন। 

 

২০১৩ সালের ৭ আগস্ট নারায়ণগঞ্জ শহরের আল্লামা ইকবাল রোডে আজমেরী ওসমানের কথিত সেই টর্চার সেলে অভিযান চালিয়ে ছিলো র‌্যাব। উদ্ধার করা হয়েছিলো রক্তমাখা প্যান্ট, ধারালো অস্ত্রসহ ‘নির্যাতনে ব্যবহার করা নানা উপকরণ’। অভিযানের সময় আজমেরী ওসমান তার ‘টর্চার সেলে’ ছিলেন না। সে সময় তাকে গ্রেফতার করে শাস্তির মুখোমুখি করার অঙ্গীকার করে র‌্যাব। ২০১৫ সালে র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল জিয়াউল আহসান গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, ত্বকী হত্যায় আজমেরী ওসমানসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে তথ্য প্রমাণ পাওয়া গেছে।

 

আজমেরীর বিরুদ্ধে আরো যে সমস্ত অভিযোগ,তৈরি পোশাক কারখানা মডেল ডি ক্যাপিটাল ইন্ডাস্ট্রিজের উপমহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন, মানবসম্পদ ও কমপ্লায়েন্স) অরূপ কুমার সাহা ফতুল্লা মডেল থানায় আজমেরী ওসমানের বিরুদ্ধে সাধারণ ডায়েরি করেছিলেন। শহরের আল্লামা ইকবাল রোডে কয়েক বছর একটি ফ্ল্যাট দখল করে রাখার অভিযোগও আছে আজমেরীর বিরুদ্ধে।

 

২০১৯ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর শহরের আমলাপাড়া এলাকার বাচ্চু নামে এক ব্যক্তিকে মারধর ও চাঁদাবাজির অভিযোগে আজমেরীর বিরুদ্ধে সদর মডেল থানায় মামলা হয়। তখন পুলিশ আজমেরীর বাসায় অভিযান চালিয়ে তার দুই সহযোগীকে গ্রেফতার করে। কিন্তু তাকে না পাওয়ার কথা জানায়। ২০১৩ সালের ৬ মার্চ বিকালে নিখোঁজ হন তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী। দুই দিন পর চাড়ারগোপে শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে তার মরদেহ পাওয়া যায়।

 

এছাড়াও,২০১৯ সালের ১০ ডিসেম্বর দুপুরে মোবাইল ফোনে সোনারগাঁও পৌরসভার এক ওয়ার্ড কাউন্সিলের কাছে ৭০ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করা হয় আজমেরীর নামে। ১৮ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় গ্রেফতার হন চাঁদা দাবি করা সেই ব্যক্তি। ২৯ মে চাঁদাবাজির মামলায় শহরের কলেজ রোডের একটি বাসা থেকে জেলা গোয়েন্দা পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন আজমেরী ওসমানের অনুসারী হাবিবুর রহমান হাবিব।

 

এই বিভাগের আরো খবর