রোববার   ২৪ নভেম্বর ২০২৪   অগ্রাহায়ণ ১০ ১৪৩১

পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন

প্রকাশিত: ১ মে ২০১৮   আপডেট: ৩ মে ২০১৮

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও পরিবেশদূষণ, খাদ্যাভাব, কর্মসংস্থানের সংকট প্রভৃতি নানা সংকটের আবর্তে পৃথিবী নিপতিত। সাম্প্রতিক কালে উষ্ণায়ন এবং তৎসৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে বিশ্বব্যাপী উদ্বেগ এক নতুন মাত্রা পেয়েছে।

তবে বর্তমান উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে এত উদ্বেগ ও আলোচনার কারণ কোনো প্রাকৃতিক উপাদান নয়, বরং মানুষের প্রকৃতিবিরুদ্ধ নানাবিধ অপকর্মের ফলস্বরূপ বায়ুমণ্ডলের ক্ষতিকারক গ্যাস, বিশেষ করে কার্বন ডাই-অক্সাইডের মাত্রার সংকটজনক বৃদ্ধি গোলকীয় উষ্ণায়নের প্রধান কারণ। তাই বলা হয়, জলে-স্থলে বায়বিক অবস্থা বা আবহাওয়ার যে পরিবর্তন আসে, এগুলো মানুষের হাতের কামাই। তাই পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘মানুষের কৃতকর্মের দরুন জলে-স্থলে বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়ে, যার ফলে তাদের তাদের কোনো কোনো কর্মের শাস্তি তিনি আস্বাদন করান, যাতে তারা ফিরে আসে।’

'(সূরা আর-রুম, আয়াত: ৪১) পবিত্র কোরআনের অসংখ্য আয়াতে জলবায়ু পরিবর্তনের ইঙ্গিত ও সুস্পষ্ট বিবরণ পাওয়া যায়। আল্লাহ তাআলার সৃষ্টির কীর্তিমহিমা আলোচনা করলে মানুষের কাছে বিষয়টি প্রকাশিত হয়ে যায়। এ সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই আসমান জমিন সৃজনে, রাত-দিনের আবর্তন-বিবর্তন মানুষের প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী নিয়ে সমুদ্রবক্ষে জাহাজ চলাচলে পৃথিবী ও আকাশের মাঝে টন টন ওজনবিশিষ্ট মেঘমালা প্রবাহিতকরণে নিদর্শনাবলি রয়েছে বুদ্ধিমানদের জন্য।’ (সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৬৪) প্রকৃতি ও পরিবেশের পারিপার্শ্বিক অবস্থা পরিবর্তনের বিস্তারিত বর্ণনা অনেক আয়াতে রয়েছে।

'আল্লাহ তাআলা এ সুজলা-সুফলা শস্যশ্যামলা সুন্দর পৃথিবীকে নানা ধরনের গাছপালা, তরুলতা আর বিভিন্ন প্রজাতির পশুপাখি সৃষ্টি করে সুশোভিত করেছেন। যেমনভাবে পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘আমি ভূমিকে প্রকৃষ্টরূপে বিদারিত করি। অতঃপর তাতে আমি উৎপন্ন করি শস্য, আঙুর, শাকসবজি, জয়তুন, খেজুর, বহু বৃক্ষবিশিষ্ট উদ্যান, ফলমূল এবং গবাদির খাদ্য; এটা তোমাদের এবং তোমাদের চতুষ্পদ জন্তুর ভোগের জন্য।’ (সূরা আবাসা, আয়াত: ২৬-৩২) পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের সুবিশাল অংশ একসময় বন-বনানীতে পরিপূর্ণ ছিল। আস্তে আস্তে বনাঞ্চলের পরিধি ছোট হয়ে আসছে। মানুষ ব্যাপকভাবে গাছ নিধন করে নির্বিচারে বন-জঙ্গল উজাড় করছে। সেসব জায়গায় গড়ে উঠছে বিভিন্ন কলকারখানা, শিল্পপ্রতিষ্ঠান, দোকানপাট আর বসতবাড়ি। ফলে বাতাসে অক্সিজেনের পরিমাণ হ্রাস পাচ্ছে। আর কার্বনের মাত্রা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। পরিণামে দেশে প্রায়ই দেখা দিচ্ছে বন্যা, খরা, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, সিডর, সাইক্লোনের মতো পরিবেশবিধ্বংসী আবহাওয়ার তাণ্ডব। অথচ আল্লাহ তাআলা তাঁর অপরূপ সৃষ্টিজগতে বিভিন্ন ধরনের গাছপালা, পশুপাখি, পাহাড়-পর্বত, নদী-নালা ও সমুদ্রের মাধ্যমে প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা করা প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘আমি আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী এবং এ দুয়ের মধ্যবর্তী কোনো কিছইু ক্রীড়াচ্ছলে সৃষ্টি করিনি। আমি এ দুটি অযথা সৃষ্টি করিনি, কিন্তু এদের অধিকাংশই এটা জানে না।’ '

(সূরা আদ-দুখান, আয়াত: ৩৮-৩৯) সুতরাং কেউ যদি সৃষ্টিজগতের স্বাভাবিক চলমান প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করতে চায়, তখনই নেমে আসে প্রাকৃতিক পরিবেশ বিপর্যয়। বর্তমান বিশ্বে জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত যে মহাদুর্যোগের সূত্রপাত ঘটতে দেখা যাচ্ছে, তা এককথায় মানবজাতির জন্য বিরাট অভিশাপ। প্রকৃতির বিরুদ্ধে মানুষের নির্মমতা ও নির্দয়তার প্রতিশোধ নিতে যেন খেপে উঠেছে প্রকৃতি স্বয়ং। অতীতে অনেক সম্প্রদায় জলবায়ুর বিবর্তনেই শেষ হয়ে গেছে। কওমে আদ, কওমে সামুদ, কওমে নুহ, কওমে লুত ধ্বংস হয়ে গেছে। হজরত নুহ (আ.)-এর সম্প্রদায় মহাপ্ল­াবনে নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল। আদ ও সামুদ জাতির আবহাওয়া অতিশয় উষ্ণ হয়ে উঠেছিল। এগুলো জলবায়ু পরিবর্তনেরই ইঙ্গিত বহন করে। তাই ধর্মপ্রাণ মানুষকে সৃষ্টিজগৎ নিয়ে গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করতে হবে। গাছগাছালির মতো জনগুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহারে জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিতে হবে। নির্বিচারে গাছ নিধনের মতো পরিবেশবিনাশী কর্মকাণ্ড বন্ধ করতে হবে। কোনো প্রয়োজনে গাছ কাটা হলে এর পরিবর্তে বেশি করে গাছের চারা রোপণ জরুরি। প্রাকৃতিক পরিবেশ সংরক্ষণ ও বৃক্ষরোপণের প্রতি অত্যধিক গুরুত্ব আরোপ করে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যদি কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার মুহূর্তেও তোমাদের কারও হাতে একটি চারা গাছ থাকে, তাহলে সে যেন সেই বিপৎসংকুল মুহূর্তেও তা রোপণ করে দেয়।’ (আদাবুল মুফরাদ) জলবায়ু পরিবর্তন রোধে মসজিদের ইমাম ও খতিবেরা পবিত্র কোরআন ও হাদিসের আলোকে পরিবেশ বিপর্যয় রোধের সমস্যা সমাধানকল্পে একটি গঠনমূলক দিকনির্দেশনা মুসল্লিদের দিতে পারেন। পৃথিবীর ভারসাম্য ও প্রাকৃতিক পরিবেশ সংরক্ষণে ইসলাম যে নীতিমালা দিয়েছে, ওলামায়ে কিরাম যদি কোনো মঞ্চ থেকে এ বিষয়গুলো মানুষের সামনে উপস্থাপন করেন, তাহলে এর প্রভাব ধর্মপ্রাণ মানুষের ওপর বেশি পড়তে পারে।

জলবায়ু পরিবর্তনজনিত মহাবিপর্যয় রোধে দেশের জনগণকেও সচেতন থেকে সর্বাত্মক ভূমিকা পালন করতে হবে এবং পাহাড়-পর্বত, নদী-নালা, বন-জঙ্গল, সুন্দরবন সুরক্ষাসহ সামাজিক বনায়নের ক্ষেত্রে ও সামগ্রিক পরিবেশ রক্ষায় সর্বোচ্চ মনোযোগী হতে হবে। বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী জলবায়ুঝুঁকি কমাতে পরিবেশবিনাশী কর্মকাণ্ড সর্বাগ্রে বন্ধ করা দরকার। জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মসূচি গ্রহণ করার জন্য সামাজিক আন্দোলনসহ গণসচেতনতা বাড়াতে জাতি-ধর্ম-বর্ণ-দলমতনির্বিশেষে আপামর জনসাধারণ সবাইকে এখনই সজাগ হতে হবে। ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক। [email protected]

এই বিভাগের আরো খবর