মঙ্গলবার   ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪   অগ্রাহায়ণ ১৯ ১৪৩১

সংস্কারের অভাবে বিলীন হয়ে যাচ্ছে ক্রোড়িবাড়ি টাঁকশাল

যুগের চিন্তা অনলাইন

প্রকাশিত: ২১ সেপ্টেম্বর ২০২১  

প্রাচীন বাংলার রাজধানীখ্যাত ঐতিহাসিক সোনারগাঁয়ের এক সময়ের বিত্ত-বৈভব আর জৌলুসের তুলনা নেই। কালের অতল গহবরে অনেক আগেই এ প্রাচীন নগরীর পতন ঘটেছে। প্রাচীন নগরীর ভগ্ন ইমারতগুলো এখনও পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণ। সোনারগাঁ প্রাচীন বাংলার রাজধানী থাকাকালীন এক সমৃদ্ধ নগরী হিসেবে বিশ্ববাসীর কাছে বেশ পরিচিত ছিল।

 

সমৃদ্ধ এ নগরী ব্যবসা-বাণিজ্য, অর্থনীতি ও রাজনৈতিক দিক দিয়ে ছিল স্বয়ংসম্পুর্ণ। এ নগরীতে ছিল বেশ কয়েকটি মুদ্রার প্রচলনও। প্রচলীত এ মুদ্রাগুলো তৈরি হতো তৎকালীন রাজধানী সোনারগাঁয়ের নিজস্ব টাঁকশালে। সোনারগাঁয়ে এ পর্যন্ত দুটি টাঁকশালের সন্ধান পাওয়া গেছে। সোনারগাঁয়ের জামপুর ইউনিয়নে মহজমপুর এলাকায় ছিল সুলতানি আমলের টাঁকশালটি। দুটি টাঁকশালের মধ্যে মহজমপুরের টাঁকশালটি ইতিমধ্যে অনেকটা বিলীন হয়ে গেছে।

 


মহজমপুরের টাঁকশাল সোনারগাঁয়ের বর্তমান জামপুর ইউনিয়নের মহজমপুরে ১৬৬০ শতকে সুলতানি শাসনের শেষ দিকে শাহী লঙারের মসজিদ ও এতিমখানা ছিল। এখনো মসজিদটি রয়েছে। ওই আমলেই মহজমপুরে টাঁকশালটি ছিল। শাহী বংশের শাসনামলে ওই টাঁকশালে অনেক মুদ্রা মুদ্রিত হতো। সোনারগাঁয়ে ইলিয়াছ শাহী বংশের শাসন আমল শুরু হয় ১৩৫৩ খ্রিস্টাব্দে। শামসুদ্দিন ইলিয়াছ শাহ ছিলেন এ বংশের প্রথম শাসক। ইলিয়াছ শাহী আমলের অন্যতম শাসক ছিলেন সুলতান গিয়াসউদ্দিন আযম শাহ। তার আমলেই সোনারগাঁয়ে স্বাধীন ভাবে নিজস্ব মুদ্রার প্রচলন ঘটে।

 


আমিনপুরের ক্রোড়িবাড়ী টাঁকশাল সোনারগাঁয়ের ঐতিহাসিক পানাম নগরের কাছে অপুর্ব স্থাপত্যশৈলীর এক অন্যতম নিদর্শন হচ্ছে ক্রোড়িবাড়ীর টাঁকশাল। প্রায় চার শতাব্দীর পুরনো টাঁকশালটি এখন পরিত্যক্ত একটি ভবন। গৌড়ীয় দোচালা স্থাপত্য রীতিতে তৈরি এ টাঁকশালটির চারদিকে রয়েছে পাতলা জাফরি ইটের উচু দেয়াল, যা দেখলেই অনুমান করা যায় এ স্থানটি তৎকালীন সময়ে একটি সংরক্ষিত এলাকা ছিল। টাঁকশালটির উত্তরে রয়েছে বিশাল দীঘি। এক সময় দীঘির চারদিকে প্রকান্ড আকারের শান বাঁধানো ঘাট ছিল। বর্তমানে ঘাটের কোন অস্থিত্ব নেই।

 

তবে দীঘিটি আগের মতোই রয়েছে। স্থানীয়রা আমিন পুরের এ টাঁকশালটিকে ক্রোড়িবাড়ী বলে থাকে। মোগল সম্রাট আকবরের সময়ে পরগনার রাজস্ব অধিকর্তা ও রাজস্ব সংগ্রাহকের পদবি ছিল ক্রোড়ি। তিনি ১৫৭৪ খ্রিস্টাব্দে ১৮২ জন ক্রোড়ি নিয়োগ করেছিলেন আর্থিক কাজের জন্য। ধারণা করা হয় , সে থেকেই এ বাড়রি নাম হয় ক্রোড়ি বাড়ী। সুরম্য এ টাঁকশালটির স্থাপত্যকলা বেশ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। মুসলিম এবং হিন্দু স্থাপত্যের অপূর্ব সংমিশ্রণে এ টাঁকশালটি তৈরি করা হয়েছিল। টাকশালের দেয়ালে রয়েছে লতাপাতা সহ নানা ধরনের অলঙ্করণ। রয়েছে ঢেউ খেলানো খিলান, খিলানের মাথায় রয়েছে বাজপাখি ও পদ্ধপাখির খোদাই করা প্রতিকৃতি। ভগ্নপ্রায় ইমারতে রয়েছে অসংখ্য খুপরি ও কুঠরি। ভূগর্ভস্থ কুঠরিগুলোতে সরকারি মুদ্রা ও সোনার মোহর রাখা হতো বলে ধারণা করা হয়।

 

ঐতিহাসিকদের মতে সম্রাট আকবর ও শেরশাহের আমলে এ ভবনটি ছিল ট্রেজারার হাউজ। সম্রাট শেরশাহের আমলে এ অঞ্চলে ব্যাপকভাবে অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটেছিল। সম্রাট শের শাহের আমলে প্রচলিত মুদ্রাগুলো ক্রোড়িবাড়ী টাঁকশালে মুদ্রিত হতো। ঐতিহাসিক স্বরূপ চন্দ্র রায় সূবর্ণগ্রামের ইতিহাস গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন সামসুদ্দিন আবুল মুজাফফর শাহের নামাঙ্কিত মুদ্রা সোনারগাঁয়ে মুদ্রিত হয়েছিল। তাছাড়া ঐতিহাসিক ব্রাডলি বার্ট তার বিখ্যাত গ্রন্থে রোমান্স অব অ্যান ইস্টান ক্যাপিটালে’ ক্রোড়িবাড়ীর নাম উল্লেখ করেছেন। দুটি টাঁকশালের মধ্যে একটি বিলিন হয়ে  গেলেও জরাজীর্ণ ভাবে দাড়িয়ে আছে ক্রোড়িবাড়ী টাকশালটি। এটি সংস্কারে সরকারিভাবে নেওয়া হয়নি কোন পদক্ষেপ।  সোনারগাঁয়ের ইতিহাসের সঙ্গে এ টাঁকশালটির ইতিহাসও জড়িয়ে আছে।

 


সোনারগাঁ উপজেলা প্রেসক্লাবের সভাপতি আসাদুজ্জামান নুর বলেন, সোনারগাঁয়ে ইতিহাস-ঐতিহ্যের নিদর্শন দুটি টাঁকশালের মধ্যে একটি অনেক আগেই অযত্নে অবহেলায় ধ্বংস হয়ে গেছে। ক্রোড়িবাড়ি টাঁকশালটি সংস্কার করে ধবংসের হাত থেকে রক্ষা করা উচিত।

 


সোনারগাঁ উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) গোলাম মোস্তফা মুন্না জানান, প্রাচীন বাংলার ঐতিহ্য টাঁকশালটি সংস্কারের জন্য ইতিমধ্যেই মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে। পুনরায় সংস্কার করে টাঁকশালটি দেখার জন্য পর্যটকদের জন্য আকর্ষণীয় করে তোলা হবে।

 

নারায়ণগঞ্জ-৩ সোনারগাঁ আসনের সাংসদ লিয়াকত হোসেন খোকা বলেন, সোনারগাঁয়ের পুরাতন ঐতিহ্যের টাঁকশালটিকে সংস্কার করার জন্য মন্ত্রণালয়ে ডিও লেটার দেওয়া হয়েছে। অনুমতি পেলেই সংস্কারের কাজ শুরু করা হবে।

এই বিভাগের আরো খবর