শুক্রবার   ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪   পৌষ ১৩ ১৪৩১

বহু অপকর্মের হোতা সাংবাদিক রাজুর ব্যাংক হিসাব জব্দ

যুগের চিন্তা রিপোর্ট :

প্রকাশিত: ২৬ নভেম্বর ২০২৪  

গডফাদার হিসেবে খ্যাত আওয়ামী লীগ নেতা শামীম ওসমানের ক্যাডার হিসেবে পরিচিত বহু অপকর্মের হোতা সাংবাদিক রাজু আহমেদের ব্যাংক হিসাব জব্দ করার নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)।  গতকাল রোববার (২৪ নভেম্বর) বিএফআইইউ থেকে ব্যাংকগুলোতে এ সংক্রান্ত একটি নির্দেশনা জারি করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, হিসাব জব্দ করা ব্যক্তির মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবও স্থগিত রাখার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। 

 

যুগান্তর, ডিবিসি ও ডেইলি অবজারেরর সাবেক নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি রাজু আহমেদ সাংবাদিকতার আড়ালে সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজি, মাদকব্যবসাসহ বহু অপকর্মের হোতা হিসেবে কুখ্যাতি ছিল। গডফাদার শামীম ওসমান, তাঁর ছেলে আজমেরী ওসমান, ভাতিজা আজমেরী ওসমান, শামীম ওসমানের ভাই সেলিম ওসমানসহ গোটা ওসমান পরিবারের পালিত সন্ত্রাসী হিসেবে সাংবাদিকতার আড়ালে এসব অপকর্ম করতো রাজু। ওসমান পরিবারের প্রত্যক্ষ মদদে প্রথম সারির এসব পত্রিকা ও টেলিভিশন চ্যানেলের প্রতিনিধির পদ দখলে নিয়েছিলেন রাজু আহমেদ। এমনকি ‘নারায়ণগঞ্জের আলো’ নামে একটি স্থানীয় দৈনিক বের করে ওসমানদের পক্ষপাতদুষ্ট প্রচার করতেন রাজু।

 

সর্বশেষ বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে শামীম ওসমান, তাঁর ছেলে অয়ন ওসমান, ক্যাডার যুবলীগ নেতা শাহনিজাম, শাহাদাৎ হোসেন সাজনুর সাথে ‘কেজিএফ’ স্টাইলে দুই হাতে অস্ত্র নিয়ে গুলি ছুঁড়তে দেখা গেছে রাজুকে। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে গুলি চালানোর ভিডিও প্রকাশিত হওয়ার পর বেশ কয়েকটি ছাত্র হত্যা মামলায় আসামী হয়েছেন রাজু আহমেদ।  নারায়ণগঞ্জ রাইফেল ক্লাবের অস্ত্র লুট কাণ্ডে শামীম ওসমানের যে নীল নকশা ছিল তাতে ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক শামীম ওসমানের বন্ধু খালেদ হায়দার কাজলের সাথে মাষ্টারমাইন্ড হিসেবে কাজ করেছেন এই রাজু। ওসমানরা পালালেও কয়েকটি সূত্র জানিয়েছে, এখনো দেশেই আছেন শামীম ওসমানের ক্যাডার রাজু আহম্মেদ। তাকে গ্রেফতার করতে পারলে বিশাল অঙ্কের অস্ত্রের ভান্ডার উদ্ধার করা সম্ভব হবে বলে জানায় সূত্র।

 

 

শামীম ওসমান ও গোটা ওসমান পরিবারকে ব্যবহার করে বিপুল পরিমাণ অর্থবিত্তের মালিক বনে যান রাজু আহমেদ। সামান্য এক হোটেল বয় থেকে কোটি কোটি টাকার মালিক বনে যাওয়া রাজু আহমেদের উত্থান যে কাউকে শিহরিত করবে। নারায়ণগঞ্জে মাদকের অন্যতম বড় চালান রাজু আহমেদকে দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতেন শামীম ওসমান। বন্দরে কয়েক হাজার পিস ইয়াবা আটকের পর রাজুর নাম আসলে শামীম ওসমানের প্রভাব ও প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপে সেখান থেকে রেহাই পান। জমি দখল, মাদক ব্যবসা, নারী কেলেঙ্কারীসহ অনেক অপকর্মের মূল হোতা হলেও রাজুর বিরুদ্ধে কেউ কখনো মুখ খোলার সাহস করেনি কেউ। 

 

 

শামীম ওসমানের প্রত্যক্ষ মদদে গোটা নারায়ণগঞ্জে সাংবাদিকদের একটি বিশাল সিন্ডিকেট গঠন করে গোটা জেলায় অপকর্ম করে বেড়াতেন রাজু। শামীম ওসমানের সকল ক্যাডারদের মেলবন্ধন ঘটাতেন রাজু। সাংবাদিকদের বিশাল সিন্ডিকেট গড়ে তুলে কাউকে জমি ব্যবসা, ডায়িং ব্যবসা, কাউন্সিলর চেয়ারম্যান নির্বাচনে প্রার্থীদের কাছ থেকে টাকা নেয়া, জুট ব্যবসা, হোসেয়ারি ব্যবসা, মাদক ব্যবসা, মেলার ব্যবসা, সরকারি খাস জমির ইজারা সুবিধা দেয়া, মিডিয়াতে কে বা কারা সুযোগ পাবে, ডিস ব্যবসাসহ নানা প্রকারের বৈধ অবৈধ ব্যবসায় নিয়োগ-বাদ দেয়ার সেটেলমেন্ট করতেন রাজু আহমেদ। এসব করে কোটি কোটি টাকার মালিক বনে যান রাজু। শুধু তাই নয়, নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন সাংবাদিক ক্লাবের ছায়া নিয়ন্ত্রক হিসেবে কাজ করতেন রাজু। অবৈধ পয়সার জোরে নানা আমোদ-ফুর্তির আয়োজন করতেন রাজু। 

 

 

বন্দরের কলগাছিয়ায় একটি বাংলো বাড়িতে ধর্ষণের ঘটনা ঘটিয়ে শেষ পর্যন্ত শামীম ওসমানের প্রভাবে ধামাচাপা দেন। রাজুর কাছে সবসময় বৈধ-অবৈধ সকল প্রকারের অস্ত্রের মজুদ থাকতো। নারায়ণগঞ্জ রেলস্টেশনের পাশে ৩নং মাছ ঘাটে জুয়ার আসর বসানো, ইয়ার্ন মার্চেন্টে লিটন সাহার সাথে জুয়ার আসর বসনো, লিটন সাহার ভাই রামু সাহার সাথে বিভিন্ন জায়গায় মদের আসর বসিয়ে জলসার আয়োজন, আবাসিক হোটেল নিয়ন্ত্রণ, হাসপাতালগুলোতে চাঁদাবাজিসহ সবধরণের কুকর্মে জড়িত ছিল রাজু আহমেদ ওরফে কাইল্লা রাজু। ২০১৮ সালের ১৬ জানুয়ারি তৎকালীন নাসিক মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভীর উপর হামলার ঘটনায় বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মতোই অস্ত্রহাতে দেখা গিয়েছিল রাজু আহমেদকে। তাছাড়া শামীম ওসমানের প্রত্যক্ষ নির্দেশে ফতুল্লা থানায় ঢুকে গ্রেফতার হওয়া জামায়াত নেতা মাঈনুদ্দিন আহম্মেদকে জোর করে নানা বিতর্কিত স্বীকারোক্তি আদায়ের মূল কারিগর ছিলেন এই কুখ্যাত রাজু আহমেদ। 

 

শুধু তাই নয়, ওসি মঞ্জুর কাদের থানায় থাকাবস্থাতেই ওই ঘটনার অডিও রেকর্ড রাজনৈতিক ফায়দা লুটার জন্য প্রকাশ্যে আনেন রাজু আহমেদ। শামীম ওসমানের প্রভাব খাটিয়ে জেলার বিভিন্ন শিল্পকারখানাতে চাঁদাবাজিতেও জড়িত ছিল রাজু। এতোঅপকর্ম সত্ত্বেও সাংবাদিকদের একটি বিশাল অংশ রাজুর নানা অপকর্মের সহযোগী হয়েছিলেন ফায়দা লুটার জন্য। নৌবিহার, স্পিডবোটে ভ্রমণের নামে রাজু আহমেদের সাথে একটি সেলফি তুলেও নিজেদের অনেকে বড় ও ক্ষমতাশালী সাংবাদিক জাহির করতে সেই সুবিধাভোগী সাংবাদিকরা। আড়লে ছিল ভিন্ন কাহিনী। রাজুকে তেল মর্দন করে অনেকে নিজেদের পদ-পদবী, চেয়ার, ব্যবসা নিরবিচ্ছিন্নভাবে চালাতেন। 

 

 

শুধু তাই নয়, শামীম ওসমানের স্ত্রী পারভীন ওসমান একবার দম্ভ করে বলেছিলেন, তাঁর বাড়ির চাকরবাকরও এমপি হয়। তেমনি রাজু আহমেদের বিড়ি টেনে দেওয়া লোকও নানা খ্যাতনামা পত্রিকা, টেলিভিশনের প্রতিনিধি বনে গিয়ে গোটা জেলায় ত্রাস ছড়াতেন। শিক্ষাগত যোগ্যতা কিংবা কাজের দক্ষতা না থাকলে শুধুমাত্র রাজুর ইচ্ছায় নারায়ণগঞ্জের প্রতিনিধিগুলো নির্বাচন করতো মিডিয়া হাউজগুলো। অনেক বড় বড় মিডিয়া হাউজের বড় পদের কর্তারাও রাজুর মাধ্যমে সুবিধা আদায় করতো। নারায়ণগঞ্জ এবং ঢাকায় তাদের জন্য বিশাল আয়োজনের ব্যবস্থা থাকতো। 

 


রাজু আহমেদের কুকর্ম যেমন ভয়ঙ্কর ছিল বেশ ভুষা, চালচলনেও আতঙ্ক ছড়াতো। তামিল ভিলেনদের মতো বড় বড় মোচ আর মাদকে বুদ হয়ে চোখ লাল রাজু দেখতোও ভয়ঙ্কর ছিল। রাজুর এই অদ্ভুদ চালচলনকে আইডল মেনে তার অনুসারী সাংবাদিক, ছাত্রলীগ, যুবলীগ নেতারাও তাকে খুশি করতে সেই বেশভুষা ধারণ করতো। রাজু শামীম ওসমানের ভাতিজা আজমেরী ওসমানের মতোই অবৈধ পয়সায় কেনা দুই গাড়িতে গোটা শহর দাবড়ে বেড়াত। রাজু আহমেদের ভাই, আত্মীয় কাউকে গিয়ে বিদ্যুৎ অফিসের ঠিকাদারী, আবার কাউকে ড্রেজার পরিদপ্তর নিয়ন্ত্রণ, কাউকে আবার অদূর সোনারগাঁয়ের বালু ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ করতো। 

 

শামীম ওসমানের প্রত্যক্ষ মদদে রাজুর ঈশরাতেই জেলা পরিষদের ঠিকাদার, এলজিইডির ঠিকাদার, গণপূর্তের ঠিকাদার, শিক্ষাপ্রকৌশল, জনস্বাস্থ প্রকৌশল অধিদপ্তর, সড়ক ও জনপথের ঠিকাদাররা কাজ পেত। রাজু আহমেদকে গ্রেফতার করতে পারলে শামীম ওসমানের বিশাল অপকর্মের সকল তথ্য উদ্ধার সম্ভব হবে। শামীম ওসমানের দেশে ও বিদেশে বৈধ ও অবৈধ সকল সম্পদের ফিরিস্থিও জানা যাবে এই কুখ্যাত রাজু আহমেদের কাছ থেকে। নামে বেনামে শামীম ওসমানের মতোই দেশে বিদেশে বিপুল সম্পদ গড়েছেন রাজু আহমেদ। সর্বশেষ মাদকের অন্যতম কারবারী রাজু আহমেদ শামীম ওসমানের শ্যালক তানভীর আহমেদ টিটুর সাথে নারায়ণগঞ্জ কারগারের বেসরকারী কারা পরিদর্শকও হয়েছিলেন রাজু।  

 


বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) আদেশে রাজু আহমেদসহ আরও ১০ সাংবাদিকের ব্যাংক হিসাব জব্দ করার নির্দেশ দেয়া হয়। আরও যাদের হিসাব জব্দের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে তারা হলেন দৈনিক বাংলার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক চৌধুরী জাফরুল্লাহ শারাফত, জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি শফিকুর রহমান, টিভি টুডের প্রধান সম্পাদক মনজুরুল আহসান বুলবুল, ওয়াশিংটনের সাবেক প্রেস মিনিস্টার সাজ্জাদ হোসেন সবুজ, ডিবিসি নিউজের অ্যাসাইনমেন্ট এডিটর নাজনীন মুন্নি, ইনডিপেনডেন্ট টিভির প্রধান বার্তা সম্পাদক আশীষ ঘোষ সৈকত, গাজী টিভির এডিটর (রিসার্চ) অঞ্জন রায়, সময় টিভির চট্টগ্রাম ব্যুরো চিফ কমল দে, দৈনিক আমার সময়ের প্রধান সম্পাদক আব্দুল গাফফার খান।

 
হিসাব জব্দ করা ব্যক্তি ও তাদের ব্যক্তি মালিকানাধীন ব্যবসায়িক অ্যাকাউন্টের সব ধরনের লেনদেন আগামী ৩০ দিন বন্ধ থাকবে। 
লেনদেন স্থগিত করার এ নির্দেশের ক্ষেত্রে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ বিধিমালা সংশ্লিষ্ট ধারা প্রযোজ্য হবে বলে বিএফআইইউয়ের চিঠিতে বলা হয়েছে। চিঠিতে আলোচিত ব্যক্তিদের নাম, জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্য দেওয়া হয়েছে।


বিএফআইইউয়ের নির্দেশনায় বলা হয়েছে, যেসব হিসাব স্থগিত করা হয়েছে তাদের হিসাব সংশ্লিষ্ট তথ্য বা দলিল, যেমন হিসাব খোলার ফরম, কেওয়াইসি ও লেনদেন বিবরণী যাবতীয় তথ্য চিঠি দেওয়ার তারিখ থেকে দুই কার্য দিবসের মধ্যে বিএফআইইউতে পাঠাতে হবে।

এই বিভাগের আরো খবর