মঙ্গলবার   ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪   অগ্রাহায়ণ ১৯ ১৪৩১

গার্মেন্টসে বেতন বাড়াতে রাজি মালিকদের শর্ত ট্যাক্স কমাতে হবে 

প্রকাশিত: ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৮  

ডেস্ক রিপোর্ট (যুগের চিন্তা ২৪) : তৈরি পোশাক শিল্পের মালিকরা শ্রমিকদের বেতন বাড়াতে রাজি। তবে এর জন্য ট্যাক্স কমানোর শর্ত দিয়েছেন তারা। বলেছেন, পোশাক শিল্প এখন সংকটময় সময় পার করছে। এর মধ্যে আবার শ্রমিকদের বেতন বাড়াতে হচ্ছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে সরকার প্রণোদনাসহ ট্যাক্স না কমালে এই শিল্পে তাদের টিকে থাকা কষ্টকর হবে।

রবিবার বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ নেতারা জরুরি সাধারণ সভায় এসব কথা বলেন। বিজিএমইএ কমপ্লেক্সের নুরুল কাদের অডিটোরিয়ামে অনুষ্ঠিত সভায় সভাপতিত্ব করেন সংগঠনটির সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান।

বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি ও এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন বলেন, ‘পোশাক শ্রমিকদের নিয়ে অনেকে অনেক বড়-বড় কথা বলেন। টক শোতে বিভিন্ন কথা বলেন। শ্রমিকদের বেতন বাড়ানোর জন্য অবাস্তব প্রস্তাব দেন। মনে হয় মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশি। যারা এই কাজ করছেন তারা পোশাকশিল্পকে ভালো অবস্থানে দেখতে চান না। তারা চক্রান্ত করছেন। তাদের সমস্ত চক্রান্ত নস্যাৎ করে দেয়া হবে।’

এফবিসিসিআই সভাপতি বলেন, ‘আমাদের পণ্য উৎপাদনে খরচ বেড়েছে। কমপ্লায়েন্স কারখানা তৈরি করতে অনেক অর্থ খরচ হয়েছে। রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর পোশাকশিল্পের সংস্কারে অনেক পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। অ্যাকর্ড-অ্যালায়েন্সের অধীনে সংস্কার কাজের জন্য অনেক টাকা খরচ হয়েছে।’

‘এই কাজ করতে গিয়ে ১২০০ পোশাক কারখানা বন্ধ হয়েছে গেছে। কিন্তু আমাদের পোশাকের দাম কিন্তু বাড়েনি। ক্রেতারা তো দাম বাড়াচ্ছে না। এ ব্যাপারে কিন্তু কেউ কোনো কথা বলছে না। আমরা পোশাক শ্রমিকদের বেতন বাড়াতে চাই। আমাদের ট্যাক্স কমাতে হবে না হলে প্রণোদনা দিতে হবে।’ এ সময় তিনি বলেন, ‘বেতন বাড়ান, ট্যাক্স কমান’।

উপস্থিত পোশাক মালিকদের উদ্দেশ্যে বিজিএমইএ সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘আমার ওপর আস্থা রাখুন। আশা করি মজুরি বোর্ড আমাদের বিষয়টা বোঝবে। সেখানে না হলে শ্রম মন্ত্রণালয় আছে, সরকার আছে।’

সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘পোশাকশিল্পের মাল খালাসসহ ট্যাক্স ও অন্যান্য আমলাতান্ত্রিক জটিলতা নিরসনে আমাদের ৮০ শতাংশ সময় চলে যায়। এরপর ২০ শতাংশ সময় আমরা ব্যবসায় মনোযোগ দিতে পারি। আমাদের এই জটিলতা কমানোর আহ্বান জানাই সরকারের প্রতি।’

বিজিএমইএ সভাপতি, ‘আমরা এইমুহূর্তে বেতন বাড়ানোর চাপ নিতে পারবো না। প্রতি বছর যে মূল্যস্ফীতি হবে সেভাবেই বেতন বাড়াতে চাই।’

সরকারের কাছে এই শিল্পের জন্য আরও সুযোগ বাড়ানোর আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘তৈরি পোশাকশিল্পে এখন ৪০ লাখ লোকের কর্মসংস্থান। আমরা আরও ভালো পরিবেশ পেলে এক কোটি লোকের কর্মসংস্থান করতে পারবো।’

নতুন বেতন কাঠামো সম্পর্কে সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘পাঁচ বছর পর নতুন মজুরি কাঠামো বাস্তবায়ন হতে যাচ্ছে। বর্তমানে আমাদের নানা ধরনের সমস্যার মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে। বেতন যারা দেবে, তারা কত দিতে পারবে সেটা তারাই জানে। কেউ কেউ ১৬ হাজার টাকা বেতন দেয়ার কথা বলেন, এই টাকা দিলে শিল্প থাকবে কি থাকবে না, তা বলতে পারবেন মালিকেরা। আমরা এসব দাবি বিবেচনায় নিচ্ছি না। মালিকের সক্ষমতা ও শ্রমিকের প্রয়োজনীয়তা অনুসারেই নতুন মজুরি নির্ধারিত হবে। এখানে শ্রমিক ও মালিকপক্ষের প্রস্তাবনা বিষয়ে মালিকরা তাদের মতামত তুলে ধরবেন।’

বিকেএমইএ সভাপতি সেলিম ওসমান বলেন, ‘নতুন মজুরি কাঠামো নিয়ে আমাদের ভেতর একটা আতঙ্ক কাজ করছে। মালিকপক্ষ যে প্রস্তাব দিয়েছে সে অনুযায়ী আমরা বেতন দিতে পারবো কি-না তা নিয়ে শঙ্কা আছে। যারা বাইরে থেকে অনেক কথা বলছেন, যারা চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছেন, তারা কি ভেবে দেখেছেন আমরা আসলে কতটা মুনাফা করছি? আগে কত মুনাফা করতাম আর এখন কত করি?’

সংসদ সদস্য ও বিজিএমইএ এর সাবেক সভাপতি টিপু মুন্সি বলেন, ‘জাতীয় নির্বাচনের আগে পোশাক শ্রমিকদের বেতন বৃদ্ধি আমাদের জন্য একটা চাপ। কারণ সরকার এসময় লক্ষ্য রাখে ভোটের বিষয়টা।’

তিনি অভিযোগ করেন, কিছু শ্রমিক নেতা বিদেশিদের খুশি করতে কাজ করছেন। তারা শ্রমিকদের মজুরি বাড়ানোর অবাস্তব প্রস্তাব দিচ্ছেন। কারণ তারা এই কথা না বললে তাদের বাইরে থেকে টাকা আসবে না।

টিপু মুন্সি বলেন, ‘বিদ্যুতের দাম বেড়েছে, গ্যাসের দাম বেড়েছে। আবার বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ইঙ্গিত এসেছে। আমাদের পণ্য তৈরিতে খরচ বেড়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় শ্রমিকদের বেতন বাড়াতে হলে এই শিল্পে সরকারকে ইনসেনটিভ (প্রণোদনা) দিতে হবে। তা না হলে প্রতিযোগী দেশের সঙ্গে ব্যবসায় টিকে থাকতে পারবে না।’   

বিজিএমইএ এর  প্রথম সহ-সভাপতি মঈনউদ্দিন আহমেদ (মিন্টু) বলেন, ‘তৈরি পোশাক রপ্তানি থেকে ২০০৯ সালে যেখানে ১২ বিলিয়ন ডলার এসেছে, সেখানে এবার হয়েছে ৩১ বিলিয়ন ডলার। এ থেকে বোঝা যায় এই সরকার ব্যবসা ও শ্রমবান্ধব সরকার। কিন্তু ডুইং বিজনেস (ব্যবসা সহজীকরণ সূচকে) এবছর বাংলাদেশ এক ধাপ পিছিয়ে ১৯০টি দেশের মধ্যে ১৭৭তম অবস্থানে রয়েছে। এগুলোও হিসাব করতে হবে। আমরা এসব মোকাবেলা করে ব্যবসা করছি। কিন্তু এগুলো কেউ তুলে ধরে না।’

বিজিএমইএ এর সাবেক সভাপতি আতিকুল ইসলাম বলেন, ‘ক্রেতারা আমাদের মূল্য দিচ্ছে কি দিচ্ছে না তা কিন্তু ভাবতে হবে। আমাদের রক্তক্ষরণ হচ্ছে। কিছুদিন আগেই বিজিএমইএ এর সভাপতির হার্টে অপারেশন করতে হয়েছে। খোঁজ নিয়ে দেখুন, বিভিন্ন চাপে পোশাক মালিকদের প্রত্যেকেরই একই অবস্থা। কারো হার্টে সমস্যা, নয়তো কারো ব্লাড প্রেশার।’

মুক্ত আলোচনায় ইন্ট্রুমেক্স গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এনায়েত উল্লাহ বলেন, ‘ছয় হাজার ৩৫০ টাকার প্রস্তাব যুক্তিযুক্ত হলেও আমরা এখন পাঁচ হাজার টাকা বেতন দিতেই হিমশিম খাচ্ছি।’

ড্রেস আপ লিমিটেডের চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তফা বলেন, ‘নির্বাচনের আগে ৪০ লাখ ভোটার বনাম দুই হাজার মালিক। আমরা মনে হয় বলির পাঠা হতে যাচ্ছি।’

স্টাইলিশ গার্মেন্টসের চেয়ারম্যান সালিউদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘শ্রমিকদের আমরা দিতে চাই। সাধ আছে কিন্তু সাধ্য নেই।’

সভায় আরও বক্তব্য দেন সিনিয়র সহ-সভাপতি ফারুক হাসান, সহ-সভাপতি এস.এম. মান্নান (কচি), সহ-সভাপতি (অর্থ) মোহাম্মদ নাছির, বিকেএমইএ এর সহসভাপতি ফজলে এহসান শামীম।

২০১৩ সালে পোশাক খাতে ন্যূনতম মজুরি যেখানে প্রায় শতভাগ বাড়ানো হয়েছিল, সেখানে এবার ২০ শতাংশ বাড়াতে রাজি হয়েছে মালিকপক্ষ। বর্তমানে ন্যূনতম মজুরি পাঁচ হাজার ৩০০ টাকা। সেটা এবার মালিকরা সেখানে দিতে চান ছয় হাজার ৩৬০ টাকা। নতুন মজুরি বোর্ড গঠনের পর শ্রমিক সংগঠনের পক্ষ থেকে ন্যূনতম মজুরি যেখানে ১২ হাজার টাকা নির্ধারণের দাবি উঠেছে, সেখানে মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর দিতে চাইছে ছয় হাজার ৩৬০ টাকা।

আর মজুরি বোর্ডে শ্রমিক প্রতিনিধি হিসেবে থাকা জাতীয় শ্রমিক লীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদক শামসুন্নাহার ভূঁইয়া ন্যূনতম মজুরি বাড়িয়ে ১২ হাজার ২০ টাকা করার প্রস্তাব দিয়েছেন। সম্প্রতি বিজিএমইএ সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান জানিয়েছেন নতুন মজুরি কাঠামো ডিসেম্বরেই বাস্তবায়ন হবে।
 

এই বিভাগের আরো খবর