রোববার   ২৪ নভেম্বর ২০২৪   অগ্রাহায়ণ ১০ ১৪৩১

২০১৮ সালে জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশ নিয়ে ভাবনা

প্রকাশিত: ১ মে ২০১৮   আপডেট: ৩ মে ২০১৮

রবার্ট ফিটজরয় (Robert Fitzroy), ডারউইনকে বহনকারী বিগল জাহাজের কাপ্তান ও যুক্তরাজ্য আবহাওয়া অফিসের প্রতিষ্ঠাতা, ১৮৫৯ সালে দ্য টাইমস পত্রিকায় লেখা এক প্রবন্ধে উল্লেখ করেন, ‘মানুষ বায়ুর ক্ষিপ্রতাকে নিষ্ক্রিয় করতে পারে না; কিন্তু এর গতিবিধি সম্পর্কে পূর্বাভাস দিতে পারে।

সে ঝড়কে শান্ত করতে পারে না; কিন্তু তার প্রচণ্ডতাকে এড়িয়ে যেতে পারে।’ ফিটজরয় ১৫০ বছরের বেশি সময় আগে আবহাওয়ার পূর্বাভাস দেওয়ার ব্যবস্থা ইংল্যান্ডে চালু করেছিলেন। কারণ তিনি মনে করতেন, এই ব্যবস্থার মাধ্যমে আবহাওয়াকে যথাযথভাবে ব্যবস্থাপনা এবং এর ক্ষতিকর প্রভাবকে কমিয়ে আনা সম্ভব। জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কে এ ধরনের পূর্বাভাস প্রদান অভিযোজন প্রক্রিয়ায় সহায়ক হবে বলে মনে করি।

২০১৭ সালের শেষে আমরা লক্ষ করি জীবাশ্ম জ্বালানি ও শিল্প-কারখানা থেকে নিঃসরিত কার্বন ডাই-অক্সাইড পূর্ববর্তী তিন বছরের তুলনায় ২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। গত ১৩ নভেম্বর ২০১৭ সালের নেচার পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে যুক্তরাজ্যের টিনডেল সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ রিসার্চের পরিচালক উল্লেখ করেন, ‘Global carbon dioxide emission appears to be going up strongly once again after three years stable period. This is very disappointing’. গ্লোবাল কার্বন প্রকল্পের প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০০০ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ প্রতিবছর বৃদ্ধি পায় ৩ শতাংশ হারে। ২০১৩ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণের পরিমাণ ছিল ০.৪ শতাংশ।

অন্যদিকে কার্বন ডাই-অক্সাইড বৈশ্বিক উষ্ণায়নের জন্য দায়ী নয় মর্মে যাঁরা দাবি করেন, তাঁদের দুটি যুক্তি এরূপ—বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ ০.০৪ শতাংশ। সুতরাং বায়ুমণ্ডলে এর প্রভাব অত্যন্ত কম। দ্বিতীয়ত, বায়ুমণ্ডলে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ বেশি এবং জলীয় বাষ্প কার্বন ডাই-অক্সাইডের তুলনায় শক্তিশালী গ্রিনহাউস গ্যাস। এই দুটি যুক্তির বিপরীতে বিজ্ঞানীরা যে তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করেন, তা হচ্ছে এই যে কার্বন ডাই-অক্সাইড নিম্ন তাপমাত্রার অবস্থায়ও অবলোহিত রশ্মিকে শোষণ করতে পারে এবং বায়ুমণ্ডলকে উষ্ণ করতে সক্ষম। ১৮৯৬ সালে সুইডিশ রসায়নবিদ সভান্তে অ্যারেনিউস (Savante Arrhenius) দেখান যে বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ দ্বিগুণ করা হলে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায় ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। পরবর্তী বিতর্কিত প্রশ্ন হচ্ছে, বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইডের বৃদ্ধি কি মানুষের কর্মকাণ্ডের ফলে ঘটেছে, না এটি প্রাকৃতিক কারণ? যেমন—আগ্নেয়গিরি থেকে নির্গত কার্বন ডাই-অক্সাইড। গ্লোবাল কার্বন প্রকল্পের প্রতিবেদন অনুযায়ী মানুষের কর্মকাণ্ডের ফলে নিঃসরিত কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ আগ্নেয়গিরি থেকে প্রাকৃতিকভাবে নির্গত কার্বন ডাই-অক্সাইডের চেয়ে অনেক বেশি। প্রাকৃতিকভাবে নির্গত কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ প্রাকৃতিকভাবে শোষিত কার্বন ডাই-অক্সাইডের প্রায় সমপরিমাণ। সুতরাং অবশিষ্ট নিঃসরণ মানুষের কর্মকাণ্ডের ফলে। জলীয় বাষ্প সম্পর্কে যে বিতর্ক, সে সম্পর্কে বিজ্ঞানীদের যুক্তি হচ্ছে যে এই কার্বন ডাই-অক্সাইড অবলোহিত রশ্মির যে অংশকে শোষণ করে, জলীয় বাষ্প তা করে না। তা ছাড়া তাপমাত্রা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বেশি পরিমাণ জলীয় বাষ্প বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করে; যদিও জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে জলীয় বাষ্পের প্রভাব কী, তা নিয়ে এখনো গবেষণা চলছে; কিন্তু আইপিসিসির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় যে জলীয় বাষ্পের কারণে গ্রিনহাউস গ্যাসের প্রভাব দ্বিগুণ বৃদ্ধি পায়। উল্লেখ্য, সিলভার ও ডেক্সিস তাঁদের গ্রন্থ One Earth, on Future : Our Changing global environment-এ প্রায় দুই যুগ আগে উল্লেখ করেন যে জলীয় বাষ্পের পর কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাসই প্রকৃতিতে বেশি পাওয়া যায়। জীবাশ্ম জ্বালানি দহনের ফলে কার্বন জারিত হয়ে কার্বন ডাই-অক্সাইড তৈরি হয় এবং বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করে। তা ছাড়া বনজঙ্গল ধ্বংস করা বা পোড়ানোর ফলে অথবা সেগুলো পচে গিয়েও বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরিত হয়। সিলভার ও ডেক্সিসের হিসাব অনুযায়ী মানুষের কর্মকাণ্ডের ফলে বায়ুমণ্ডলে বছরে ৬০০ কোটি টন কার্বন প্রবেশ করে। এই পরিমাণের সঙ্গে বায়ুমণ্ডলে সঞ্চিত কার্বন ডাই-অক্সাইডের তুলনা করে দেখা গেছে যে বায়ুমণ্ডলে প্রবিষ্ট মোট কার্বনের অর্ধেক প্রাকৃতিকভাবে যেমন—সমুদ্র ও উদ্ভিদকুল দ্বারা শোষিত হয় এবং বাকি অর্ধেক বায়ুমণ্ডলে থেকে যায়। সুতরাং যেভাবেই আমরা দেখি না কেন, কার্বন ডাই-অক্সাইড একটি শক্তিশালী গ্রিনহাউস গ্যাস। এ বিষয়ে আমাদের জানা প্রয়োজন বৈশ্বিক কার্বন বাজেটের পরিমাণ। গত ২২ ডিসেম্বর ২০১৭ সালে সায়েন্স জার্নালে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ইউরোপে শরণার্থীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাবে। এই প্রতিবেদনে আরো উল্লেখ করা হয় যে যেসব দেশের গড় তামপাত্রা তুলনামূলকভাবে বেশি এবং বহু ধরনের শস্য উৎপাদিত হয়, সেসব দেশ থেকেই শরণার্থী ইউরোপে প্রবেশ করবে বেশি। জলবায়ুসংক্রান্ত আর্থিক মডেলে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দ্বন্দ্ব-সংঘাতকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত শরণার্থী ব্যবস্থাপনার জন্য বিভিন্ন দেশে নতুন প্রতিষ্ঠান স্থাপনের চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। ইংল্যান্ডের নেচার পত্রিকায় প্রকাশিত এক গবেষণাপত্র থেকে জানা যায়, জলবায়ুর প্রভাবজনিত মডেলে সামাজিক বৈষম্যের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত নেই। এর ফলে জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাব দারিদ্র্যসীমার নিচের জনগোষ্ঠীর ওপর কিভাবে পড়বে এবং এ ক্ষেত্রে পরাকৌশল কী হবে সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা পাওয়া যায় না। তাই ২০১৮ সালে এ বিষয়ে আরো অগ্রগতি আশা করা যায়। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে আবহাওয়ার পরিবর্তন হওয়ার বিষয় সম্পর্কে অনেক গবেষণা হয়েছে। আমরা জানি জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে বন্যা, খরা, তাপপ্রবাহ, শৈত্যপ্রবাহ, ঝড় বা অত্যধিক বৃষ্টিপাত ইত্যাদি সম্পৃক্ত। কিন্তু পৃথিবীর কোন অঞ্চলে কী ধরনের পরিবর্তন আবহাওয়ায় লক্ষ করা যাবে সে বিষয়ে এখনো অনেক অনিশ্চয়তা রয়েছে। আমরা ২০১৮ সালে এ বিষয়ে আরো অগ্রগতি আশা করব। ভবিষ্যদ্বাণী করা হয় যে ২০১৮ সাল এবং পরবর্তী বছরগুলোতে আমরা চরম আবহাওয়ার সম্মুখীন হব। এগুলোর মধ্যে রয়েছে অতিরিক্ত ঝড়, জলোচ্ছ্বাস, ভূমিকম্প, খরা, শৈত্যপ্রবাহ ইত্যাদি। এর কারণ হিসেবে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের সঙ্গে সঙ্গে সূর্যের সমবর্ধমান ক্রিয়াকলাপকে চিহ্নিত করা হয়েছে। সৌর পদার্থবিজ্ঞানীরা মনে করেন, সূর্যের চৌম্বকক্ষেত্র সৃষ্টির সঙ্গে সৌরকলঙ্ক (Sunspot) চক্রের সম্পৃক্ততা রয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, সৌরকলঙ্ক চক্রের পরিবর্তনের প্রভাব জলবায়ুর ওপর কিভাবে পড়বে? একটি সম্ভাবনা হচ্ছে, সৌরকলঙ্কের অনুপস্থিতি পৃথিবীতে পুরো শতাব্দীব্যাপী শৈত্যপ্রবাহের সৃষ্টি করতে পারে। পরিসংখ্যানগত ভবিষ্যদ্বাণী হচ্ছে ২০১৯ সালের শেষে বর্তমান সৌরকলঙ্কের চক্রের অবসান ঘটবে। এরপর নতুন চক্রের শুরু। কিন্তু ২০১৫ সালে নেচার পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, সৌরকলঙ্কের চৌম্বকক্ষেত্রের শক্তি বিগত ২০০০ সাল থেকে ধীরে ধীরে কমে আসছে এবং বর্তমানে এর ক্ষেত্রশক্তি সর্বনিম্ন পর্যায়ে রয়েছে। তার মানে কি এই যে আমরা বরফ যুগের দিকে আবার ধাবিত হচ্ছি? এ নিয়ে নানা জল্পনা-কল্পনা চলছে, আমরা এ বিষয়ে আরো অগ্রগতি এ বছর লক্ষ করব। জলবায়ুসংক্রান্ত ২০১৫ সালের প্যারিস চুক্তি এখন আলাপ-আলোচনার পর্যায়ে থেকে ঐকমত্য পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। আমাদের সামনে এখন মূল বাধা হচ্ছে এই চুক্তি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা। আমরা জানি যে যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমানের প্রশাসন দৃশ্যত প্যারিস চুক্তিকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে; কিন্তু গত ১৫ ডিসেম্বর ২০১৭ সালে লন্ডনের ইমপিরিয়াল কলেজ প্রদত্ত বক্তৃতায় যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট আল গোর উল্লেখ করেন যে ‘যদিও বর্তমান প্রেসিডেন্ট প্যারিস চুক্তির বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করেন। কিন্তু এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের যে কর্মকাণ্ড চলছে, তাতে প্যারিস চুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্র প্রদত্ত প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন সম্ভব হবে।’ আল গোর আরো উল্লেখ করেন যে প্রকৃতি নিজেই এখন প্ররোচনায় অংশগ্রহণকারী বা তাঁর ভাষায় ‘Persuasive participant’। যুক্তরাষ্ট্রে সাম্প্রতিককালে চরম আবহাওয়ার কয়েকটি ঘটনা তার প্রমাণ। আমাদের অস্তিত্বের সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সম্পৃক্ত। সুতরাং আমরা আশা করব, পৃথিবীর জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়ে বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসী দুই দল ঐকমত্যে ফিরে আসবে এবং আগামী দিনের পরিকল্পনা প্রণয়নে সহায়ক ভূমিকা রাখবে। পোপ ফ্রান্সিস বলেছেন, ‘মানুষের হৃদয়ে যে হিংস্রতা বিরাজ করে তার প্রকাশ দেখতে পাই এই রুগ্ণ পৃথিবীর জলবায়ু এবং জীববৈচিত্র্যের মাঝে।’ মানুষ ও প্রকৃতি ভিন্ন সত্তা নয়। তাই পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করার প্রয়াস হবে ২০১৮ সাল এবং পরবর্তী বছরগুলোতে এটিই আমাদের সবার লক্ষ্য। লেখক : যুক্তরাজ্যে কর্মরত পরিবেশ-বিষয়ক অ্যাডভাইজার ও খণ্ডকালীন অধ্যাপক

এই বিভাগের আরো খবর