মঙ্গলবার   ২৬ নভেম্বর ২০২৪   অগ্রাহায়ণ ১২ ১৪৩১

লক্ষ্যা রক্ষায় লক্ষ্য নেই কারো

লতিফ রানা

প্রকাশিত: ১৭ এপ্রিল ২০২১  

শীতলক্ষ্যা শুধু নারায়ণগঞ্জের নয়, পুরো বাংলাদেশেরই প্রাণ ছিল এক সময়। এর বুক চিড়ে বিভিন্ন ব্যবসা-বাণিজ্য হওয়ায় এবং বিভিন্ন বাণিজ্যিক কেন্দ্র গড়ে উঠায় নারায়ণগঞ্জকে এক সময় প্রাচ্যের ড্যান্ডি বলা হতো।

সে সময় দেশ বিদেশের মানুষ এখানে বাণিজ্যিক কারণে আসলেও শীতলক্ষ্যার টলমলে পানি, নদীর গর্ভ থেকে আসা প্রাকৃতিক নির্মল ও বিশুদ্ধ বাতাসে বিমোহিত হয়ে পড়তেন। এই শীতলক্ষ্যার টানেই হয়তো তারা বারেবার এখানে ফিরে আসতেন।


 
ছোটবেলা দাদা-দাদীদের মুখে শুনতাম কারো শারিরীক কোন অসুস্থতা থাকলে তাকে বলা হতো শীতলক্ষ্যা নদী থেকে ডুব দিয়ে আসতে। তখনকার মানুষের মনে একটা ধারণা ছিল, শীতলক্ষ্যা নদীর পানি এতটাই স্বচ্ছ, এতটাই পবিত্র যে, শীতলক্ষ্যা নদীতে কেউ একবার ডুব দিয়ে গোসল করলে তার রোগ-বালাই চলে যায়। অথচ কালের বিবর্তনে সেই শীতলক্ষ্যার এখন এমন অবস্থা যে, কেই গোসল তো দুরের কথা তার সামনে গেলেই এখন মানুষ অসুস্থ্য হয়ে পড়ে। শিল্প উন্নয়নের ফাঁদে আটকে লক্ষ্যা তার রূপ ও সৌন্দর্য্য হারিয়ে জরাজীর্ণে পরিণত হয়েছে। এই লক্ষ্যাকে রক্ষা করার দায়িত্ব নিতে কেউ ত্রাতা হয়ে এগিয়ে আসছে না। শীতলক্ষ্যা নদীকে অনেকটা আদর করেই বলা হয় লক্ষ্যা। আর এই লক্ষ্যাকে কেন্দ্র করে বই পুস্তকে লেখা আছে অনেক লেখা অনেক গল্প।


 
এক সময় দেখা যেত এই নদীতে প্রচুর পরিমানে শুশুক মাছের লাফালাফি। নৌকা দিয়ে নদী পারাপারের সময় এই দৃশ্য দেখে যাত্রীদের মনে একধরণের পুলক অনুভব হতো। এখন সেই শুশুক মাছের কোন অস্তিত্বই নাই। শুশুক মাছ কেন! কোন মাছই এখন আর এই লক্ষ্যা নদীতে বাঁচতে পারে না। আধুনিকতা ও কল-কারখানার যুগে শিল্পাঞ্চল খ্যাত এই নারায়ণগঞ্জসহ নরসিংদী, টঙ্গী ও গাজীপুর এলাকার নীটিং ও ডায়িংসহ মিল-কারখানার কেমিক্যালের বর্জ্যে বিষাক্ত হয়ে গেছে পুরো শীতলক্ষ্যা নদীর পানি।


 
প্রতিবছর ভরা মৌসুমে নদীর মাঝখানে জেলেদের মেলা বসতো। এই নদীকে কেন্দ্র করে নদীর পাশের বিভিন্ন এলাকায় গড়ে উঠেছে জেলে পাড়া। এখনো জেলেপাড়া নামটা থাকলেও তার ইতিহাস এখনকার প্রজন্মের কতজন জানে? মাছ ধরার জন্য নদীর মাঝখানে গ্রাফি (নদীর মাঝে নৌকা আটকানোর একধরণের বিশেষ নোঙ্গর) ফেলে তারা সারিবদ্ধভাবে নৌকা গুলি রাখতো। রাতে জাহাজ চলাচলের দূর্ঘটনা এড়াতে হারিকেন জ্বালিয়ে রাখতো। জাহাজগুলো দুর থেকে সারি-সারি আলো দেখে বুঝতে পারতো এখানে মাছ ধরার নৌকা আছে। নৌকা দিয়ে নদীর খেয়াঘাটগুলো দিয়ে পারাপার করা যাত্রীগণের এমন অপরূপ প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখার সৌভাগ্য আর হয় না। সে সময় নদীর উপর দিয়ে পাল তোলা নৌকার সারি, কত নৌকার মাঝি পাল তুলে নৌকার হাল ধরে মনের আবেগ মিশিয়ে ভাটিয়ালী গানে নদীর পারের মানুষের মাঝে আনন্দের খোরাক দিয়েছেন। এসব দৃশ্য দেখে কত কবি আপ্লুত হয়ে কাব্য লিখে তার কবিতার খাতা ভরেছেন। তখনকার নদীতে নৌকার দুলুনি মানুষের মনে ভয় না আনন্দের সৃষ্টি করতো। আর সেই নদীর বুক ছিদ্র করে চলছে এখন বালুবাহী জাহাজের বহর। বাল্ক হেডের অবাধ চলাচলের কারণে এখন ঝুঁকি নিয়ে মানুষজনকে বিভিন্ন ঘাট দিয়ে নৌকা পারাপার হতে হয়।


 
শীতলক্ষ্যার স্বচ্ছল পানি দূষিত ও বিষাক্ত করতেই যেন নদীর উভয় পাশে গড়ে উঠেছে সিমেন্ট ফ্যাক্টরীগুলো। যার রাসায়নিক বর্জ্য ড্রেনেজ করে ফেলা হচেছ লক্ষ্যার বুকে। এর প্রভাবে আশেপাশের পরিবেশে পড়ছে দীর্ঘস্থায়ী বিরুপ প্রভাব। তৎসংলগ্ন এলাকায় যারা বাস করছে তাদের মধ্যে সৃষ্টি হচ্ছে শারিরীক সমস্যা। এমনকি সেখানকার পরিবেশ বিষাক্ত হয়ে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে গাছাপালার বেড়ে উঠা। শুকিয়ে যাচ্ছে গাছের ফলফলাদি। তাছাড়া গার্মেন্টস ফ্যক্টরীর জন্য কাপড় তৈরী করতে গড়ে উঠা নীটিং ও ডায়িং করখানাগুলো সরকারের নিয়মকানুন তোয়াক্কা না করে কেমিক্যাল মিশ্রিত বর্জ নির্বিঘ্নে ফেলছে এই শীতলক্ষ্যার বুকে। তাতে এখন আর শীতলক্ষ্যার পানির সেই টলমলে রূপ আর নেই। পরিণত হয়েছে কালো রঙের গাদে যা অনেকটা আলকাতরার মতো দেখতে।


 
এখন আবার মরার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে লক্ষ্যা নদীতে ফেলা হচ্ছে সিটি করপোরেশনের পয়:নিষ্কাশনের ময়লা। নদীর পূর্ব ও পশ্চিম পাড়ে তাও আবার নদীর যে সব জায়গায় মানুষের চলাচল আছে (নদী বন্দর বা ঘাট) এমন জায়গায়। যার ফলে নদীর পানি দূষিত হচ্ছে, মানুষের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাচ্ছে, মানুষ হচ্ছে দুর্বল ও শারীরিকভাবে অসুস্থ।


 
কদাচিৎ দেখা যায় দু’একটা সংগঠনের ব্যনারে কিছু কিছু প্রতিবাদের ফটোশেসন হতে। তাও হাতে গুনা বছরে একবারও হবে না। এর বাইরে সত্যিকারে ভালবাসা থেকে লক্ষ্যাকে উদ্ধারে ত্রাতার ভূমিকা নিয়ে কেউ এগিয়ে আসছে না। নদীমাতৃক বাংলাদেশ নামক এই রূপসী বাংলার প্রিয় এই অঙ্গটিকে রক্ষার লক্ষ্যে দরকার শক্ত ভূমিকা, দরকার প্রশাসনের জোরালো উদ্যোগ।
 

এই বিভাগের আরো খবর