বিকেএমইএর সভাপতি পতিত স্বৈরাচারের দোসর ঝুট ব্যবসায়ী মোহাম্মদ হাতেম
বিকেএমইএর সভাপতি পতিত স্বৈরাচারের দোসর ঝুট ব্যবসায়ী মোহাম্মদ হাতেম গত ৫ আগস্ট থেকে যেসকল স্ট্যান্টবাজি করছেন একে একে সেগুলো সামনে আসা শুরু হয়েছে। হাতেম যে স্বৈরাচারের এতো বড় দোসর তা বৈষম্যবিরোধী ছাত্রআন্দোলনের নেতারা জানতো না। গত ১৯ সেপ্টেম্বর ছাত্র-জনতার বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে আহতদের চিকিৎসায় ৫০ লাখ টাকার অর্থ সহায়তা দেয় নিট শিল্প মালিকদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিকেএমইএ)। মূলত স্বৈরাচার হাসিনা, ব্যবসায়ী মাফিয়া সেলিম ওসমান এবং গডফাদার শামীম ওসমানের অন্যতম দোসর মোহাম্মদ হাতেমের নীল নকশাতেই এই অর্থ এভাবে সমন্বয়কদের হাতে তুলে দেয়া হয়। স্বৈরাচারের দোসর হাতেমের কুকীর্তির বিষয়গুলো জানার পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক সারজিস আলম মন্তব্য করেছেন, বিকেএমইএর সভাপতি যে স্বৈরাচারের দোসর এটি জানা থাকলে এই চেক তারা গ্রহণ করতেননা।
সূত্র জানিয়েছে, বিকেএমইএর ব্যবসায়ীরা চাইছিলেন, বিকেএমইএ থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আহত ও নিহতদের পরিবারেরর কাছে আর্থিক সহায়তা পৌঁছে দিতে। এজন্য তারা প্রধান উপদেষ্টার এই সংক্রান্ত তহবিলে এই অর্থ অনুদান দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। তবে গত ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকার পতনের পর ২৫ আগস্ট অসুস্থতার বাহানা তুলে পদত্যাগ করেন সেলিম ওসমান। ওই পদত্যাগপত্রেই তাদের অন্যতম দোসর ঝুট ব্যবসায়ী হাতেমকে বিকেএমইএর সভাপতি করার নির্দেশ দেন সেলিম ওসমান। এরপর থেকে সেলিম ওসমান, শামীম ওসমানের প্রেসক্রিপশনের তাদের সাম্রাজ্য এবং দোসরদের রক্ষার দায়িত্ব দেন এই ঝুট ব্যবসায়ী মোহাম্মদ হাতেমকে। আর সেই কৌশল হিসেবেই বিকেএমইএর অন্যান্য সদস্যদের মতামতকে উপেক্ষা করে সমন্বয়কদের হাতে ৫০ লাখ টাকার চেক তুলে দেয়ার নীলনকশা করেন হাতেম। যারা মূল উদ্দেশ্য ছিল, এই চেক বিতরণ নিয়ে যাতে সমন্বয়কদের সাথে হাতেমের সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটে।
ভিডিও দেখতে এখানে লিঙ্কে ক্লিক করুন
সেলিম ওসমানের সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী হাতেম সমন্বয়কদের হাতে বিকেএমইএর ৫০ লাখ টাকা অনুদানের চেক তুলে দেয়। কিন্তু বিষয়টি জানাজানির পর ব্যবসায়ী মহল, সুধীসমাজসহ সবজায়গায় তোলপাড় তৈরি হয়। চিহ্নিত স্বৈরাচারের দোসর যার হাতে এখনো ছাত্রজনতার রক্তের দাগ লেগে আছে এমন ব্যক্তির কাছ থেকে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে আহত ও নিহতদের পরিবার অনুদান নেবে এই কথা ভাবাই দায়। হাতেমের মতো চিহ্নিত স্বৈরাচারের দোসরের কাছ থেকে এমন অর্থগ্রহণকে অনেকে নেতিবাচক ভাবেই দেখছেন। তারা বলছেন, হাতেম হচ্ছে স্বৈরাচার হাসিনা, সেলিম ওসমান, শামীম ওসমান তথা ওসমান পরিবারের দোসর। তার হাতেও ছাত্র-জনতার রক্তের দাগ। শামীম ওসমান, তার ছেলে অয়ন ওসমানসহ ক্যাডার বাহিনী যেভাবে আন্দোলনের সময় গুলি চালিয়েছে তা সারাদেশে শিহরণ জাগিয়েছে। তাদের সেই সশস্ত্র মহড়ায় রিয়া গোপ নামে এক শিশু মৃত্যুর জন্য দায়ী করা হয়। আর হাতেম হচ্ছে তাদেরই প্রধান দোসর। সেলিম ওসমান শামীম ওসমানসহ গোটা ওসমান পরিবারের দোসরদের রক্ষার জন্য কাজ করছে এই হাতেম। ওসমানদের পক্ষ নিয়ে সমন্বয়কদের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নে ব্যতিব্যস্ত হাতেম।
তবে ফ্যাসিস্টদের দোসর হাতেম সম্পর্কে জানতেননা বৈষম্যবিরোধী ছাত্রআন্দোলনের নেতারা এমন একটি অডিও যুগের চিন্তার হাতে এসেছে। কিউআর কোডের মাধ্যমে আপনারা সেই বক্তব্যটি শুনতে পাবেন। যেখানে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক সারজিস আলমকে বলতে শোনা গেছে, বিকেএমইএর সভাপতির ( মোহাম্মদ হাতেমের ২২ জুলাই গণভবনে হাসিনার কাছে গিয়ে দেয়া বক্তব্য) যে ভিডিওটা ঘুরছে, এই ভিডিওটা এরআগে আমার চোখে পড়েনি। আমরা উনার কাছ থেকে আহতদের জন্য ফান্ড নিয়েছিলাম এবং উনাদের একজনকে সাথে নিয়ে ওই ফান্ড আহতদেরই দিয়ে এসেছি, সিএমএইচ, পঙ্গু এবং চক্ষুতে। তো যদি ওই মুহুর্ত্বে আগে চোখে পড়তো তাহলে আমরা কখনোই এই ফান্ডটা তখন নিতামনা সে যেই হোক না কেন। ভিডিওটি হোয়াটসঅ্যাপে চান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক সারজিস আলম।
প্রসঙ্গত, জুলাইয়ে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় যখন প্রচুর ছাত্র-জনতা মারা যাচ্ছিল। ফ্যাসিস্ট হাসিনার থাবায় রাজপথে ছাত্রজনতার রক্তের ফোয়ারা বইছিল, ১৮ জুলাই থেকে ছাত্র-জনতার রক্তের যেই স্রোত রক্ত স্রোতে বইছিল ঠিক সেই সময় ২২ জুলাই ব্যবসায়ীদের সঙ্গে ফ্যাসিস্ট হাসিনার ডাকে গণভবনে গিয়ে বক্তব্য দেন মোহাম্মদ হাতেম। তার সেই বক্তব্য এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও ভাইরাল। বিকেএমইর তৎকালীন নির্বাহী সভাপতি (বর্তমান সভাপতি) মো. হাতেম বলেন, 'এরকম একটি সঙ্কটকালে আমরা এমন সিচুয়েশন দেখবো সেটা আশা করিনি। যে তান্ডব আমরা গত কয়েক দিনে দেখেছি, আমরা আশা করব, সরকারের গোয়েন্দা সংস্থাসহ অন্য যারা আছেন, তারা তা উদ্ঘাটন করবেন এবং আইনের আওতায় আনবেন। আমরা সরকারের পাশে সবসময়ই ছিলাম, এখনো আছি, ভবিষ্যতেও থাকবো।’
ব্যবসায়ীরা জানায়, হাতেমের সাথে যে স্বৈরাচারদের সম্পর্ক শেষ এমনটি নয়। হাতেমের সাথে এখনও পালিয়ে থাকা সেলিম ওসমান এবং ওসমান পরিবারের যোগাযোগ আছে। ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, সেলিম ওসমানের পারপাস সার্ভ করছে হাতেম। সেলিম ওসমানের সময়কালে যেসকল ব্যবসায়ীদের সেলিম ওসমান নেতা বানিয়েছেন তাদের রক্ষা করার দায়িত্ব দিয়েছেন তাদের সর্বশ্রেষ্ঠ দোসর মোহাম্দ হাতেমকে। পদলেহনকারী ব্যবসায়ীরা তাই হাতেম ধরা পড়ে যাওয়ায় এখন বেশ বদল করার চেষ্টা করছেন। যার প্রমাণ পাওয়া যায় বিকেএমইএর সিনিয়র সহসভাপতি মনসুর আহমেদের কাণ্ডে। ২৫ আগস্ট যখন সেলিম ওসমান প্রেসক্রিপশন করে হাতেমকে নির্বাহী সভাপতি থেকে সভাপতি বানালো তখন কিছুটা রুষ্ঠ হন মনসুর আহমেদ। কেননা গঠনতন্ত্র অনুযায়ী সেলিম ওসমানের বর্তমানে বিকেএমইর সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট মনসুরেরই সভাপতি হওয়ার কথা। তা না করে, সেলিম ওসমান তার খুব কাছের দোসর হাতেমকে বেছে নেন। ফলে ২৮ নভেম্বর বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি মনসুর আহমেদ ও পরিচালক খুরশীদ আহমেদ তানিম পদত্যাগ করেন। পদত্যাগপত্রে তারা দুইজনই বিকেএমইএ’র সভাপতি মোহাম্মদ হাতেমকে ‘ফ্যাসিস্টের দোসর’ উল্লেখ করে বর্তমান নেতৃত্বের বিরুদ্ধে ফ্যাসিবাদী আচরণ এবং অনৈতিক কার্যক্রমের অভিযোগ তুলেছেন। ২৮ নভেম্বর) সংগঠনের নির্বাহী সভাপতি বরাবর পদত্যাগ দেন এ দুই নেতা। তাদের অভিযোগ, ‘বর্তমান সভাপতি মোহাম্মদ হাতেমের নেতৃত্বে সংগঠনের মূল্যবোধ ও নৈতিক মানদণ্ড ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তারা বলেন, ‘আমরা লক্ষ্য করেছি যে বর্তমান নেতৃত্বের অধীনে এমন কিছু কর্মকাণ্ড ঘটছে যা আমাদের আমাদের সংগঠনের মূলনীতি- ন্যায়পরায়ণতা, সততা এবং গণতান্ত্রিক চর্চাকে লঙ্ঘন করছে।”
গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে পাওয়া তথ্যের বরাতে সংগঠনের এ দুই পরিচালক বলেন, “বর্তমান সভাপতি (মো. হাতেম) এবং কিছু সিনিয়র বোর্ড সদস্যরা ফ্যাসিজমকে সহযোগিতা করেছে এবং প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জুলাই-আগস্টের গণহত্যা ও সাধারণ ছাত্র-জনগণের ওপর নির্যাতনকারী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে জড়িত ছিলেন।” তারা আগামী ৫ ডিসেম্বরে ডাকা সংগঠনের বিশেষ সাধারণ সভা (ইজিএম) ও বার্ষিক সাধারণ সভা (এজিএম) বাতিলের আহ্বান জানান। তারা আরও বলেন, “মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে এবং আমাদের বিবেকের তাড়নায়, আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে, যারা এই ফ্যাসিবাদকে সমর্থন করে, তাদের সঙ্গে আর কাজ করব না। আশ্চর্যের বিষয় এরদুই দিন পরে অদৃশ্য এক চাপে নিজের পদত্যাগপত্র প্রত্যাহার করে নেন মনসুর। তবে নিজের পদত্যাগপত্রে গোয়েন্দা সংস্থার বরাতে যে তথ্য দিয়েছেন তা ডকুমেন্ট হিসেবেই রয়ে যায়। গোয়েন্দা সংস্থার বরাতে মনসুর বলেন, “বর্তমান সভাপতি (মো. হাতেম) এবং কিছু সিনিয়র বোর্ড সদস্যরা ফ্যাসিজমকে সহযোগিতা করেছে এবং প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জুলাই-আগস্টের গণহত্যা ও সাধারণ ছাত্র-জনগণের ওপর নির্যাতনকারী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে জড়িত ছিলেন।” আর এই মনসুরই এখন চাপে তাপে হাতেমের পক্ষে জেলা প্রশাসকের কাছে ওসমান দোসর ব্যবসায়ীদের একত্রিত করে ২২ ডিসেম্বর জেলা প্রশাসকের কাছে স্মারকলিপি দেন। ফলে সেলিম ওসমান, তার দোসর ঝুট ব্যবসায়ী মোহাম্মদ হাতেম এবং ওসমানদের অন্যান্য দোসরদের নিজস্ব কার্যকলাপেই সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হাতেম ওসমানদের দোসর হিসেবে কী করতে চাইছেন।
তবে দেশের অন্যতম একটি ব্যবসায়ীক সংগঠন বিকেএমইএ’র শীর্ষ পদ থেকে ওসমান দোসর হাতেমকে অপসারণের দাবিতে ঐক্যবদ্ধ হন ব্যবসায়ীরা। ২০২৪ সালের ডিসেম্বরের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে অন্তবর্তীর্কালীন সরকারের বাণিজ্য উপদেষ্টা ও বাণিজ্য সচিব বরাবর বিকেএমইএ’র সভাপতি পদ থেকে অপসারণের দাবিতে ব্যবসায়ীদের পক্ষে স্মারকলিপি দেন প্রীতম নিটওয়্যারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবু জাফর আহমেদ এবং কেএএস নিটওয়ারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আলমগীর কবির।। ওই আবেদনে তারা উল্লেখ করেন, চিঠিতে ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করেছেন, বিগত ১৪ বছরে সেলিম ওসমান তার অনুগতদের নিয়ে বিকেএমইএর কার্যক্রম পরিচালনা করেছেন, যেখানে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার লঙ্ঘন হয়েছে। তার পদত্যাগের পরও অনুগত পর্ষদ দিয়ে মোহাম্মদ হাতেমকে সভাপতি হিসেবে বসানো হয়েছে, যা সংগঠনকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
চিঠিতে মোহাম্মদ হাতেমকে সভাপতি হিসেবে নিযুক্ত করার প্রক্রিয়াকে ব্যবসায়ীরা ‘প্রহসন’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তারা মনে করেন, হাতেমকে সভাপতি হিসেবে তৈরি করার উদ্দেশ্যে ২০২১ সালে নির্বাহী সভাপতির একটি নতুন পদ সৃষ্টি করে সেখানে তাকে বসানো হয়। বিগত আওয়ামী লীগ শাসনামলের পুরোটাই সেলিম ওসমানের অনুগত থেকে মোহাম্মদ হাতেমও পুরোপুরি ক্ষমতার সদ্ব্যবহার করেছেন বলে তারা উল্লেখ করেন।