বৃহস্পতিবার   ১৪ নভেম্বর ২০২৪   কার্তিক ৩০ ১৪৩১

বিশৃঙ্খলায় সেরা, অপরাধ করেও অধরা

যুগের চিন্তা রিপোর্ট

প্রকাশিত: ৭ মে ২০২৪  

 

 

শান্তির ধর্ম ইসলাম। অথচ ধর্মীয় লেবাস ব্যবহার করে নানাসময় নারায়ণগঞ্জকে উত্তপ্ত করে বিশৃঙ্খলা তৈরি করেন নারায়ণগঞ্জের দুই সাবেক হেফাজত নেতা মাওলনা আবদুল আউয়াল ও মাওলানা ফেরদৌসুর রহমান। তবে বড় বড় বিশৃঙ্খলায় ও শহরকে অশান্ত করার ক্ষেত্রে সামনের সারিতে নাম থাকলেও অদৃশ্য কারণে পার পেয়ে গেছেন মাওলানা আবদুল আউয়াল ও মাওলানা ফেরদৌসুর রহমান।

 

হেফাজতে ইসলাম কওমী মাদ্রাসাভিত্তিক একটি অরাজনৈতিক সংগঠন। তবে অরাজনৈতিক হলেও নানা ঘটনায় নানা সময়ে রাজনৈতিক বিষয়ে নাম এসেছে হেফাজতের। সম্প্রতি  শেখ রাসেল পার্ক ও চারুকলা ইন্সটিটিউট নিয়ে মাওলানা আবদুল আউয়াল ও ফেরদৌসুর রহমানের নানা অশালীন বক্তব্যে উত্তপ্ত পুরো নারায়ণগঞ্জ। আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ ও সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতারা প্রতিনিয়ত এই দুই হেফাজত নেতার অশালীন বক্তব্যের বিরুদ্ধে নানা কর্মসূচি দিয়ে আসছে। কিন্তু এখন প্রশ্ন উঠেছে কেন? হেফাজতের সাবেক দুই নেতা বারবার পার পেয়ে যাচ্ছেন।

 

মাওলানা ফেরদৌসুর রহমান নানা সময়ে ওলামা পরিষদের ব্যানারে যতগুলি কর্মসূচি করেছেন তার প্রত্যেকটিই ছিল অত্যন্ত আগ্রাসী, অশোভন, কটূক্তি ও অশালীন বক্তব্যে ভরপুর। বিশেষ করে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভীকে নিয়ে ওলামা পরিষদের কর্মসূচিতে অস্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করা হয়েছে। অন্যদিকে ডিআইটি মসজিদে জুমার খুতবায় উস্কানিমূলক নানা বক্তব্য দিয়ে শহরকে নানা সময় উত্তপ্ত করেছেন মাওলানা আবদুল আউয়াল।

 

এর আগে ২০১৩ সালের ৫ মে  মতিঝিলের শাপলা চত্ত্বরে হেফাজত তাণ্ডবের পরদিন ৬ মে নারায়ণগঞ্জের ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের শিমরাইল এলাকায় যে তাণ্ডব চলে তাতেও আসে এই দুই নেতারা নাম। সেই তাণ্ডবে হেফাজত লেবাসে থাকা জামায়াত শিবিরের ক্যাডারদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের টানা সাড়ে ৫ ঘণ্টার ব্যাপক সংঘর্ষে ১৪ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়। তাদের মধ্যে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) এর দুই সদস্য ও পুলিশের ২ জন সদস্য ছিল।

 

এ ঘটনায় যে মামলা দায়ের হয়েছিলো তাতে মাওলানা আউয়ালও মাওলনা ফেরদৌসুর রহমানসহ ৭৪ জনের বিরুদ্ধে চার্জশীট দেয়া হয়েছি। সেই মামলার আসামি তারাই পরবর্তীতে ওলামা পরিষদের ব্যানারে নারায়ণগঞ্জ শহরকে উত্তপ্ত করতে মাওলানা আউয়াল ও মাওলানা ফেরদৌসুদের দোসর হিসেবে কাজ করেছেন। সিদ্ধিরগঞ্জ থানা কমিটির আহ্বায়ক মাওলানা বশিরউল্লাহ, সদস্য সচিব মাওলানা তৈয়ব আল হুসাইন, হেফাজত নেতা মাওলানা মাহাবুবুর রহমান, মাওলানা মাহামুদুল হাসান কাশেমী, বাবু আনসার গাজী, মাদানীনগর মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মুফতি মাওলানা ফয়জুল্লাহ, আলতাফ হোসাইন, আবু তাহের, ইসমাইল আব্বাসী প্রমুখ।

 

সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের আগে ও জাতীয় নির্বাচনের আগে এবং প্রয়োজন অনুসারে নানা সময়ে আগ্রাসী ভূমিকায় মাওলানা আউয়াল ও ফেরদৌসুর রহমান হাজির হন । সোনারগাঁয়ে হেফাজত নেতা মামুনুল হক কাণ্ডে সোনারগাঁয়ের রয়েল রিসোট এলাকায় উপস্থিত হয়েছিলেন মাওলানা ফেরদৌসুর রহমান। এনিয়ে তখন উত্তপ্ত পরিস্থিতি তৈরির চেষ্টা করেছিলেন মাওলানা আউয়াল ও মাওলানা ফেরদৌসুর রহমান।

 

পরে পরিস্থিতি প্রতিকূলে গেলে ফেরদৌসুর গা ঢাকা দেন। এর আগে ঢাকায় তাকে জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়। মাওলানা আবদুল আউয়াল কিছুদিন চুপসে থাকেন। ২০২২ সালের সিটি নির্বাচনের আগে আবারও নানা অভিযোগ তুলে এজেন্ডা তৈরি করেন মাওলানা আউয়াল ও মাওলানা ফেরদৌসুর রহমান। বঙ্গবন্ধু সড়কের নানা সময় সমাবেশ ডেকে অশ্রাব্য ভাষায় মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভীকে ওলামা পরিষদের ব্যানারে গালিগালাজ করেন।

 

এরআগে ২০১৯ সালে জাতীয় নির্বাচনের সময়ও বিএনপি জোটের প্রার্থী মনির হোসেন কাশেমীকে সঙ্গে নিয়ে রাজনীতির মাঠে সরব হয়েছিলেন মাওলানা ফেরদৌসুর রহমান। ওই সময়েও পর্দার অন্তরালে শহরকে অশান্ত করতে নানা ফন্দিফিকির করেন তিনি।  

 

সর্বশেষ নারায়ণগঞ্জ শহরের ফুসফুস হিসেবে খ্যাত শেখ রাসেল পার্ককে মিনি পতিতালয় বলে মন্তব্য করে শহর উত্তপ্ত করেছেন এই দুই নেতা। তাদের আশকারায় আবারো মেয়র আইভী, শেখ রাসেল পার্ক, চারুকলা ইন্সটিটিউট নিয়ে বেফাঁস মন্তব্যে শহরে অস্বস্তিকর পরিবেশ তৈরি হয়েছে। তবে আপাতত আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দের ব্যাপক প্রতিবাদের মুখে ব্যাকফুটে গেছেন এই দুই বিতর্কিত হেফাজত নেতা। নগরবাসীর প্রশ্ন, গত এক যুগ ধরে ধারাবাহিকভাবে নানা উচ্ছৃঙ্খল ও আগ্রাসী কর্মকাণ্ড করে আইনের আওতায় না এসে পার পেয়ে যাওয়ায়ই মাওলানা আউয়াল ও মাওলানা ফেরদৌসুর লাগামছাড়া আচরণ করেছেন, করেন। তারা কোন অদৃশ্যের ঈশারায় ছাড় পেয়ে যান।

 

এ বিষয়ে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুল হাই যুগের চিন্তাকে বলেন, ‘আমি বেশ কয়েকবার হেফাজতের এই দুই নেতার বিরুদ্ধে প্রশাসনের কাছে ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানিয়েছি। ব্যবস্থা না নেয়ায় তারা ধৃষ্টতা দেখিয়েই যাচ্ছে। এটা তারা চালিয়ে যেতেই থাকবে। আমি জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার সাহেবের সাথে দেখা করে আবারও এনিয়ে কথা বলবো। এ্যাকশনে না গেলে এটা তারা করতে থাকবে এটাই স্বাভাবিক।

 

তাদের বিরুদ্ধে প্রশাসন শক্ত ব্যবস্থা নিবে এটা আমরা আশা করি। এগুলোর মধ্যে শয়তানি আছে। এগুলোকে অবিলম্বে গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনা হোক। আমরা আওয়ামী লীগের সেন্ট্রাল নেতাদের সাথেও এদের বিষয়ে কথা বলেছি। শক্ত ব্যবস্থা নেয়ার দাবি আবারো জানাবো।’

 

এ বিষয়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের জাতীয় পরিষদের অন্যতম সদস্য সিনিয়র আইনজীবী আনিসুর রহমান দিপু যুগের চিন্তাকে জানান, ‘যেহুতু তাদের নামে আইনশৃঙ্খলা কর্তৃপক্ষকে বার বার বলা সত্ত্বেও তারা শক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। আমাদের আবদুল হাই সাহেব বারবার এনিয়ে কথা বলেছেন কিন্তু অজ্ঞাত কারণে তারা আইনের আওতায় আসেনি। এতে করে তাদের সাহস অনেক বেড়ে গেছে। তারা ধরাকে সরা জ্ঞান করছে।

 

মসজিদকে রাজনৈতিক কার্যালয় বানিয়ে মাওলানা আউয়াল নেত্রী সম্পর্কেও নানা সময় আপত্তিকর কথা বলেছে মিম্বারে বসে। এনিয়ে মিডিয়ায় আমরা নারায়ণগঞ্জের মানুষ প্রশাসনের কাছে বিষয়টি খতিয়ে দেখার দাবি জানিয়েছিলাম। কোন সাহসে কার ইঙ্গিতে সে মিম্বারে বসে বারবার প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে কথা বলে, প্রগতিশীল রাজনীতিকদের নিয়ে কথা বলে যেগুলোর বেশিরভাগই আপত্তিকর কথা।

 

এ ব্যাপারে তাদের আজও আইনের আওতায় না নিয়ে আসায় এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত না করায় তারা এসব থেকে ক্ষ্যান্ত হবেনা। তারা এখন দেশের আবহকালের ঐতিহ্য সংস্কৃতি নিয়ে কথা বলছে, একসময় এগুলো পাকিস্তানিরা বলতো, বাধা দিতো। সাম্প্রদায়িক মৌলবাদীদের যা যা করা দরকার প্রত্যেকটা কর্মকাণ্ডই তারা করে যাচ্ছে কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এব্যাপারে কোন ব্যবস্থা নিচ্ছেনা।

 

এদের বিরুদ্ধে এখনই দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা না নেয়া হলে তাহলে আমি বিশ্বাস করি হেফাজতের পেছনে যে জঙ্গিবাহিনী আছে সেগুলো উৎসাহিত হবে, যেকোন সময় তারা নারায়ণগঞ্জের বড় ধরণের ঘটনা ঘটাতে পারে।’

এই বিভাগের আরো খবর