সোমবার   ২৫ নভেম্বর ২০২৪   অগ্রাহায়ণ ১০ ১৪৩১

নিম্ন-মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে গরুর মাংস

আবু সুফিয়ান

প্রকাশিত: ১৩ ডিসেম্বর ২০২২  

 

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধগতির আগুনে পুড়ছেন পুরো নারায়ণগঞ্জের মানুষ। এদিকে পাগলা ঘোড়ার মতোই লাগামহীন নারায়ণগঞ্জের নিত্যপণ্যের বাজার। ঊর্ধ্বগতির সঙ্গে তাল মেলাতে পারছে না এ শহরের নিম্নবিত্তরা। যার ফলে তারা পড়েছেন বেকায়দায়।

 

 

এ শহরের বেশির ভাগ মানুষই বলছেন, আমাদের আয় বাড়ছে না। কিন্তু ব্যয়ের খাত বেড়েই চলছে। এমন পরিস্থিতিতে হিমশিম খাচ্ছেন তারা। অনেকেরই চলমান মাসিক বেতনে সংসার চালানো দায় হয়ে পড়েছে। এ নিয়ে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তদের ঘরে ঘরে এখন চলছে বোবা কান্না।

 

 

আয় না বাড়ায়, দ্রব্যমূল্যের চড়া দামের কারণে মানুষের মনে হাহাকার বিরাজ করছে। অনেকেই বলছেন, আয় না বাড়লে জীবন বাঁচানো সম্ভব না। বিশেষ করে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে নাজেহাল অবস্থা বিসিক শিল্পাঞ্চলের গার্মেন্টস কর্মীদের।

 

 

তাদের সঙ্গে কথা হলে তারা বলেন, প্রতিমাসের শেষে চাকরির বেতন যা পাই তা দিয়ে এখন আর সংসার চলে না। বিশেষ করে গত কয়েক মাস ধরে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছি আমরা। সবকিছুর দাম বাড়ছে।

 

 

এদিকে গরুর মাংসের কেজি ৭০০ টাকা। কোথাও কোথাও আবার ৫০ টাকা বেশিও রাখা হয়। বিসিকের বেশির ভাগ পোষাক কর্মীই জানিয়েছেন শেষ কবে গরুর মাংস কিনে খেয়েছেন তাদের জানা নেই।

 

 

বিসিকের স্থানীয় বাড়িওয়ালা মোঃ রাশেদ মিয়া বলেন, চাল, ডাল, তেল থেকে শুরু করে সবকিছুর দাম বেড়ে গেছে। মাছ মাংসের দিকে তো হাত দিতেই পারছি না। এভাবে তো আর সংসার চলছে না। তাই তো লোক লজ্জা ভুলে আজকে সকালে টিসিবির লাইনে গিয়েছিলাম। আজকে লাইনে দাঁড়িয়ে সয়াবিন তেল, চিনি ও মসুর ডাল নিয়েছি। কী আর করার, আগে তো খেয়ে বাঁচতে হবে।

 

 

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধগতি নিয়ে কথা হয় বিসিকের পোষাক কর্মী রোজিনা আক্তারের সাথে। জানান, বাজারের ঊর্ধ্বগতির কারণে দিশাহারা হয়ে পড়েছেন তিনি। তিনি বলেন, দিন দিন বাঁচবার পথ কঠিন হয়ে যাচ্ছে। আমাদের গার্মেন্টস এর বেতন না বাড়লেও যে হারে সব খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ছে তাতে আমাদের মতো মানুষ কীভাবে খেয়ে পরে বাঁচবে। তিনি আরোও বলেন, চাল, ডাল কিনতে যে অবস্থা মাংস খাবার তো চিন্তাই করতে পারি না।

 

 

অবন্তি কালার টেক্স লিমিটেডের পোষাক কর্মী মোঃ দেলোয়ার হোসেন বলেন, সরকারের মন্ত্রীরা মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কয়েকগুণ বেড়ে যাওয়ার দাবি করে এলেও নিজের বাজার কাটছাঁট করেই চলতে হচ্ছে আমাদের। মাছ, মাংস ডিম খাওয়া এখন প্রায় স্বপ্নের মতো হয়ে গেছে আমাদের জন্য। মাস টানতে হচ্ছে ডাল, ভর্তা ও সবজি খেয়ে।

 

 

আয় ও ব্যয়ের ভারসাম্য ধরে রাখতে হিমশিম খাওয়া সংসারে তাই পেট ভরে এমন খাবারই চলছে মাসের পর মাস ধরে। খাবারের তালিকা থেকে দিন দিন ছাঁটাই হচ্ছে পুষ্টিকর খাবার। গরুর মাংস শেষ কবে খেয়েছি মনে পরে না। আর আমাদের গার্মেন্টেস এর বেতনের যে অবস্থা তাতে গরুর মাংস কিনে খাওয়া দায়।

 

 

তিনি বলেন, ৮০০০ টাকা বেতন পাই। এই টাকা দিয়ে ঘর ভাড়া দিবো, চাল কিনবো না বাজার করবো। তাহলে ৭০০ টাকা দিয়ে গুরুর মাংস কিভাবে কিনবো। কয়েক দিন ধরে ছোট মেয়ে আবদার করেছে গরুর মাংস খাবে। এখন আমি চিন্তা করছি কিভাবে ৭০০ টাকা দিয়ে মাংস কিনবো আর কিভাবেই বা মেয়েকে শান্তনা দেবো। মেয়ের আবদার পূরণ করতে না পারায় তার খারাপ লাগার কথা তিনি জানান।

 

 

একই কারখানার শ্রমিক আল আমিন বলেন, ৭০০ টাকা দিয়ে আমাদের আর গরুর মাংস খাওয়া সম্ভব নয়। তাইতো গরুর মাংস খাবার চিন্তাই বাদ দিয়ে দিয়েছি। কারন যেটা কিনে খেতে পারবো না, সেটা খাবার কথা চিন্তা করে লাভ কি।

 

 

বিসিকের কয়েজন মাংস বিক্রেতার সাথে কথা বলে জানা যায়, আগে তারা একজনই একটা গরু জবাই করতেন। আর এখন একটা গরু জবাই করেন কয়েকজন মিলে। কারন হিসেবে তারা বলেন, দ্রব্য মূল্যের ঊর্ধগতির প্রভাবে অর্থ সংকটে মানুষ গরুর মাংস কম কিনছেন। তারা আরোও বলেন, গরুর মাংস এখন নিম্নবিত্তের নাগালের বাইরে।

 

 

সম্প্রতি এক গবেষণায় বলা হয়, ‘দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে গৃহস্থালিগুলো তাদের দৈনন্দিন খাদ্য জোগানে আমিষ, ভিটামিন, খনিজসহ মানবদেহের জন্য অতিপ্রয়োজনীয় ছয়টি উপাদান গ্রহণের পরিমাণ কমিয়ে দিচ্ছে। দামের কারণে ন্যূনতম পরিমাণ সবজি, ফল, দুগ্ধজাত খাবার ও আমিষজাতীয় খাবার অনেক পরিবারই জোগাড় করতে পারছে না।

 

 

বাংলাদেশের মানুষের প্রধান খাদ্য হলো ভাত ও রুটি। বৈশ্বিক পরিস্থিতির কারণে বেড়েছে এ দুই খাদ্যের মূল উপাদান চাল ও গমের দাম। বিশ্ববাজারে ভুট্টা ও গমের মূল্যবৃদ্ধির কারণে অন্যান্য খাদ্যশস্যের দামও বাড়ছে। মানুষ পরিবারে খাবারের পেছনে যে ব্যয় হয় সেটি কাটছাঁট করছে বা কমিয়ে আনছে। ফলে পুষ্টিকর খাবারের কাঠামোয় পরিবর্তন আসছে।

 

 

দেশের অনেক পরিবার পুষ্টিকর খাদ্যের জন্য প্রয়োজনীয় মাত্রা অনুযায়ী শাকসবজি, ফলমূল, দুগ্ধজাত খাবার, মাংস ও মাছ গ্রহণের মাত্রা আগের চেয়ে অনেক কমিয়ে দিয়েছে’। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির পরিকল্পিত কারসাজিতে অসহনীয় ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে নিম্নবিত্তদের।

 

 

দ্রব্যমূল্যের অসহনীয় ঊর্ধ্বগতিতে দিশেহারা সারা দেশের মতো নারায়ণগঞ্জের নিম্ন ও মধ্য আয়ের লক্ষ লক্ষ জনগণ। মধ্যবিত্তরা বেঁচে থাকার তাগিদে আজ আত্মপরিচয় ভুলে টিসিবির ট্রাক থেকে স্বল্প মূল্যে পণ্য সংগ্রহে নিম্নবিত্তের সাথে একই কাতারে দাঁড়িয়ে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হতে বাধ্য হচ্ছেন।

 

 

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধ করে জনগণকে আত্মমর্যাদাসহ বেঁচে থাকার ব্যবস্থা করতে ব্যর্থ হলে সরকার ভবিষ্যতে গণরোষে পতিত হতে পারে বলে দাবি করেছেন নারায়ণগঞ্জের সচেতন মহল।

 

এস.এ/জেসি

এই বিভাগের আরো খবর