সোমবার   ২৫ নভেম্বর ২০২৪   অগ্রাহায়ণ ১০ ১৪৩১

মিলারদের সিন্ডিকেটে বাজারে কৃত্রিম সংকট

আবু সুফিয়ান

প্রকাশিত: ২ জানুয়ারি ২০২৩  


শুধু নারায়ণগঞ্জ নয় কোন চালের বাজারেই কোন রকমের সংকট নাই। তবুও দিনকে দিন চালের দাম বেড়েই চলেছে। এমনকি আমদানি শুল্ক কমিয়ে বিদেশ থেকে চাল আমদানির পরও দাম কমার কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। বহুদিন ধরেই চালের বাজার অস্থির। ধান-চালের ওপর কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের চোখ পড়েছে। তারা চালের বাজারে ঢুকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে।

 

 

গত শনিবার বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (BRRI/ব্রি) এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, মৌসুমি ধান ব্যবসায়ী ও মিলাররা বেশি মুনাফা করছেন। ধান-চালের বাজারে কৃষক থেকে ভোক্তা পর্যায়ে পৌঁছাতে পাঁচবার হাতবদল হয়। প্রতিবার হাতবদলের সময় যোগ হয় খরচ আর মুনাফা। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মুনাফা করছেন চাল কল মালিকরা।

 

 

তাঁরা প্রতি কেজি চাল ও এর উপজাত বিক্রি করে ৮ থেকে ১৪ টাকা পর্যন্ত মুনাফা করছেন। ব্রির প্রতিবেদন অনুযায়ী, এ বছর আমনের উৎপাদন সব রেকর্ড ছাড়িয়ে ১ কোটি ৬৩ লাখ টন হবে। বোরো ২ কোটি ৪ লাখ টন ও আউশ ৩০ লাখ টন ধরে মোট উৎপাদন হবে ৩ কোটি ৯৭ লাখ টন।

 

 

দৈনিক জনপ্রতি ৪০৫ গ্রাম করে চালের ভোগ হিসাব করলে ১৭ কোটি মানুষের জন্য বছরে চালের প্রয়োজন হবে ২ কোটি ৫১ লাখ ৩০ হাজার টন। প্রক্রিয়াজাত খাদ্য উৎপাদনের কাঁচামাল ও প্রাণিখাদ্য (নন-হিউম্যান) হিসেবে ১ কোটি ৩ লাখ ৭০ হাজার টন ব্যবহৃত হবে। সুতরাং এরপর উদ্বৃত্ত থাকবে ৪২ লাখ টন।

 



অনুসন্ধানে জানা গেছে, সরকারি হিসাবে চালের উৎপাদন, আমদানি, মজুত ও সরবরাহ বাড়লেও এগুলো এখন আর বাজার নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখতে পারছে না। মাঠ থেকে ধান উঠার পরই কৃষক তার খাদ্য ও বীজ বাবদ কিছু রেখে বাকি ধান বিক্রি করে দেন। সেগুলোর বেশিরভাগই কিনে নেন মৌসুমি চাল ব্যবসায়ী, মিলার, আড়তদার, পাইকার, অনলাইন ব্যবসায়ীসহ কিছু প্রতিষ্ঠান। তারা এগুলো মজুত করেছেন।

 

 

পরে গ্রাহকদের চাহিদামতো কিছু বাজারজাত করছেন বাড়তি দামে। বাকিগুলো মজুত রেখেছেন আরও দাম বাড়লে বাজারে ছাড়বেন-এই আশায়। ফলে এখন যারা চাল বাজারজাত করছেন তারা নিজেদের মতো দাম বাড়িয়ে বিক্রি করছেন। ফলে চালের দাম বাড়ছে। এমন কি ভরা মৌসুমেও চালের দাম বেড়েছে ওই কারণে।

 

 

নিতাইগঞ্জ বাজারের চালের আড়তে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কোথাও চালের সরবরাহ ও মজুতে কোনো ঘাটতি নেই। মিলারদের কাছে আদেশ দেওয়ার ২-৩ দিনের মধ্যেই ট্রাকভর্তি চাল আসছে। খুচরা বাজারেও কোনো ঘাটতি নেই।

 



শহরের নিতাইগঞ্জ চালের বাজারের একজন ব্যবসায়ী জানান, ২০২০ সালে করোনার সংক্রমণ শুরুর পর ব্যবসা-বাণিজ্যে বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে। করোনার কারণে প্রায় সব ধরনের ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। একমাত্র চালের ব্যবসায় ক্ষতি হয়নি। বরং চাঙ্গা হয়েছে। মুনাফাও বেড়েছে।

 

 

কিন্তু চালকল মালিকরা নানা অজুহাতে করোনার বছর সহ আরো দুই বছর চালের বাজারে অস্থিরতা তৈরি করে। আর কৃত্রিম সংকটের কারণে ভোগান্তিতে পড়তে হয় নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষদের।

 



গত শনিবার ব্রির বার্ষিক গবেষণা পর্যালোচনা কর্মশালার উদ্বোধন অনুষ্ঠানে কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, সামনের দিনগুলোতে চালের চাহিদা আরও বাড়বে। একদিকে জনসংখ্যা বাড়ছে, অন্যদিকে কৃষিজমি কমছে। জটিল পরিস্থিতিতে চালের উৎপাদন বাড়াতে গবেষণায় আরও জোর দিতে হবে।

 

 

একই সঙ্গে উদ্ভাবিত জাতের দ্রুত সম্প্রসারণ করতে হবে। চালের বাম্পার ফলনের পরও কেন দাম কমছে না, এর প্রকৃত কারণ খুঁজে বের করতে বস্তুনিষ্ঠ গবেষণার আহ্বান জানিয়ে মন্ত্রী আরও বলেন, ব্রির গবেষণায় আমরা অনেক কারণ খুঁজে পেয়েছি। ব্রির পাশাপাশি বিআইডিএস, সিপিডিসহ অন্য প্রতিষ্ঠানকেও এ বিষয়ে গবেষণা করা প্রয়োজন।

 

 

একই অনুষ্ঠানে ব্রির মহাপরিচালক শাহজাহান কবির বলেন, আমনে বাম্পার ফলন হয়েছে। আগামী জুন পর্যন্ত চালের কোনো সংকট হবে না, বরং ৪২ লাখ টন উদ্বৃত্ত থাকবে। ১৭ কোটি মানুষের চালের চাহিদার পাশাপাশি মানুষের বাইরে (নন-হিউম্যান) ভোগ ২৬ শতাংশকেও বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। তার পরও বাজারে কেন চালের দাম কমছে না, তা জানতে ব্রি মাঠ পর্যায়ে গবেষণা করেছে।

 

 

বাংলাদেশ ধান গবেষণার ইনস্টিটিউটের গবেষণায় দেখা গেছে, চালকল মালিক ও খুচরা বিক্রেতারা অতিরিক্ত মুনাফা করছেন। চালকল মালিকরা কেজিতে ৮-১৪ টাকা লাভ করছেন। কৃষকের উৎপাদন খরচও কিছুটা বেড়েছে। এ ছাড়া, করপোরেট গ্রুপগুলো চালের বাজারে ঢুকতে বাজার নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে।

 

 

জানা গেছে, আগে মিলার ও আড়তদাররা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ধান মজুত করতেন। ফলে তারা ব্যাংকের টাকা বিনিয়োগ করে চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করতেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক তদন্তে এ ঘটনা প্রমাণিত হওয়ায় এ খাতে ঋণ বিতরণে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। এখন ভিন্ন নামে বা বেনামে ঋণ নিয়ে তা ধানে বিনিয়োগ করা হচ্ছে।

 

 

এছাড়া কিছু প্রতিষ্ঠান ব্যাংক ঋণের একটি অংশ ধান কেনায় বিনিয়োগ করছে। তারা চাষের সময়েই আগাম টাকা নিয়ে ধান কিনে নিচ্ছেন। অনেকটা আমের মতো। এতে ধান-চাল যাচ্ছে ব্যবসায়ীদের কব্জায়। এছাড়া অনলাইনেও এখন চালের বড় বাজার গড়ে উঠেছে। তারাও এখন আগে থেকে চাল কিনে সেগুলো মজুত করে বছরজুড়ে বিক্রি করছে বাড়তি দামে।

 

 

উত্তরাঞ্চলকেন্দ্রিক কিছু অনলাইন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানও এভাবে চাল বিক্রি করছে। আগে মিলার, আড়তদার, পাইকার ও খুচরা ব্যবসায়ীরা চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করতেন। এখন তাদের পাশাপাশি অন্যরাও চালের বাজারে বড় নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠেছে। ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, সিন্ডিকেটের অপ্রতিরোধ্য দাপটের কারণে আমদানির সুফল পাচ্ছেন না তৃণমূলের ভোক্তারা।

 

 

মিল মালিকরা বলছেন, চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে আড়তে আড়তে অভিযান চালানো দরকার। পাইকাররা বলছেন, মিলগেটে নির্ধারিত দরের প্রভাব পড়ে খুচরা পর্যায়ে। তবে বাজার পর্যবেক্ষকদের ভাষ্য, প্রতিটি স্তরে তদারকি না থাকায় বিভিন্ন পর্যায়ে শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। এ চক্রের দৌরাত্ম্যে সরকার অসহায়।

 

 

ব্যবসায়ীদের অনেকের ধারণা, ভুল পরিকল্পনার কারণে সরকার সিন্ডিকেট ভাঙতে ব্যর্থ হচ্ছে। যার খেসারত সাধারণ মানুষকে দিতে হচ্ছে। বাজার ব্যবস্থাপনায় গলদসহ নানা ফাঁক দিয়ে অসাধু ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন সময় অনৈতিকভাবে বিপুল টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। তার জানান, গোড়া থেকে সমস্যার সমাধান না করলে সরকার যতই উদ্যোগ নিক, সুফল মিলবে না।

 

 

একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের ছাত্র মনিরুল ইসলাম বলেন, বাজার মনিটরিংয়ে বড় ত্রুটি থাকায় নিত্যপণ্যের বাজার দিন দিন অস্থির হয়ে উঠছে। তিনি বলেন, আমরা বাজার মনিটরিং মানেই ভ্রাম্যমাণ আদালত ও জরিমানা করা বুঝি। কিন্তু এটাকে মনিটরিং বলে না। এতে কেবল কিছু সংখ্যক ব্যবসায়ীর ক্ষতি হয়।

 

 

মুক্তবাজার অর্থনীতিতে এর কোনো সুফল নেই। মনিটরিং হচ্ছে পণ্যের চাহিদা ও সরবরাহের ওপর নজরদারি। আমাদের কাছে এ নিয়ে কোনো সঠিক পরিসংখ্যানই নেই। তা হলে সমাধান হবে কী করে।

 



বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে সরকার একটি আইন করেছে। নির্দিষ্ট পরিমাণের বেশি চাল মজুত করতে হলে লাইসেন্স নিতে হবে। এখন অনেকেই লাইসেন্স নিয়ে যেমন মজুত করছে, তেমনি লাইসেন্স ছাড়াও করছে। ফলে ধান বা চালের উৎপাদন, আমদানি ও সরবরাহের তথ্য সরকারের কাছে থাকলেও বেসরকারি পর্যায়ের তেমন কোন তথ্যই নেই।

 

 

শুধু চালই নয়, সব ধরনের ভোগ্যপণ্যেরই স্তরে স্তরে একাধিক শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। সরকার নানামুখী পরিকল্পনা গ্রহণ করেও তাদের নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হচ্ছে। এতে মুষ্টিমেয় ব্যবসায়ীর পকেট ভারী হলেও অগ্নিমূল্যের ফাঁদে পড়ে নিম্ন-মধ্যবিত্ত চিড়েচ্যাপ্টা হয়ে পড়েছে।  এন.এইচ/জেসি

এই বিভাগের আরো খবর