শনিবার   ২১ ডিসেম্বর ২০২৪   পৌষ ৭ ১৪৩১

নজরুল-সাহিত্য : বিশ্ববোধ (২য় কিস্তি)

প্রকাশিত: ১ সেপ্টেম্বর ২০১৮  

ডেস্ক রিপোর্ট (যুগের চিন্তা ২৪) :

ড. মো. মনজুর রহমান

(পূর্ব প্রকাশের পর)

কবির উচ্চারণ-

তোমার দেওয়া এ বিপুলা পৃথ্বী সকলে করিব ভোগ

এই পৃথিবীর নারীর সাথে আছে সৃজন দিনের যোগ।


কে আছে এমন ডাকু যে হরিবে আমার গোলার ধান!

আমার ক্ষুধার অন্নে পেয়েছি আমার প্রাণের ঘ্রাণ-


যে আকাশ হতে ঝরে তব দান আলো ও বৃষ্টিধারা

সে আকাশ হতে বেলুন উড়ায়ে গোলাগুলি হানে কারা!

..........................................[ ফরিয়াদ ]

এ তো শুধু পরাধীন ভারতবর্ষের মানুষের আকুতি নয়। এ আকুতি বিশ্বমানবতার। ‘সাম্যবাদী’ কবিতায় কবি সর্ব ভেদচিহ্নহীন মনুষ্যত্ব ও সর্ব বাধাবিমুক্ত উদার বিশ্বমানবসমাজের ঐক্যবদ্ধ মহত্তম রূপেরই জয়গান গেয়েছেন। এ হিসেবে তিনি তৎকালীন ভারতে বিশ্বমনষ্কতার মহৎ রূপকার-

গাহি সাম্যের গান-

যেখানে আসিয়া এক হ’য়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান

যেখানে মিশেছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম-ক্রীশ্চান।


গাহি সাম্যের গান-

মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান

নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্ম জাতি,

সব দেশে সব কালে ঘরে ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি। [ সাম্যবাদী : সাম্যবাদী ]

কবি নজরুল তাঁর ‘মানুষ’ কবিতায় ধর্মমোহ, ধর্মীয় সংকীর্ণতা এবং মানব-বিদ্বেষপূর্ণ ধর্মচর্চার ঊর্ধ্বে চিরন্তন মানব মহিমার জয়গান গেয়েছেন-

হায়রে ভজনালয়,

তোমার মিনারে চড়িয়া ভ- গাহে স্বার্থের জয়। [ মানুষ : সাম্যবাদী ]

এ কবিতায় তিনি বিশ্ব মানবসমাজের উদ্দেশে বলেছেন-

আদম দাউদ ঈশা মুসা ইব্রাহিম মোহাম্মদ

কৃষ্ণ বুদ্ধ নানক কবি, বিশ্বের সম্পদ,

আমাদেরই এঁরা পিতা-পিতামোহ, এই আমাদের মাঝে

তাঁদেরি রক্ত কম-বেশী ক’রে প্রতি ধ্বমনীতে রাজে! [ মানুষ : সাম্যবাদী ]

নজরুলের মতে, রাজা-প্রজা, ধনী-নির্ধন, মহাজন-খাতক, শ্রমিক-মালিক, সাহেব-কুলি ইত্যাদির সৃষ্টি সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের জন্য। সামাজিক শোষণের দ্বারা নিপীড়িত ও অপমানিত মানুষের আত্মমর্যাদা নজরুলের মর্মব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আর সমগ্র বিশ্ববাসীর মধ্যে যারা অপমানে অবনত তাদের সম্পর্কে কবিচিত্ত ছিল সমবেদনায় উদ্বেলিত-

একজনে দিলে ব্যথা

সমান হইয়া বাজে সে বেদনা সকলের বুকে হেথা।

একের অসম্মান

নিখিল মানবজাতির লজ্জা-সকলের অপমান। [ কুলি-মজুর]

জগতের শোষিত, বঞ্চিত, নিপীড়িত ও নিগৃহীত মানুষ প্রাচীন শৃঙ্কল, শাস্ত্রসর্বস্বতা, আচারসর্বস্বতা ও কুসংস্কার থেকে মুক্তি লাভ করে শির উন্নত করে বিশ্বসংসারে আসন লাভ করুক, মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত হোক- এই ছিল কবির আগামিকালের শোষণমুক্ত বিশ্বের মহত্তম স্বপ্ন। বিষের বাঁশী’র ‘তূর্য-নিনাদ’, ‘উদ্বোধন’, ‘আত্মশক্তি’, ‘বন্দী-বন্দনা’, ‘শিকল-পরার গান’, ‘যুগান্তরের গান’ মূলত মুমূর্ষু মানুষের উদ্বুদ্ধ চেতনার উদাত্ত সঙ্গীত। এর সবগুলোই ‘সত্য-মন্ত্র’, সবগুলোই ‘অভয়-মন্ত্র’। কবি বিপন্ন লাঞ্ছিত দেশবাসীকে সমস্ত পৃথিবীর মানুষের সঙ্গে এক করে দেখেছেন। তিনি স্বাদেশিকতার ঊর্ধ্বে স্থাপন করেছন সত্য, ন্যায় ও মানবতাকে। ভারতবাসী তথা পৃথিবীর পরাধীন ও নির্যাতিত মানুষের বন্দিত্ব ও লাঞ্ছনার মধ্যে তিনি দেখেছেন মানবতা ও সত্যের অবমাননা। তিনি এই অবমাননা দূর করতে সবাইকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন-

বিশ্ব-গ্রাসীর ত্রাস নাশি আজ আসবে কে বীর এসো

ঝুঁট শাসনে করতে শাসন, শ্বাস যদি হয় শেষও। [সেবক : বিষের বাঁশী]

ঈশ্বরতন্ত্র, রাজতন্ত্র ও পুরোহিততন্ত্রের শিকল তাঁকে বেঁধে রাখতে পারে না। রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করে নজরুল এক বছর সশ্রম কারাদ-ও ভোগ করেছেন। রাজার প্রতিনিধি জমিদার, জোতদার, পুরোহিতদের বিরুদ্ধে তাঁর কলম পূর্বাপর শাণিত ছিল-

মাটিতে যাদের ঠেকে না চরণ

মাটির মালিক তাহারাই হন-

যে যত ভণ্ড ধড়িবাজ আজ সে তত বলবান্ [ ফরিয়াদ ]

পুঁজির মূলে যে শ্রমিকের রক্ত বিরাজিত মার্কসের মতো নজরুলও বিশ্বাস করতেন-

তোমার অট্টালিকা

কার খুনে রাঙা? ঠুলি খুলে দেখ,

প্রতি ইঁটে আছে লিখা। [ কুলি-মজুর : সাম্যবাদী ]

স্বাধীনতা অর্থে নজরুল বুঝতেন মানুষের মর্যাদা, সমাজ ও ব্যক্তির সর্বাঙ্গীণ বিকাশ, সংস্কার ও সংকীর্ণতা থেকে মানুষের অন্তর-বাহিরের পূর্ণমুক্তি। তাঁর মুক্তি কামনার অন্তঃস্থলে রয়েছে মানবতা ও নৈতিকতার প্রেরণা। তাই এর আবেদন বিশেষ দেশে, বিশেষ কালে সীমাবদ্ধ নয়। নজরুল ইসলামের স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা জাতির জন্য নয়, মানুষের জন্য। তিনি স্বাধীনতার ধারণাকে প্রসারিত করেছেন, স্বাদেশিকতার স্থানে এনেছেন উদার মানবিকতা ও সাম্যের চেতনা। সে চেতনা সর্বযুগে, সর্বদেশে সমানভাবে প্রযোজ্য। কবির উক্তি-

গাহি সাম্যের গান-

বুকে বুকে হেথা তাজা সুখ ফোটে, মুখে মুখে তাজা প্রাণ!


নাই কো এখানে কালা ও ধলার আলাদা গোরস্থান।

নাই কো এখানে কালা ও ধলার আলাদা গীর্জা-ঘর,

নাই কো এখানে ধর্ম্মের ভেদ, শাস্ত্রের কোলাহল,

পাদরী-পুরুত-মোল্লা-ভিক্ষু এক গ্লাসে খায় জল। [সাম্য : সাম্যবাদী]

‘কাণ্ডারী হুঁশিয়ার!’ কোনো বিশেষ যুগ-সংকটের ত্রাণগীতি নয়, দেশকালে ঊর্ধ্বে তার স্থান। সর্বপ্রকার পরাধীনতা-অত্যাচার-অনাহারের বন্দিশালা ভাঙার সোচ্চার বিদ্রোহের আদর্শে ভাঙার গান, ফণি-মনসা মুখর। নজরুলের লক্ষ্য ছিল নিপীড়িত তথা সংগ্রামশীল মানুষের জয়গান।

এ কবিতায় কবি ধর্মব্যবসায়ীদের মুখোশ খুলে দিয়ে ঈশ্বরকে মানুষের সঙ্গে একাত্ত করেছেন। মূর্তির ঈশ্বর বা মেঘলোকবাসী ঈশ্বরকে নির্বিবাদে মেনে নেয়ার মানুষ তিনি ছিলেন না। নজরুল মনে করেন ধর্মীয় গ্রন্থেরও পাশাপাশি অবস্থানে কোনো বাধা নেই। এ নিয়ে বিবাদেরও সম্ভাবনা নেই। তাঁর মতে ধর্ম মানুষের সৃষ্টি, আর আল্লাহ মানুষ সৃষ্টি করেছেন। ধর্মের কল্যাণের জন্য মানুষ পৃথিবীতে এসেছে, মানুষের কল্যাণের জন্যই ধর্ম প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। তাই ধর্ম শ্রেষ্ঠ নয়-মানুষই শ্রেষ্ঠ। তাইতো পৃথিবীর প্রধান কবিদের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে তিনিও বলেছেন-

বন্ধু বলি ঝুট,

এইখানে এসে লুটাইয়া পড়ে সকল রাজমুকুট।

এই হৃদয়ই যে নীলাচল, কাশী, মথুরা, বৃন্দাবন,

বুদ্ধ-গয়া এ, জেরুজালেম এ, মদিনা, কাবা-ভবন, [সাম্যবাদী : সাম্যবাদী]

কবিতার মতো নজরুলের সঙ্গীতেও রয়েছে সর্বত্রগামিতা। প্রেম-ভালোবাসা, ঘৃণা-বিদ্বেষ, ঈর্ষা-অসূয়া যেমন স্বাভাবিক শাশ্বত তেমনি অবিচার, অন্যায় শোষণও। অত্যাচার ও অবিচারের একটি সর্বজনীন সর্বকালীন চরিত্র আছে। স্বেচ্ছাচারী শাসক, স্বার্থপর সমাজপতি, ভণ্ড ধর্মগুরুর চরিত্ররূপ সর্বকালে সর্বদেশে একই রূপ। বিশ্বমানবের নিহিত শক্তির অফুরন্ত উন্মাদনা নজরুল তাঁর কাব্যে প্রকাশ করে গেছেন। তাঁর কবি-মানস আন্তর্জাতিকতায় ভাস্বর ছিল বলেই তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়েছে হিন্দু পুরাণের পাশাপাশি ইসলামি ও গ্রিকপুরাণকে স্থান দেওয়া হয়েছে। নজরুলের কবিমানস আন্তর্জাতিকতায় ভাস্বর ছিল বলেই তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়েছে হিন্দুপুরাণের পাশাপাশি ইসলামী ও গ্রিকপুরাণ; তৎসম-তদ্ভব শব্দের পাশে হিন্দি, আরবি-ফারসি, ইংরেজি ও অপরাপর নানা বিদেশি শব্দ, ছন্দ ও ভাব বাংলা ভাষায় অনাবিল স্বতঃস্ফূর্ততায় আত্মীকরণ করা। এক্ষেত্রে তিনি বিশ্বমনা সংস্কৃতের পরিচয় দিয়েছেন। এর ফলে একদিকে যেমন ভারতীয় সাহিত্য সমৃদ্ধ হয়েছে যুক্তিনিষ্ঠ উদারতায় অন্যদিকে বিশ্বভ্রাতৃত্ব ও মানবতার আলো ছড়িয়ে পড়েছে সারাবিশ্বে।

শুধুমাত্র রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনাতেই নয়, কাব্যাদর্শেও তিনি আন্তর্জাতিকতাবাদী। তিনি সাম্যবাদ থথা সর্বহারার মহান সংগ্রামের অনুষঙ্গ দস্তয়ভস্কি, গোর্কি, মার্কস-এঙ্গেলস-লেনিনের তত্ত্ব থেকে গ্রহণ করেছেন। ‘সর্বহারা’ কাব্যগ্রন্থ ও বিশেষত সাম্যবাদী কবিতাটি মার্কসবাদের ভিত্তির উপরই রচিত। পঙ্ক্তিগুলো বিশ্লেষণ করলেই আমরা সাম্যবাদের মূল কথাগুলো পেয়ে যাই। ইউরোপের আকাশে-বাতাসে যখন রাজনৈতিক শাসনের গণ্ডিকে ও নিষ্ঠুরতাকে দলিত করে স্বাধীন হবার স্পৃহা জাগ্রত হচ্ছে, ঠিক তখন শেলি-বায়রনের আবির্ভাব। নজরুলের আবির্ভাবও ঠিক তেমনই এক সন্ধিক্ষণে। ‘ঘবপবংংরঃু ড়ভ অঃযবরংস’ লেখার পর শেলিকে ক্ষমা চাইতে বলা হয়। বিপ্লাবী শেলি সে প্রস্তাব ঘৃণার সঙ্গে প্রত্যাখান করেন। নজরুলও পুরোহিত-শক্তির বিরুদ্ধে জোরাল পঙ্ক্তি উচ্চারণ করেছেন। শেলির কবিতায় ধ্বনিত যৌবনের জয়গান যেন নজরুল ইসলামের ‘ যৌবন-জল-তরঙ্গে’-এ ধ্বনিত হয়। বায়রনের মতো নজরুল অসার সমাজজীবনের প্রতি তীক্ষ্ণধার বক্তব্য রেখেছেন তাঁর ‘জাতের বজ্জাতি’ কবিতায়। বায়রন আর শেলি যেমন অবহেলিত অবজ্ঞাত মানুষের জন্য বেদনা অনুভব করেছেন, নজরুলের সর্বহারা, ফণিমনসা, প্রলয়শিখা ইত্যাদি কাব্যেও নিরন্ন, পীড়িত, লাঞ্চিত, অপমানিত মানুষের জীবনালেখ্য বিধৃত হয়ে সহানুভূতি প্রকাশিত হয়েছে। শেলির ..... প্রেম-সৌন্দর্যের বিষয় ও ভাব নজরুলের অনামিকা, চিরজনমের প্রিয়, সে যে আমি, আর কত দিন ইত্যাদি কবিতায় প্রকাশ। নজরুলের চিঠিপত্রে হুইটম্যানের ভাবনাচিন্তার সাজুয্য দেখা যায়। নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতাকে হুইটম্যানের ‘ঝড়হম ড়ভ গুংবষভ’ -এর সঙ্গে মিলিয়ে পড়া যেতে পারে। হুইটম্যানের মতো তিনিও সৌন্দর্যের পূজারি। হুইটম্যানের অনেক কবিতার শীর্ষ নামে দঝঙঘএ’ শব্দের ব্যবহার লক্ষ করা যায়। নজরুলের অনেক কবিতা, যেমন- ছাত্রদলের গান, কৃষাণের গান, শ্রমিকের গান, ধীবরের গান, আমি গাই তার গান ইত্যাদি নামাঙ্কিত। নজরুলের ‘জিঞ্জির’ কাব্যের ‘অগ্রপথিক’ কবিতাটি যেন হুইটম্যানের ‘চরড়হববৎং, ড় চরড়হববৎং’কবিতাটিকে স্মরণ করা।

উপন্যাসে নজরুলের বিশ্ববোধ নানা মাত্রিকতায় প্রকাশিত হয়েছে। মৃত্যুক্ষুধা উপন্যাসে আমরা নজরুলের বিশ্ববোধের পরিচয় পাই। আমাদের নিত্যদিনের পরম শত্রু, মৃত্যুকে আমরা ভয় পাই। সে আমাদের অনাকাক্সিক্ষত,এ সত্যটুকু আমাদের জীবনসত্যে আস্বীকৃত। কিন্তু তাকে তো কখনো এড়ানো যায় না। তেমনি বাঁচতে গেলে ক্ষুধা দানবের মতো প্রতি মুহূর্তে আমাদের গ্রাস করতে চায়। তাই মৃত্যু ও ক্ষুধার মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে মানুষ সর্বকালে ও সর্বাবস্থায় দিশেহারা, অসহায়। নজরুল উপন্যাসের ঘটনাপ্রবাহের একদিকে মৃত্যুকে দেখিয়েছেন তার শাশ্বত প্রবহমানতায়,আবার ক্ষুধাকে দেখিয়েছেন অনিবার্য চাহিদায়। পৃথিবীর সব মানুষের চিরকালীন প্রবৃত্তি নিয়ে এই যে ভাবনার খেলা, এটাই তাঁর বিশ্ববোধ।