রোববার   ২৪ নভেম্বর ২০২৪   অগ্রাহায়ণ ১০ ১৪৩১

ঝড়-বন্যায় ক্ষতি কত?

প্রকাশিত: ১ মে ২০১৮   আপডেট: ৩ মে ২০১৮

ইউএনডিপি-র হিসাবে ১৯৮০ থেকে ২০০৮ সালের মধ্যে বাংলাদেশ ২১৯টি প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার হয়৷ এতে ১৬ বিলিয়ন ইউএস ডলারের সমপরিমাণ ক্ষতি হয়৷ বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার ঠিক আগের বছর, ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বরের ‘গোর্কি' নামের ঘূর্ণিঝড়ে উপকূলীয় এলাকার প্রায় ৫ লক্ষ মানুষ প্রাণ হারান৷

ভেসে যায় লক্ষ লক্ষ গবাদি পশু৷ উপকূলীয় এলাকার ১৮টি জেলায় আঘাত হানা ওই ঘূর্ণিঝড়ে হাজার হাজার ঘর-বাড়ি ভেসে যায়৷ আশ্রয়হীন হয়ে পড়েন লাখ লাখ মানুষ৷ ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড় নিহতের সংখ্যা বিচারে স্মরণকালের আরেকটি ভয়াবহতম ঘূর্ণিঝড়৷ ২৯ এপ্রিল চট্টগ্রাম বিভাগের উপকূলীয় অঞ্চলে এই ঝড় আঘাত হানে৷ ঘণ্টায় প্রায় ২৫০ কিলোমিটার বেগে আঘাত করে ঘূর্ণিঝড়টি৷ প্রায় ১ লক্ষ ৩৮ হাজার মানুষ মারা যায় এতে৷ এছাড়া এক কোটি মানুষ নিঃস্ব হয়ে পড়ে, ক্ষতিগ্রস্ত হয় ১০ লাখ ঘর-বাড়ি৷ ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর ঘূর্ণিঝড় ‘সিডর'-এ সাড়ে তিন হাজার মানুষ মারা যায়৷ দেশের প্রায় ৬ লক্ষ টন ধান নষ্ট হয়৷ ঝড়ের প্রভাবে প্রায় ৯ লাখ ৬৮ হাজার ঘর-বাড়ি ধ্বংস এবং ২১ হাজার হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়৷ এই ঝড়ে প্রায় দুই লক্ষ ৪২ হাজার গৃহপালিত পশু এবং হাঁস-মুরগি মারা যায়৷ অডিও শুনুন 05:34 ‘বন্যার কারণে বাংলাদেশ চাল আমদানিকারক দেশে পরিণত হয়েছে’ ২০০৯ সালের ২৫ মে ঘূর্ণিঝড় ‘আইলা' বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাংশ ও ভারতের দক্ষিণ-পূর্বাংশে আঘাত হানে৷ আইলায় কমপক্ষে তিন লাখ পরিবার ঘর-বাড়ি হারান৷ আট লাখ টন খাদ্য ঘাটতি হয়৷ প্রায় দু'শ মানুষ মারা যায়৷

এই ঝড়ে দক্ষিণাঞ্চলে লবণ পানি প্রবেশ করায় পানীয় জলের তীব্র সংকট তৈরি হয়, যে সংকট এখনো কাটেনি৷ ২০১৩ সালের ১৪ মে ঘূর্ণিঝড় মোহসেন-এর কারণে উপকূলীয় এলাকায় কমপক্ষে ৫০ জন মারা যান৷ ফসল এবং বাড়ি-ঘরেরও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়৷ ২০১৬ সালের ২১ মে বাংলাদেশে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় ‘রোয়ানু'৷ এই ঝড়ে ২৪ জন মারা যান৷ ২০১৭ সালে বাংলাদেশে সর্বশেষ ঘূর্ণিঝড় হলো ‘মোরা'৷ ৩০মে ঘূর্ণিঝড় মোরার আঘাতে ছ'জন নিহত এবং ১৩৬ জন আহত হন৷ ৫২ হাজার ঘর-বাড়ি ধ্বংস হয়৷ ২ লাখ ৬০ হাজার মানুষ হয় গৃহহীন৷ এছাড়া মোট ৩৩ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়৷ এই ঘূর্ণিঝড়ে কক্সবাজার এলাকা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়৷ এই এলাকায় ১৭ হাজার বাড়ি-ঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়৷ গত বছর জাতিসংঘ জানায়, বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ে বাংলাদেশে প্রতিবছর ৩২০ কোটি ডলার বা ২৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়, যা মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ২ দশমিক ২ শতাংশ৷

বিশ্বব্যাংক এই ক্ষতি মোকাবেলায় বাংলাদেশকে ২৫ কোটি ডলারের একটি ঋণ প্রস্তাব দিয়েছে৷ প্রতিবেদনে বলা হয়, ২১০০ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে ক্ষয়ক্ষতির আর্থিক পরিমাণ তিনগুণ বেড়ে বছরে ১৮ হাজার ৫০০ কোটি ডলারে দাঁড়াবে৷ বিশ্বব্যাংক আরও বলেছে, ২০০০ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে বাংলাদেশে যত প্রাকৃতিক দুর্যোগ হয়েছে, তাতে সব মিলিয়ে এক হাজার কোটি ডলার বা প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে৷ অন্যদিকে ঘূর্ণিঝড় এবং বন্যা মোকাবেলায় অনেক সক্ষমতা অর্জন করেছে বাংলাদেশ৷ বিশ্বেও বাংলাদেশের এই সক্ষমতা প্রশংসিত৷ আবহাওয়া বার্তা ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটেছে৷ অডিও শুনুন 03:46 ‘আমাদের তাই অভিযোজন ক্ষমতা বাড়াতে হবে’ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ব্যুরো নিজস্ব জনবল ছাড়াও ৫০ হাজার স্বেচ্ছাসেবক এবং ১৩ লাখ স্কাউটকে দুর্যোগ মোকাবিলা বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিয়েছে৷ বাংলাদেশ সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড স্টাডিজ (বিসিএএস)-এর নির্বাহী পরিচালক জলবায়ু ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ ড. এম আতিক রহমান ডয়চে ভেলেক বলেন, ‘‘আগে সাইক্লোনে লাখ লাখ মানুষ মারা যেত৷ এ সংখ্যা কমেছে৷ এখন বছরে ১০ জনও মারা যায় না৷ অথচ ফসল বা অন্যান্য ক্ষতি কিন্তু কমানো যাচ্ছে না৷'' তিনি বলেন, ‘‘মৃত্যু কমার কারণ হলো মানুষ এখন সাইক্লোন সেন্টারে যায়৷ আগে গবাদি পশু রেখে কেউ যেতে চাইত না৷ বর্তমানে আইন করা হয়েছে যে, পরিস্থিতি খারাপ হলে যে কোনো কাউকে সাইক্লোন সেন্টারে যেতে বাধ্য করা যাবে৷ তাছাড়া এখন আলাদা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় থাকায় ব্যবস্থাপনাও সহজ হয়েছে৷'' ড. এম আতিক রহমান বলেন, ‘‘বন্যা ৮-১০ দিন থাকে৷ এতে পানি দাঁড়িয়ে থাকে৷ ফলে ফসলের ক্ষতি এড়ানো যায় না৷

বাংলাদেশ এই বন্যার কারণেই চাল রপ্তানিকারক দেশ থেকে এখন আমদানিকারক দেশে পরিণত হয়েছে৷ এক্ষেত্রে আমাদের সচেতনতা এবং ব্যবস্থাপনার বিষয়ে আরো কাজ করার আছে৷'' তাঁর কথায়, ‘‘আমরা চাইছি লোকজনকে আশ্রয়কেন্দ্রে না এনে আশ্রয় কেন্দ্র মানুষের কাছে নিয়ে যেতে৷ তার মানে হলো, প্রত্যেক এলাকার স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসাকে আশ্রয়কেন্দ্রে পরিণত করা৷'' ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অর্থনীতির অধ্যাপক রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘ঝড়-বন্যা আমাদের দেশের একটা বৈশিষ্ট্য৷ কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাংলাদেশে ক্রপ ক্যালেন্ডার বদলে গেছে৷ মৌসুম পরিবর্তন হচ্ছে৷ ঝড়-বন্যার ‘ফ্রিকোয়েন্সি' বাড়ছে৷ আগে ১০ বছর পর পর হতো, এখন প্রতিবছর হয়৷ আইলা এবং সিডর এক বছরের ব্যবধানে হয়েছে৷ ফলে কৃষক আগের চেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে৷'' তিনি বলেন, ‘‘আমাদের তাই অভিযোজন ক্ষমতা বাড়াতে হবে৷ লবণাক্ততা বাড়ছে, তাই লবণ সহনীয় ধান লাগবে আরো৷ পানিও বাড়ছে, তাই পানির সঙ্গে সমতা রাখতে পারে এমন ফসল লাগবে৷''

এই বিভাগের আরো খবর