একুশের প্রথম প্রহরে শহীদদের রুহের মাগফেরাত কামনায় দোয়া, বিনম্র শ্রদ্ধা

যুগের চিন্তা রিপোর্ট
প্রকাশ: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম

একুশের প্রথম প্রহরে শহীদদের রুহের মাগফেরাত কামনায় দোয়া, বিনম্র শ্রদ্ধা
অমর একুশে ফেব্রুয়ারি আজ। চতুর্দিকে বেজে ওঠা ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/ আমি কি ভুলিতে পারি’ গানের সুমধুর সুর এ দিনের জানান দিচ্ছে। ১৯৫২ সালের এই দিনে মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য বুকের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত করেছিলেন এ দেশের ছাত্র-তরুণরা। সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, শফিউর, অহিউল্লাহদের এই আত্মত্যাগ পৃথিবীর ইতিহাসে অনন্য উদাহরণ। এই সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাকে তৎকালীন পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দেওয়া হয়। শুধু তাই নয়, ভাষার জন্য একটি জাতির অসাধারণ এই ভালোবাসাকে স্বীকৃতি দিয়েছে জাতিসংঘ শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক সংস্থাও (ইউনেস্কো)। ১৯৯৯ সালে এই সংস্থাটি একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা করে। এর পর থেকে বিশ্বের ১৮৮টি দেশে একযোগে যথাযোগ্য মর্যাদায় দিবসটি পালিত হচ্ছে।
অমর ভাষা শহীদদের স্মরণে শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন প্রশাসন, রাজনীতিবিদসহ সকল শ্রেণিপেশার নারায়ণগঞ্জবাসী। একুশের প্রথম প্রহরে শুরুতে চাষাঢ়া কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ভাষা শহীদদের প্রতি রুহের মাগফেরাত কামনা করে দোয়া পরিচালনা করেন জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নেতা মাওলানা মঈনুদ্দিন আহমেদ। এরপর শহীদ মিনারের বেদিতে প্রথম ধাপে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে শহীদদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা নিবেদন করেন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম মিঞা ও পুলিশ সুপার প্রত্যুষ কুমার মজুমদারসহ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। এরপর মহানগর বিএনপির আহবায়ক এড. সাখাওয়াত হোসেন খান ও সদস্য সচিব আবু আল ইউসুফ খান টিপুর নেতৃত্বে শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন বিএনপি নেতারা। এরপর ব্যবসায়ী সংগঠন, পেশাজীবী সংগঠনসহ অন্যান্য রাজনৈতিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ পুষ্পস্তবক অর্পণের মাধ্যমে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
এর আগে গতক বিকেল থেকেই ভাষা শহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে চলছে শেষ মুহুর্ত্বে প্রস্তুতি। ক্যানভাস দিয়ে লাল-সাদা-কালো রং তুলির আঁচড়ে ফুটিয়ে তোলা হচ্ছে নানা আল্পনা। এই আল্পনায় সেজেছে শহীদ মিনার, পিচঢালা সড়ক ও বিভিন্ন আশে পাশের দেয়াল। বাদ যায়নি শহীদ মিনারের গাছগুলো। গাছের ডালে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে অ-আ-ক-খ বর্ণমালা। এক কথায় বলা যায়, আল্পনায় ও বর্ণমালায় সেজে উঠে শহীদ মিনার এলাকা। এদিকে ব্যস্ত সময় পার করেন বিভিন্ন ফুল ব্যবসায়ীরা, ইতিমধ্যে নগরীতে বসেছে খন্ড খন্ড ফুলের বাজারও। গোলাপ, জবা, গাদা, রজনীগন্ধা দিয়ে তৈরি করা হচ্ছে বিভিন্ন বুকে, মালা ও ফুলের তোড়া। বিভিন্ন ব্যাক্তি-সংগঠন-প্রতিষ্ঠান থেকে পাওয়া অর্ডার সম্পূর্ন করতে হবে আজ রাতেই। সার্বিক নিরাপত্তায় বিভিন্ন মোড়ে মোড়ে দেখা গেছে পুলিশের উপস্থিতিও।
গতকাল বৃহস্পতিবার (২০ ফেব্রুয়ারি) সরজমিনে নগরজুড়ে দেখা গেছে এমন চিত্র। শহীদ মিনারের পর আল্পনায় সাজানো হয়েছে নগরীর মীর জুমলা সড়কেও। লম্বাটে দেয়াল জুড়ে আঁকা হচ্ছে ‘মোদের গৌরব মোদের আশা আ মরি বাংলা ভাষা, ৫২ থেকে ২৪, মাতৃভাষায় যাহার শ্রদ্ধা নাই সে মানুষ নহে, আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়ির তীরে’। মাতৃভাষা বাংলার ইতিহাসের সাথে ২৪শের গণঅভ্যুত্থানও স্থান পেয়েছে এই দেয়াল গুলোতে। শিল্পিদের এই কারুশিল্প দেখতে ভীর করছেন অনেকেই। শখের বসে কেউ ছবি তুলে সাক্ষী হতে চাইছেন, কেউবা হাতে রং মেখে নিয়ে দেয়ালে ছাপ দিচ্ছেন। নানা রঙে, নানা ধরনের ফুল দিয়ে ভরে গেছে দোকানগুলো। ছোট বড় মাঝারি বিভিন্ন ধরনের ডালা,বুকে বানিয়ে ইতি মধ্যে বিক্রিও করছেন ব্যবসায়ীরা। পরিবারের ছোট বড় সদস্যদের নিয়ে এমন প্রস্তুতি দেখতে ভীর জমাচ্ছেন অনেকেই।
শিল্পীরা বলেন, ভাষা আন্দোলন দেখার সুযোগ না হলেও ভাষা শহিদদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর এ আয়োজনে অংশ নিতে পেরে আমরা গর্বিত। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস শহীদদের রক্ত রাঙা ইতিহাস। এই দিন সামনে রেখে আমরা আমাদের ভাষা শহীদদের প্রতি সম্মান জানিয়ে আমরা এ কাজগুলো করে যাচ্ছি। এ কাজে যুক্ত হতে পেরে সত্যিই অনেক ভালো লাগছে। আমাদের শহীদ মিনারে আল্পনা আঁকা শেষ। আমরা চেষ্টা করেছি সবকিছু নতুন করে সাজিয়ে সবাইকে একুশে উপলক্ষে উপহার দিবো। সবাই যখন শহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে আসবে তখন মিনারকে নতুন রূপে দেখতে পারবে।
ফুল ব্যবসায়ী জাকির বলেন, এবছর অন্যান্য সময়ের থেকে এখন বেচাকেনা তুলনামূলক কম। তবে এই মধ্যরাত ও ২১শে ফেব্রুয়ারীর সম্পূর্ন দিন নিয়ে আমরা কিছুটা আশাবাদী। ক্রেতাদের কাছে বছরের সব সময় এই ফুলের চাহিদা থাকে না। সারা বছর যে চাহিদা থাকে তার থেকে বছরের এ সময়ে ফুলের চাহিদা বেশি থাকে। আপাতত ফুল দিয়ে অর্ডার গুলোর কাজ শেষ করছি, আর বিক্রি করার জন্য কিছু মালা, বুকে বানিয়ে রেখেছি। অনেকেই তৈরি ডালা কিনে নিচ্ছে যায় তাই আগে থেকে কিছু বানিয়ে সাজিয়ে রাখছি। আশা করছি আমরা প্রতিবছরের মতো এইসময়টা ভালো বেচাকেনা করতে পারবো। দাম একটু বেড়েছে কারণ চাষিরা সারা বছর ছেড়ে এই সময়টার আশায় থাকে। তারাও ফুলের দাম বেশি রাখে আমাদেরও বেশি দিয়ে কিনতে হয়। তাই অন্য সময়ের তুলোনায় এবার দাম বেশি। একটি ডালা বা তোড়া তৈরিতে কমপক্ষে ৫ থেকে ৭ ধরনের ফুল দরকার। এতে গোলাপ, গাদা ছাড়াও আরও নানা ধরনের ফুলের ব্যবহার করা হয়।
সার্বিক নিরাপত্তা বিষয়ে জেলা পুলিশ সুপার প্রত্যুষ কুমার মজুমদার জানিয়েছেন, সারা নারায়ণগঞ্জ নিরাপত্তার চাদরে ঢাকা। নারায়ণগঞ্জবাসী শান্তিতে ও নিরাপত্তার সাথেই অমর একুশে শহীদদের শ্রদ্ধঅ জানাতে পারবে। আজ সকাল থেকেই পুলিশ, সাদা পোশাকের পুলিশ, র্যাব, সেনাবাহিনীসহ বিভিন্ন বাহিনী নিরাপত্তার কাজে নিয়োজিত আছে। কোন প্রকার অপ্রীতিকর ঘটন ঘটবে বলে আমরা আশা করি না।
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম মিঞা জানিয়েছেন, আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমরা কখনোই ভুলতে পারবো না। অমর একুশের উপলক্ষে শ্রদ্ধা নিবেদন, পুষ্পস্তবক অর্পণ, আলোচনা সভা, দোয়াসহ নানা কর্মসূচির আয়োজন জেলা প্রশাসন করেছে। আমরা প্রতিবার শহীদ মিনারে আল্পনা করতাম। কিন্তু এবার নগরী মীর জুমলা সড়ককে অবমুক্ত করে সেখানে একুশের আল্পনা করেছি। আমাদের এই একুশে ফেব্রুয়ারিকে বুকে ধারণ করতে হবে বাংলা ভাষার সঠিক উচ্চারণ ও ব্যবহারের মধ্য দিয়ে।