মঙ্গলবার   ২৬ নভেম্বর ২০২৪   অগ্রাহায়ণ ১১ ১৪৩১

রেল কর্তৃপক্ষের টনক নড়বে কবে?

তুষার আহমেদ

প্রকাশিত: ২৫ আগস্ট ২০২১  

# ১৮ কিলোমিটারের রেলপথ যেন মৃত্যুফাঁদ


# অবৈধ লেভেল ক্রসিংয়ে একেরপর এক মৃত্যু


# মানুষ মনগড়া লেভেল ক্রসিং বানিয়েছে : রেলওয়ে পুলিশ


 
নানা দুর্ঘটনার পরও অরক্ষিত রয়েছে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রেলপথের অধিকাংশ লেভেল ক্রসিং। এসব অরক্ষিত লেভেল ক্রসিংগুলোতে মৃত্যু যেন ওঁৎ পেতে থাকে প্রতিনিয়তই। নারায়ণগঞ্জে এমন ক্রসিংয়ের সংখ্যা নেহাত কম নয়। অরক্ষিত থাকছে নারায়ণগঞ্জ রেলপথের গুরুত্বপূর্ণ লেভেল বা রেল ক্রসিংগুলো। এসব স্থানে দুর্ঘটনা প্রতিরোধে প্রতিবন্ধক ও গেটম্যান নিয়োগ না করায় ঘটে চলেছে একেরপর এক ভয়াবহ দুর্ঘটনা। এর পরও টনক নড়ছে না রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের।

 


সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জ শহরের গলাচিপা কলেজ রোড সুগন্ধা বেকারীর মোড়ের অরক্ষিত লেভেল ক্রসিংয়ের সামনে ট্রেনে কাটা পড়ে এক জনের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়। নারায়ণগঞ্জ রেলওয়ে পুলিশের উপ-পরিদর্শক মোখলেছুর রহমান জানিয়েছেন, ‘কলেজ রোড সুগন্ধা বেকারীর মোড়ের ওই লেভেল ক্রসিংটি সরকারের ইস্যুকৃত নয়। অর্থাৎ অবৈধ।’ তিনি জানান, ‘ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রেলপথে বৈধ বা সরকারের ইস্যুকৃত লেভেল ক্রসিংয়ের সংখ্যা ৭ থেকে ৮টি। তবে, অবৈধ লেভেল ক্রসিংয়ের সংখ্যা অন্তত অর্ধশত, যা বৈধর তুলনায় অন্তত পাঁচ গুণ বেশি। যদিও অবৈধ লেভেল ক্রসিংয়ের বিষয়ে নির্দিষ্ট কোন তথ্য রেলওয়ে পুলিশের কাছে নেই বলে জানিয়েছেন তিনি। তার মতে, এই বিষয়গুলো দেখভাল করে থাকে সংশ্লিষ্ট স্টেশন মাস্টার।’

 


এদিকে স্টেশন মাস্টারগণ বলছেন, ‘লেভেল ক্রসিংয়ের বিষয়টি আগে তাদের সাথে সংযুক্ত থাকলেও বর্তমানে ডাবল রেল লাইন প্রকল্পের কাজ চলমান থাকায় বিষয়টি আপাতত তারা তদারকি করছেন না। কেবল বৈধ লেভেল ক্রসিংয়ের দায়িত্বে থাকা গেইটম্যানের বেতন প্রদানের কাজ করছেন তারা। তবে, বৈধ-অবৈধ রেল ক্রসিংয়ে যেই দূর্ঘটনা ঘটছে প্রতিনিয়ত, এর দ্বায়ভার রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ এড়াতে পারে কিনা- সেই প্রশ্ন থেকেই যায়।’

 


অন্যদিকে, নারায়ণগঞ্জ রেলওয়ে পুলিশ বলছে, ‘ডাবল রেলওয়ের প্রকল্পের কাজ চায়না প্রকৌশলীদের কাছে বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে। কাজ করার ক্ষেত্রে বর্তমানে লেভেল ক্রসিংগুলোর কোন নির্দিষ্টতা নেই। বর্তমানে মানুষ তাদের চলাচলের সুবিধার্থে বিভিন্ন স্থানে মনগড়া ভাবে লেভেল ক্রসিং বানিয়ে ফেলেছে। মূলত রেললাইনের দু’পাশে থাকবে তারকাটার বেড়া। এগুলো বাস্তবায়নের জন্য প্রকল্পের কাজ চলমান আছে।’

 


সূত্র জানায়, চলতি বছরের শুরুর দিকে ফতুল্লার পাগলা নন্দলালপুর এলাকায় নারায়ণগঞ্জ মুখি দ্রুতগ্রামী ট্রেনের ধাক্কায় দুমড়ে-মুচড়ে যায় সেনাবাহিনীর ডিএনডি প্রজেক্টের একটি প্রাইভেটকার (ঢাকা মেট্রো-চ-১৯-৯১১১)। এতে গুরুতর আহত হয় প্রাইভেটকারের চালক আব্দুল জলিল (২৮)। রেলপুলিশ বলছে, ওই স্থানটিও সরকারের ইস্যুকৃত কোন লেভেল ক্রসিং নয়।

 


খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পাগলা নন্দলালপুর এলাকার ওই লেভেল ক্রসিংটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ন এবং দূর্ঘটনা প্রবণ। গত বছরের ১৯ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় একই স্থানে দ্রুতগামি ট্রেনের সঙ্গে কাঠ বোঝাই একটি ট্রাকের সংঘর্ষ হয়। এতে ট্রেনের ইঞ্জিন বডি ও ট্রাক উভয়ই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অল্পের জন্য রক্ষা পায় উভয় গাড়ির চালক। একই স্থানে ২০১১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারী সকাল ৯টা ৪০ মিনিটে চলন্ত ট্রেনের সাথে একটি ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এতে তিনজন নিহত এবং নারী ও শিশুসহ অর্ধশতাধিক ব্যক্তি আহত হয়েছিলেন।

 

এছাড়া, ২০১৭ সালের ২২ জানুয়ারী রাত সাতে ১১টার দিকে ফতুল্লার শাহ-জাহান রোলিং মিল এলাকার অবৈধ লেভেল ক্রসিংয়ে ট্রেনের ধাক্কায় পাথরবোঝাই একটি ট্রাক দুমড়ে-মুচড়ে যায়। এতে ট্রাক চালক, হেলপাড় ও লেবারসহ মোট চারজন গুরুতর আহত হয়। এরআগে ২০১৫ সালের ২২ জুন সোমবার রাত সাড়ে ১০ টার দিকে পাগলার রসুলপুর ভাঙারপুল এলাকায় ট্রেনের সাথে যাত্রীবাহি লেগুনার মুখোমুখি সংঘর্ষে ৫জন নিহত হয়। গুরুতর আহত আরো ১০জন। একটি দিয়াশলাই তৈরির কারখানা সংলগ্ন রেলক্রসিং এ এই দুর্ঘটনা ঘটেছিলো। এ ঘটনায় পাগলা এলাকায় শোকের ছায়া নেমে আসে।

 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এসকল দূর্ঘটনাকালে কোন স্থানেই লেভেল ক্রসিংয়ে নিরাপত্তা ছিলো না। ছিলো না রেলগেইট, গেইটম্যান বা অন্যান্য নিরাপত্তা ব্যবস্থাও। একাধিক দূর্ঘটনার পরও সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিরা এসব স্থানে কার্যকরি নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিচ্ছে না। রেলওয়ে কর্র্তৃপক্ষের এমন উদাসীনতার ফলে ঘটে চলেছে একের পর এক ভয়াবহ দূর্ঘটনা। ফলে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। তথ্য সূত্রে জানা গেছে, কমলাপুর থেকে নারায়ণগঞ্জ পথের দুরত্ব ১৮ কিলোমিটার। এই আঠারো কিলোমিটারের মধ্যে রেল ক্রসিংয়ের সংখ্যা প্রায় ৬৩টি। এর মধ্যে ৫০টিরও বেশি অবৈধ লেভেল ক্রসিং রয়েছে ! বৈধ-অবৈধ সবগুলোতেই ঘটছে দূর্ঘটনা।

 

অভিযোগ রয়েছে, নিজেদের সুবিধার্থে প্রভাবশালীরা অবৈধভাবে লেভেল ক্রসিং নির্মাণে বিশেষ ভূমিকা পালন করছে। এসব লেভেল ক্রসিংয়ে গেট নির্মাণ এবং তিনজন নিরাপত্তাকর্মী নিয়োগের খরচ বহন করার নিয়ম থাকলেও তাও মানা হচ্ছে না। অরক্ষিত লেভেল ক্রসিংগুলো নিয়মিত পরিদর্শনের নিয়ম থাকলেও দায়িত্বে অবহেলা করছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। ফলে নারায়ণগঞ্জে ঘটে চলেছে একেরপর এক দূর্ঘটনা। প্রশ্ন উঠেছে, আর কত দূর্ঘটনার পর টনক নড়বে রেলকর্তৃপক্ষের!
 

এই বিভাগের আরো খবর