বৃহস্পতিবার   ২১ নভেম্বর ২০২৪   অগ্রাহায়ণ ৭ ১৪৩১

রবীন্দ্রনাথ একজীবনে

করীম রেজা

প্রকাশিত: ১১ মে ২০২২  

জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে অন্য আর দশটা সন্তানের মতোই রবীন্দ্রনাথের জন্ম। বেড়ে ওঠাও সেই পারিবারিক নিয়ম-নীতি-বেড়াজালের মধ্যেই। ব্যবসা, বিত্ত এবং সামাজিক প্রতিপত্তি ছাড়াও তখনকার কলকাতা শহরে ঠাকুর পরিবার সমাজে ললিতকলা চর্চার পথিকৃৎ। বাঙালি সংস্কৃতি নির্মাণ, পরিমার্জন, পরিশোধনের অগ্রদূত বা পথ নির্দেশক

 

রবীন্দ্রনাথের আগেই তার পরিবারের কেউ কেউ বিখ্যাত হয়েছেন। যেমন চিত্রকলায় অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম সর্বাগ্রে উচ্চারিত হয়। নাটক, পত্রিকা প্রকাশ, সাহিত্যবাসর বা গানের জলসার আয়োজন ইত্যাদিও প্রায় নিয়মিত ছিল। পরবর্তীকালে আমরা ঠাকুরবাড়িতে বিভিন্ন নাটকে রবীন্দ্রনাথের অভিনয়ের কথা তার জবানিতেই জানতে পারি।

 

যাই হোক, রবীন্দ্রনাথের জন্ম না হলে বাংলা ভাষা-সাহিত্যের বর্তমান পরিচয় নির্মিত হতে পারত না। কোনো কুতর্কে না গিয়েও এমন সরল উক্তি করা সম্ভব। আধুনিক বাংলা ভাষা নির্মাণের ধারাক্রমে আমরা পাই বিদ্যাসাগর, মধুসূদন, প্রমথ চৌধুরী, বিহারীলাল চক্রবর্তীর পরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে। সাহিত্য বা সাহিত্যের উপাদান তা কবিতা, নাটক, গান, গল্প, উপন্যাস যা-ই হোক না কেন তা ধারণ করার জন্য চাই মাধ্যম অর্থাৎ ভাষা। রবীন্দ্রনাথ সেই ভাষা নির্মাণ করেছেন।

 

ভাষা অবলম্বন করে তার যত রকম ব্যবহার সম্ভব তিনি তা করেছেন। তার আগে তিনি ব্রজবুলি ভাষায় কাব্য রচনা করেছেন ভানুসিংহ ঠাকুর ছদ্মনামে। তাও তার ভাষা নির্মাণের প্রচেষ্টার স্মারক। সব্যসাচী অভিধাটি অনেক লেখকের বেলায় প্রযুক্ত হতে দেখা যায়। তবে রবীন্দ্রনাথের বেলায় তা খুবই অপ্রতুল বোধ হয়। কারণ সাহিত্য,

 

শিল্পকলা, বিজ্ঞান অর্থাৎ জ্ঞানের এমন কোনো শাখা নেই যা নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ভাবেননি, লেখেননি। যেখানেই তিনি হাত দিয়েছেন, সোনা ফলেছে। যদিও কোনো কোনো ক্ষেত্রে ব্যর্থতাও ছিল যথেষ্ট। নোবেল প্রাপ্তির আগেই তিনি কৃষকদের সহায়তা করার জন্য ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করেন; আজকের আধুনিক পদ্ধতিতে যাকে কৃষিব্যাংক বলা হয়।

 

সমাজবিজ্ঞানীরা রবীন্দ্রনাথের উদ্যোগকে এখনকার আমলের ‘ক্ষুদ্রঋণ’ প্রকল্পের প্রাথমিক উদ্যোগও বলে থাকেন। এক সময় তহবিলের অভাবে কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়ে। নোবেল পুরস্কারের অর্থ হাতে এলে অন্য কোনো কাজে না লাগিয়ে সেই টাকা কৃষিঋণ বিতরণের জন্য দান করেন। যদিও পুরোটাই লোকসান হয়, এই টাকা আর কখনো ফেরত আসেনি।

 

জাহাজ ব্যবসায়ে একবার হাত দিয়েছিলেন, সেখানেও লোকসানের মুখে পড়েন। নিজের ছেলেকে তিনি কৃষিবিদ বানিয়েছিলেন। তার মানে শুধু সাহিত্যচর্চাই রবীন্দ্রনাথের সমগ্রতাকে আচ্ছন্ন রাখেনি।


তার প্রথম জীবনে দেখা যায় তিনি ব্রাহ্ম সমাজের সামাজিক বা ধর্মীয় অনুষ্ঠানের জন্য গান রচনা করেছেন এবং অনুষ্ঠানাদিতে তা নিজেও গেয়ে শোনাতেন। গান গাইবার জন্য অনুষ্ঠানে তাকে আমন্ত্রণ জানিয়েও নেওয়া হতো। তিনি ফকির লালন শাহের প্রচুর বাউল সংগীত সংগ্রহ করেছেন। লোকসাহিত্য নিয়ে ভেবেছেন, লিখেছেন। সংস্কৃতির সর্বত্র তিনি স্বচ্ছন্দে দৃঢ় পদচারণা করেছেন।

 

মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি লেখাজোখায় সক্রিয় ছিলেন। অক্লান্তভাবে বাংলা সাহিত্যের শ্রীবৃদ্ধি করেছেন। কবিবর নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন গীতাঞ্জলি কাব্য সংকলনের জন্য। তা ছিল ইংরেজি ভাষায় অনূদিত কবিতার সংকলন। এক উর্দুভাষী ভারতীয় গীতাঞ্জলির ইংরেজি কবিতা পড়ে এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে, তিনি মূল বাংলাভাষায় তা পড়ার অধীর আগ্রহ বোধ করেন।

 

মূল ভাষায় কাব্যগুণের আস্বাদ গ্রহণের জন্য তিনি সত্য সত্যই বাংলা ভাষা শিখলেন। শিখলেন এবং রবীন্দ্রনাথকে পড়লেন। শুধু পড়লেন বলা যথেষ্ট নয়, তিনি রবীন্দ্রনাথকে জানলেন। আর এই জানা তার জীবনের গতিপথ বদলে দেয়। তিনি এখন বাংলা ভাষায় রবীন্দ্র গবেষণার এক নমস্য ব্যক্তি। তার নাম আবু সয়ীদ আইয়ুব। রবীন্দ্র গবেষণা ক্ষেত্রে তার মতামত অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হয়।

 

রবীন্দ্রনাথকে জানার আগে অন্য অনেক লেখকের মতো আমিও লেখালেখির শুরুতে দেখতে পাই, তিনি আবেগের এমন কোনো স্তর নেই যা স্পর্শ করেননি। মানবিক বোধের যাবতীয় বিষয় তিনি তার কাব্যকলায় গভীর অনুভবে শিল্পবেদ্যতায় প্রকাশ করেছেন। আমরা চমৎকৃত হয়েছি, মুগ্ধ বিস্ময়ে তার পুনরাবৃত্তি করেছি, করছি এবং করব। তিনি আমাদের লৌকিক জীবনের নানা অনুভব পর্যায় যেমন তার রচনায় প্রযুক্ত ও প্রকাশ করেছেন, তেমনি আবার অলৌকিক বোধ-উপলদ্ধির জগতেও মোহাবিষ্টতা সৃষ্টি করেছেন। প্রাত্যহিক জীবনের সামাজিক আয়োজন প্রয়োজনে তার গান, গল্প, কবিতা, নাটক, উপন্যাস প্রাসঙ্গিতার অনবদ্য আসন দখল করেছে।


রবিঠাকুরের সময়কালে কিংবা পরবর্তী সময়ে আমরা এমন কোনো লেখকের সাক্ষাৎ পাই না যিনি রবীন্দ্রনাথকে ছাপিয়ে দৃষ্টিগোচর হয়েছেন। ব্যতিক্রম জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তিরিশোত্তর লেখক গোষ্ঠীর কাছেই আমরা ভিন্ন অবয়বের সাহিত্য আস্বাদ লাভ করি। আবার সাথে এও দেখি রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং আধুনিক সময়ের কবিদের মতোই নতুন ভঙ্গিতে কবিতা লিখছেন। কবির নাম উল্লিখিত না হলে বোঝা দুরূহ যে, তা রবীন্দ্রনাথের কলম থেকেই বেরিয়েছে। আমাদের অহঙ্কার যে আমরা বাংলাভাষী, বাঙালি জাতি কবিবর রবীন্দ্রনাথের উত্তরসূরি।


রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবন ও সাহিত্য নিয়ে যত লেখালেখি, চর্চা এবং গবেষণা হয়েছে তার তুলনা বিশ্ব সাহিত্যে এখন পর্যন্ত বিরল। তিনি পা-ুলিপিতে স্বহস্তে যে পরিমার্জনা করেছেন তাও হয়ে উঠেছে উৎকৃষ্ট মানের চিত্রকলা। তিনি ছবি এঁকেছেন, তাও কালের বিচারে টিকে আছে মানোত্তীর্ণতার তকমা নিয়ে। ভাষা বিজ্ঞান নিয়ে ভেবেছেন, লিখেছেন বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিসহকারে।


আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে রবীন্দ্র সাহিত্য ছিল অফুরন্ত প্রেরণার অন্যতম উৎস। আমাদের জাতীয় সঙ্গীত তারই লেখা। ষাটের দশকে রবীন্দ্র সাহিত্য ঘিরেই আমাদের জাতীয় শক্তি অমেয় উজ্জীবন লাভ করে। আজও সেই শক্তি আমাদের দিন-মাস-বছরের অগ্রসরমানতার দেদীপ্যমান আলোকবর্তিকা। বিদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে রবীন্দ্রনাথ পাঠ্য বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত।

 

অবাংলাভাষী অনেক বিদেশি প-িত রবীন্দ্র গবেষক আছেন, যারা রবীন্দ্র সাহিত্য নিয়ে নতুন নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার ও গবেষণায় নিয়োজিত। তার বিশাল সাহিত্য ভা-ার নিয়ে গবেষকদের ব্যাপ্তি-বিস্তৃতি এত ব্যাপক যে তাও অপর গবেষণার বিষয়। রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য এবং গবেষণা সম্ভার পাঠ কোনো মানুষের পক্ষেই মনে হয় এক জীবনে সম্পূর্ণ করা অসম্ভব। লেখক : কবি ও শিক্ষাবিদ, ঊ-সধরষ : শধৎরসৎবুধ৯@মসধরষ.পড়স