বৃহস্পতিবার   ২৮ নভেম্বর ২০২৪   অগ্রাহায়ণ ১৪ ১৪৩১

বিভক্ত হেফাজত নানা চাপে কোনঠাসা

যুগের চিন্তা অনলাইন

প্রকাশিত: ১৭ এপ্রিল ২০২১  

একের পর এক সংকটে পড়ে সময় ভালো যাচ্ছে না হেফাজতে ইসলামের। ২০১৩ সালে রাজধানীর শাপলা চত্বরে জন স্রোত দেখিয়ে দেশে-বিদেশে আলোড়ন তোলা হেফাজত এমন চাপে পড়েনি আগে। কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যসহ এত নেতা অতীতে কারাবন্দিও হননি। সংগঠনের ভাবমূর্তি বাঁচিয়ে টিকে থাকার সঙ্গে আইনি মোকাবেলা এখন  হেফাজতের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। বিশেষ করে হেফাজতের ডাকা হরতালে ঢাকা চট্টগ্রামে নাশকতা এবং মামুনুল হক কান্ডে সোনারগাঁয়ে নাশকতার দায়ে বেশ কয়েকটি মামলায় গ্রেফতার হয়েছেন বেশ কয়েকজন হেফাজত নেতা। 

 

গত ২৮ মার্চ  হেফাজতে ইসলামের হরতালে সহিংসতার অভিযোগে দায়ের করা মামলায় ১৩ এপ্রিল হেফাজতের ইসলাম নারায়ণগঞ্জ জেলা সেক্রেটারি মুফতি বশির উল্লাহকে গ্রেফতার করে পুলিশ। সিদ্ধিরগঞ্জের সানারপাড় লন্ডন মার্কেট এলাকায় নির্মাণাধীন বাড়ী থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়।  পুলিশ বলছে, গ্রেফতার হওয়া  হেফাজত নেতা মুফতি বশিরউল্লাহ ২৮ মার্চ হেফাজতে ইসলামের হরতালে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তবে তিনি মামলার এজহারভুক্ত আসামী নয়।

 

এছাড়া গত ৩ এপ্রিল মামুনুল হক কান্ডে সোনারগাঁয়ে হেফাজতের তা-বের মামলায় গ্রেফতার হয়েছেন খেলাফত মজলিশ সোনারগাঁ উপজেলার শাখার সভাপতি ইকবাল হোসেন (৫২), হেফাজত ইসলাম সোনারগাঁও উপজেলা শাখার আমির হাফেজ মাওলানা মহিউদ্দিন খাঁন (৫৩), সেক্রেটারি মাওলানা মো. শাহজাহান খাঁন শিবলী (৪৩) ও সহ-সভাপতি হাফেজ মোয়াজ্জেম হোসেন (৫২)। তাদের প্রত্যেককে তিনদিনের রিমা-ে নেয়া হয়েছে।

 

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলছে, এই চারনেতার নেতৃত্বে রয়েল রিসোর্ট ছাড়াও হেফাজতকর্মীরা ঘটনার দিন সোনারগাঁ এলাকার একাধিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ব্যাপক সহিংসতা, গাড়ি ভাঙচুর, নাশকতা সৃষ্টি ও অগ্নিসংযোগ করে যান চলাচলে ব্যাঘাত ঘটায়, জনমনে ভয়ভীতি সঞ্চার এবং সরকারি কাজে বাধা সৃষ্টি করে। ওই সময় সোনারগাঁ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স মসজিদের ইমাম ও খেলাফতে মজলিশ সোনারগাঁ উপজেলা শাখার সভাপতি মাওলানা ইকবাল হোসেন মাগরিবের নামাজের পর মসজিদের মাইকে উসকানিমূলক বক্তব্য প্রচার করে লোক জমায়েত করে এবং উক্ত হামলার নেতৃত্ব দেয়। এছাড় হেফাজত নেতা রূপগঞ্জ গোলাকান্দা গাউছিয়া রোড এলাকার আলমগীরের বাড়ীর ভাড়াটিয়া মো. সামশের আলীর ছেলে আনসারুল হক ওরফে আনোয়ার হোসেন (৪০), সোনারগাঁয়ের গোহাট্ট্রা এলাকার নাঈম ওরফে মোস্তফা কামালের ছেলে মো. অনিক (২০), সোনারগাঁ বাড়ী মজলিশ এলাকার কামালের ছেলে মো. নুরুজ্জামান (২২), সনমান্দি এলাকার মো. মাইনুদ্দিনের ছেলে জিয়া উদ্দিন (৩৭), একই এলাকার মো. তোফাজ্জল হোসেনের ছেলে তুষার ইসলাম (৩৮) ও মো. মাইনুদ্দিনের ছেলে আলাউদ্দিন (৪০)কে রিমা-ে নিয়েছে পুলিশ।   

এদিকে গ্রেপ্তার এড়াতে হেফাজতের অনেক নেতা লুকিয়ে রেখেছেন নিজেকে। এ রকম প্রেক্ষাপটে কেন্দ্রীয় এক নায়েবে আমির অরাজনৈতিক সংগঠন হেফাজতের রাজনৈতিক কর্মকা-ের অভিযোগ তুলে স্বেচ্ছায় পদ ছেড়েছেন। ভেতরে ভেতরে  নেতৃত্বের বিরোধিতা করে সক্রিয় হয়ে উঠেছে হেফাজতের আরেকটি অংশ।


সূত্র জানিয়েছে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরের বিরোধিতা করে সংগঠনটি সাম্প্রতিক সময়ে মাঠে নামে। পরে তাদেরই হরতাল ঘিরে ব্যাপক নাশকতার জেরে নেতাকর্মীর ওপর নেমে আসে শতাধিক মামলার খড়গ। এর পরই যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হকের রিসোর্টকা-। সংকটের এখানেই শেষ নয়, প্রতিষ্ঠাতা আমির আল্লামা শাহ আহমদ শফীর মৃত্যুর ঘটনায় দায়ের করা মামলায় অভিযুক্ত হন বাবুনগরীসহ ৪৩ কেন্দ্রীয় নেতা। এ ছাড়া রাজনৈতিক কর্মকা-ে জড়িত থাকা ও বিতর্কের কারণে বিভক্তি এবং পাঁচ কেন্দ্রীয়নেতাসহ শতাধিক নেতাকর্মী গ্রেপ্তারের ঘটনায় হেফাজতে বিরাজ করছে এক রকম ‘শীতল’ পরিস্থিতি।

 

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, উগ্রপন্থী কর্মসূচিকে ভুল আখ্যা দিয়ে সংগঠনের একটি পক্ষ বিভিন্ন পর্যায়ে সমঝোতার চেষ্টাও করছে। তবে কেন্দ্রীয় কমিটিসহ মূল নেতারা মামুনুলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে এবং সরকারবিরোধী বেপরোয়া কর্মসূচির নাশকতায় ভুল স্বীকার করার পক্ষে নন। তাঁরা ভাবছেন, এমন পদক্ষেপ নিলে সংগঠনটি জনপ্রিয়তা হারাবে। এমন উভয় সংকটের চাপে হেফাজতের নেতৃত্ব। অন্যদিকে নাশকতা এবং ব্যক্তিগত ঘটনায় নজরদারি করে হেফাজতের কয়েকজন  নেতাকে আইনের আওতায় আনা হয়েছে বলে জানায় পুলিশ ও র‌্যাবের একাধিক সূত্র। এই প্রক্রিয়ায় আরো কয়েকজন নেতাসহ সংশ্লিষ্টরা হতে পারেন গ্রেপ্তার। 


গত ২৫ মার্চ থেকে প্রতিবাদ ও হরতাল কর্মসূচিতে চট্টগ্রামের হাটহাজারী,  ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিলেট, নারায়ণগঞ্জ, ঢাকা, মুন্সীগঞ্জসহ  দেশের বিভিন্ন স্থানে  হেফাজতের তা-বের ঘটনায় শতাধিক মামলা হয়েছে। গত ৩ এপ্রিল মামুনুল হক  সোনারগাঁর একটি রিসোর্টে নারীসহ অবরুদ্ধের ঘটনার জেরে নাশকতারও কয়েকটি মামলা হয়েছে। আল্লামা শফীর মৃত্যুর ঘটনায় চট্টগ্রাম আদালতে তাঁর শ্যালক মো. মঈনউদ্দিনের দায়ের করা মামলায় বর্তমান আমির জুনায়েদ বাবুনগরীসহ ৪৩ জনের নামে গত সোমবার তদন্ত প্রতিবেদন দেয় পিবিআই (পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন)। হেফাজতের কর্মসূচি নিয়ে বিতর্কের মধ্যেই মামুনুুলের রিসোর্টকা- সংগঠনটির ভাবমূর্তি আরো সংকটে ফেলে।

 

নারায়ণগঞ্জে মোদি কান্ডে হেফাজতের ব্যানারে মাঠ গরম করা সম্প্রতি আলোচিত ‘শিশুবক্তা’ হাফেজ মাওলানা রফিকুল ইসলাম মাদানীকে গ্রেপ্তারের পর জানানো হয়, পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত রফিকুলও গোপনে বিয়ে করেছেন। শাপলা চত্বরের ঘটনার আট বছর পর হেফাজতের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা আজিজুল হক, কেন্দ্রীয় সহকারী মহাসচিব মুফতি শাখাওয়াত হোসাইন রাজী, মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দী, সহ-অর্থ সম্পাদক ও ঢাকা মহানগরী কমিটির সহসভাপতি মুফতি ইলিয়াস হামিদী, কেন্দ্রীয় কমিটির সহপ্রচার সম্পাদক মুফতি শরিফউল্লাহ, নারায়ণগঞ্জ জেলা সেক্রেটারি মুফতি বশির উল্লাহসহ বিভিন্ন পর্যায়ের শতাধিক নেতা। বিতর্কের জেরে গত মঙ্গলবার ঢাকায় সংবাদ সম্মেলন করে পদত্যাগ করেন সংগঠনের নায়েবে আমির ও বাংলাদেশ ফরায়েজী আন্দোলনের সভাপতি মাওলানা আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ হাসান। তিনি বলেন, ‘বর্তমান কমিটির কয়েকজন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সংগঠনকে ব্যবহার করছেন।’


এসকল বিষয়ে হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমীর , নারায়ণগঞ্জ জেলা হেফাজতের সভাপতি  ও ডিআইটি মসজিদের খতিরব মাওলানা আউয়াল বলেন, ‘বর্তমানেও হেফাজত একটি অরাজনৈতিক সংগঠন। তাই হেফাজতের বিভিন্ন কার্যক্রমের সাথে যুক্ত আছি। কিন্তু যেদিন হেফাজত রাজনৈতিক সংগঠনে রূপ নেবে, সেদিন আমি হেফাজত থেকে সরে আসবো। বাংলাদেশের তথাকথিত রাজনীতিতে আমার কোন আগ্রহ নেই। তাই হেফাজত মূল ধারার রাজনীতির সাথে যুক্ত হোক এটিও আমি চাইনা।’     


মিম্বারে বসে আপনি রাজনীতি করেন কিনা এমন প্রশ্নে মাওলানা আউয়াল বলেন, ‘ইসলামী দৃষ্টিকোন থেকে রাজনীতি যেমন, আমি আমার ধর্মপ্রাণ মুসল্লীদের সেই বিষয়টিই বোঝাই। কিন্তু এর বাইরে রাজনৈতিক আলাপ মিম্বারে বসে করিনা। যারাই বলেন, আমি মিম্বারে বসে রাজনীতি করি, এটা তাদের ভুল ধারণা, তাদের চিন্তায় যথেষ্ট সচ্ছতার প্রয়োজন রয়েছে।’ 


বর্তমানে হেফাজত নেতারা চাপে আছে কি না এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘বর্তমানে আমাদের সকলের মোবাইল ট্র্যাকিং করা হচ্ছে, সেই অর্থে কারো সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হচ্ছেনা। হেফাজতের বিভেদের বিষয়ে তিনি কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি। হরতালের দিনকে কেন্দ্র করে তাকে বহিঃষ্কারের জন্য হেফাজতের একটি অংশ যে দাবি তুলেছিল সেই প্রসঙ্গে মাওলানা আউয়াল বলেন, আমার দিক থেকে আমি দেখেছি, যদি সেদিন ডিআইটি মসজিদ থেকে আমরা হরতালের উদ্দেশ্যে বের হতাম তাহলে অনেক খুনের ঘটনা ঘটতো। সবমিলিয়ে একটি অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতি তৈরি হতো। তাই যেহুতু আমি অরাজকতায় বিশ্বাসী না, সেজন্য আমি সেদিন ডিআইটি মসজিদেই সীমাবদ্ধ ছিলাম। আমার এই ভূমিকা নিয়ে হেফাজতের অনেকেই প্রশ্ন তুলেছিলেন। সেটি তাদের ব্যাপার।’


এদিকে  হেফাজতের হরতালে মাওলানা আউয়াল যোগ না দেওয়ায় তাতে ক্ষিপ্ত হন হেফাজতের মহানগরের সভাপতি ফেরদৌসুর রহমান। তিনি মাওলানা আউয়ালকে বহিঃষ্কারের জন্য কেন্দ্রে সুপারিশ পাঠানোর কথাও জানান এবং এই সংক্রান্ত সভাও করেন। জুরাইনে গ্রেফতার হওয়া ৪ হেফাজত নেতার সাথে মাওলানা ফেরদৌসুর রহমানকেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। হেফাজতের সাম্প্রতিক বিষয় নিয়ে কথা বলতে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও মাওলানা ফেরদৌসকে পাওয়া যায়নি। হেফাজতের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, হেফাজতের আগ্রাসী ভূমিকার নেপথ্যে থাকেন মাওলানা ফেরদৌস।

এই বিভাগের আরো খবর