শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪   অগ্রাহায়ণ ৯ ১৪৩১

নজরুল প্রতিভার আরেক দিক : গ্রামোফোন রেকর্ড

করীম রেজা

প্রকাশিত: ২৫ মে ২০২২  

মোটর গাড়ি কেনার শখ হয়েছিল এক সময় কাজী নজরুল ইসলামের। তখনকার শহর কলকাতায় মোটরগাড়ি হাঁকিয়ে চলতে পারা চাট্টিখানি কথা ছিল না। নজরুলের হাতে অতো কাঁচা পয়সাও ছিল না যে তিনি সহজেই তা কিনতে পারবেন। তবুও তিনি তা কিনেছিলেন। তার জন্য অভিনব  কৌশলে অর্থ সংস্থানও করেছিলেন। তাঁর বইয়ের প্রকাশকদের কাছ থেকে তিনি আগাম টাকা নিয়েছিলেন।

 

টাকা নিয়েছিলেন কোনও পান্ডুলিপি ছাড়া । যে বই তখনও লিখেননি। যে বইয়ের পান্ডুলিপির পরিকল্পনা বা খসড়া কোনটাই করেননি। অবশ্য প্রকাশকদেব ঠকাননি। তিনি পরে যাহোক একটা কিছু লিখে দেবেন- এই মনোভোব  নিয়েই টাকা নেন। পরে লিখেও দেন। এমন সম্ভব হয়েছিল নজরুলের অসম্ভব জনপ্রিয়তার কারনেই।

 

যা তাঁর সমসাময়িক কালে অন্য কোনও লেখকের বেলায়  সেই টাকায় তিনি গাড়ি কেনেন। গাড়ি কেনা কি খুব প্রয়োজনীয় ছিল? হ্যাঁ ছিল।  কারন ঐ গাড়ি করেই তিনি শহর ঘুরতেন বা গড়ের মাঠ হাওয়া খেতে যেতেন।

 

আর গাড়িতে সঙ্গে থাকত পাড়ার যত চেনা-অচেনা শিশুর দল। শুধু ওদের চকলেট, বাদাম আর হাওয়া খাওয়াবার জন্যই তিনি গাড়ি কিনেছিলেন। তা নাহলে কলকাতার রাস্তায় গাড়ি নিয়ে ঘুরে বেড়াবার মত শখ বা বিলাস নজরুলের  কোনোটাই ছিল না। মানানসইও ছিল না আর্থিক অবস্থা বিবেচনায়।

 

একদিন বাজারের থলে হাতে বাসা ছেড়ে বেরিয়ে এসে শিশুদের সঙ্গে রাস্তায় দেখা । অমনি বাজার করার কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে ওদের নিয়ে ঘুরতে চলে যান। পকেট শূন্য করে, শূন্য থলি নিয়ে যখন ফিরে আসেন বাড়িতে তখন আর বাজারের সময় ও অর্থ কিছুই বাকি ছিল না । গাড়ি বেশিদিন চালাতে সমর্থ হননি। বেচে দিয়েছিলেন।

 

তার কালে এতই জনপ্রিয় ছিলেন যে, তিনি যা লিখে দিতেন তারই ব্যাপক কাটতি হত। বই ছেপে এবং পত্রিকায় লেখা প্রকাশ করা ছাড়াও সে সময়কার সাহিত্য প্রচারের আরও  দুটো লোকপ্রিয় মাধ্যম ছিল। এক রেডিও বা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান, দুইঃ গ্রামোফোন রেকর্ড প্রকাশ।

 

হিজ মাষ্টাস ভয়েস ছিল তখন গ্রামোফোন রেকর্ড প্রকাশের ব্যবসায়ে অপ্রতিদ্বন্দ্বী। এ কো¤পানি কাজী নজরুল ইসলামের গান এবং নাটক-নাটিকা মিলিয়ে প্রচুর রেকর্ড বের করেছে। প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত নজরুল গ্রন্থের তালিকার মতই এখনও পর্যন্ত তার প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত বেকর্ডের তালিকাও অস¤পূর্ণ তিনি যেমন ছিলেন যুগ প্রবর্তক তেমনি যুগতিক্রমীও।

 

ছোট বড় মিলিয়ে তিনি অনেক নাটক রচনা করেন। রেকর্ডের স্বল্প সময়োপযোগী করে রচিত ব্যঙ্গ-কৌতুক-প্রধান নাট্যাকারে লিখিত রচনাসমুহ রেকর্ড নাটিকারূপে উক্ত হয়েছে। তার মধ্যে প্রধান কয়েকটি হল - ঈদুল ফেতর রেকর্ড নাটিকা এন ৯৮২৩-৯৮২৪, ও বিলাতী ঘোড়ার বাচ্চা রেকর্ড নাটিকা এন ২৭২৯৪, বাঙালি ঘরে হিন্দি গান রেকর্ড  নাটিকা এন২৭২৯৪, জন্মাষ্টমী রেকর্ড নাটিকা (হিন্দি) এন ১৭ ১৬৯ ,   প্ল্যানচেট রেকর্ড নাটিকা এন  ৯৭৬০ ইত্যাদি (দ্রঃ নজরুল রচনাবলী, আবদুল কাদির স¤পাদিত, বাংলা একাডেমি) ।

 

ব্যক্তিজীবনে সৎ এবং ধার্মিক হওয়ার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অত্যন্ত সংক্ষেপে নাটকের মাধ্যমে ফুটিয়ে  তুলেছেন। যেমন ঈদুল ফেতর ও জন্মাষ্টমী। বিলাতী ঘোড়ার বাচ্চা নাটিকায় বর্ণিত হয়েছে বিলাতে অনুষ্ঠেয় ঘোড়দৌড় কেন্দ্র করে বাংলার আনাচে পারিবারিক বিশৃঙ্খলা, সাংসারিক নারী-পরুুষের ব্যক্তিকেন্দ্রিক  চিন্তাভাবনার সনাতন সংঘাত।

 

দেবর ভাবীদের মিষ্টি-কৌতুকময় পারিবারিক ঘরোয়া বিনোদন স¤পর্কের আদলে তিনি চিত্রিত করেছেন অপ্রয়োজনীয় মেকি জ্ঞানচর্চা। হায় হায়, ঠাকুরপো - কলেজে পড়ে তোমাদের বিদ্যে শেষ পর্যন্ত ভুতেদের কাছে গিয়ে দাড়িয়েছে ?” প্ল্যানচেট।

 

বাঙালি ঘরে হিন্দি গান নাটিকায় তিনি উপযুক্ত শিক্ষা ও জ্ঞানের পরিনতি অঙ্কন করেছেন। “ সাঁইয়া নাহি বোলুঙ্গী ” হিন্দি সংলাপ অবলীলায় রূপান্তরিত হয়  “ সাইয়া নাহিব লুঙ্গি ”- তে অর্থাৎ সাইয়া গোসলের জন্য লুঙ্গি চায় । অযোগ্য ভাষান্তর ভিত্তি করেই যতো অহেতুক বিপত্তির সুত্রপাত এই রসময় গল্পে। খুব সাধারণ এবং প্রাত্যহিক জীবনাচরনের খুটিনাটি, তুচ্ছাতিতুচ্ছ বিষয় মনোহারী ভঙ্গিতে,

 

রসময় হাস্য-কৌতুকময়তার মধ্য দিয়ে পরিবেশন করেন। সেই সময়কার অন্যতম জনপ্রিয় মাধ্যম গ্রামোফোন রেকর্ড আর কলের গান। নজরুল বিনোদনের সেই সাধারণ উপাদানে যুক্ত করেছেন মেধা,বুদ্ধিদীপ্ত ব্যঞ্জনাসমৃদ্ধ রসময় কৌতুক।  অর্থদ্যূতিসমৃদ্ধ অন্তরময় সংলাপ নির্মানের দ্বারা যে আবহ তিনি সৃজন করেন তা এক কথায় অপূর্ব-অসাধারণ। তিনি বাংলা,

 

হিন্দি  উভয় ভাষায় সমান দক্ষতা ও সার্থকতার সাথে রেকর্ড নাটিকা লিখেছেন। সময়ের প্রয়োজনে সংক্ষিপ্ত পরিসরে  যুগের দাবী পুরণ করেছেন এ সকল রচনার দ্বারা । এই সব কৃতিত্বপুর্ণ রেকর্ড নাটিকা সাহিত্য পাঠক, সমালোচক এমনকি সাধারন পাঠকের কাছে চিরকাল সমাদৃত হবে,কীর্তিত হবে কাজী নজরুলের প্রতিভার অনালোচিত আরেক দিকের স্বাক্ষর রূপেই । করীম রেজা, কবি, শিক্ষাবিদ, ইমেইল-শধৎরসৎবুধ৯@মসধরষ.পড়স