বিকেএমইএ নির্বাচন
নির্বাচন হচ্ছে এটি প্রমাণের চেষ্টা !

যুগের চিন্তা রিপোর্ট
প্রকাশ: ২৪ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০০ এএম

বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিকেএমইএ) নির্বাচন সামনে রেখে এক অদ্ভুত দৃশ্যপট তৈরি হয়েছে। এই নির্বাচনে ‘গণতন্ত্র’ রক্ষার নামে একটি সুপরিকল্পিত নাটক মঞ্চস্থ হচ্ছে বলে গুঞ্জন উঠেছে। আর সেই নাটকের প্রধান পরিচালক হিসেবে উঠে এসেছে সংগঠনের বর্তমান সভাপতি, ঝুট ব্যবসায়ী হাতেমের নাম। অভিযোগ উঠেছে, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতার নির্বাচনের কটূ তকমা এড়াতেই তিনি দাঁড় করিয়েছেন তিনজন কথিত ‘স্বতন্ত্র’ প্রার্থী। সূত্র জানিয়েছে, এই তিন প্রার্থীর কেউই প্রকৃত বিরোধিতা করতে মাঠে নামেননি। বরং পেছন থেকে নকশা করা হয়েছে যেন নির্বাচন শুধু মাত্র নামমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার ছায়া নিয়ে সম্পন্ন হয়, যাতে সভাপতি পক্ষ বলতে পাওে “দেখুন, প্রতিযোগিতা হয়েছে, ভোট হয়েছে, সবই নিয়ম অনুযায়ী।”
কিন্তু ভিতরের খবর বলছে ভিন্ন কথা। স্বতন্ত্র বলে যাদের প্রচার করা হচ্ছে, তাদের মনোনয়নের আড়ালে আছে হাতেমের ছায়া-নির্দেশনা। মূল উদ্দেশ্য, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার বদনাম এড়ানো কিন্তু নিজের পছন্দের লোকজনই যাতে জিতে যায়, সেই ব্যাকআপ নিশ্চিত রাখা। আর এই নাটকের মঞ্চস্থের মূল নায়ক হচ্ছেন স্বৈরাচারী সরকার শেখ হাসিনার অন্যতম দোসর, নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য এ কে এম সেলিম ওসমান। এই সেলিম ওসমানের নির্দেশেই ঝুট ব্যবসায়ী হাতেম এখনো বিকেএমইএ-তে সভাপতির পদে বহাল আছেন। ব্যবসায়িক সংগঠন যেন ওসমান পরিবারের কুক্ষিগতই থাকে সেজন্য ঝুট ব্যবসায়ী হাতেমকে দিয়ে একটি পূর্ণদৈর্ঘ্য নাটক মঞ্চায়ন করে নির্বাচনের প্রস্তুতি চলছে। কেননা, ৩৫টি পদের বিপরীতে তিনজন বাদে সবই হাতেমের প্যানেলের। আর এরমধ্যে সেলিম ওসমান পর্ষদে ছিল ২০ জন।
সংগঠনের একজন ক্ষুব্ধ সদস্য বলেন, “এটা নির্বাচন না, এটা একটা সাজানো খেলা। এখানে স্বচ্ছতা নেই, নেই কোনো গণতান্ত্রিক চেতনা। শুধু একটি পক্ষকে বৈধতা দেওয়ার জন্যই এই প্রহসন!”
গণতন্ত্রের নামে এই ধরনের ছলচাতুরী প্রশ্ন তুলেছে বিকেএমইএ-র ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব ও সংগঠনের ভাবমূর্তি নিয়ে। এই ধোঁয়াশা থেকে বেরিয়ে প্রকৃত প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার দাবি উঠছে ভেতর থেকেই।
তথ্য মতে, এ নির্বাচনের ৩৫টি পরিচালক পদের জন্য লড়াই করবেন ৩৮ জন প্রার্থী। এদের মধ্যে ৩৫ জনই বর্তমান সভাপতি, জুট ব্যবসায়ী হাতেমের প্যানেলের। বাকি তিনজন স্বতন্ত্র প্রার্থী। তারা হলেন: মার্টিন নিটওয়্যার লিঃ এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক জি. এম. হায়দার আলী বাবলু, মনিরা নিট অ্যাপারেলস লি. এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মনির হোসেন শেখ, রনি নিটওয়্যার (প্রাঃ) লিঃ এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. সাজাহান আলম এদিকে, এ নির্বাচনকে ঘিরে ইতিমধ্যে ব্যালট নম্বর বরাদ্দ হয়েছে। এই ৩ জনের ব্যালট নম্বর যথাক্রমে ৩৬, ৩৭ ও ৩৮। তবে স্বতন্ত্র এই তিন প্রার্থী এ নাটকীয় নির্বাচনের ব্যাপারে একমত নন।
নির্বাচন প্রসঙ্গে মার্টিন নিটওয়্যার লি. এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক জি. এম. হায়দার আলী বাবলু যুগের চিন্তাকে জানান, “আমি বিকেএমইএ'র সাথে দীর্ঘদিন ধরে জড়িত। এর পূর্বেও বহুবার আমি এখানে পরিচালক ছিলাম। তবে মাঝখানে আমি নির্বাচন করতে পারিনি। বিকেএমইএ-তে দীর্ঘ সময় ধরে নির্বাচন হচ্ছে না। আমরা চিন্তা করলাম এখানে একটা নির্বাচন করা দরকার। তাই আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম যে আমরা নির্বাচন করব। আমরা নির্বাচন করার জন্যই নেমেছি।
সকল ভোটারদের কাছে আমাদের আবেদন, আসুন উৎসবমুখর পরিবেশে ভোট দিই। আমরা মাত্র তিনজন। আশা করি আপনারা আমাদের নির্বাচিত করবেন। নির্বাচিত হলে আমরা রপ্তানি বৃদ্ধির জন্য কাজ করব, সালিশি বোর্ড কার্যকর করব, দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হব।”
মনিরা নিট অ্যাপারেলস লিঃ এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোঃ মনির হোসেন শেখ বলেন: “বিকেএমইএ-তে দীর্ঘদিন ধরে নির্বাচন হয়নি। এবার যেন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কেউ নির্বাচিত হতে না পারে, সেজন্য আমরা তিনজন প্রার্থী হয়েছি।
বিকেএমইএ দেশের অন্যতম রপ্তানিনির্ভর সংগঠন। এখানে যদি নির্বাচন না হয়, তাহলে কোথায় হবে? ৫৭২ জন ভোটারদের কাছে আবেদন রইল—আপনারা আমাদের ভোট দিয়ে নির্বাচিত করুন। আমাদের তিনজনের কারণেই নির্বাচনটা হচ্ছে, ফলে আপনারাও মূল্যায়িত হচ্ছেন।”
রনি নিটওয়্যার (প্রা.) লি.-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোঃ সাজাহান আলম জানান, “বিকেএমইএ-তে দীর্ঘদিন ধরে নির্বাচন হয়নি। এবারও যেন কেউ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত না হয়, তাই আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি নির্বাচন করব। কারণ, একতরফা নির্বাচনে যেতে চাইনি। আমাদেরকে বলা হয়েছিল প্যানেলে যোগ দেওয়ার জন্য। কিন্তু যুক্ত হলে তো আর নির্বাচন হতো না—আমরা নির্বাচনের পক্ষে।”
উল্লেখ্য, বিকেএমইএ'তে চূড়ান্তভাবে প্রার্থী হয়েছেন ৩৮ জন। ১৯ এপ্রিল (শনিবার) বিকেলে যাচাই-বাছাই শেষে এই প্রার্থীদের চূড়ান্ত করে নির্বাচন বোর্ড। আগামী ১০ মে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনে ৩৫ জন পরিচালক নির্বাচিত হবেন। পরবর্তীতে তাঁদের মধ্য থেকেই ১ জন সভাপতি, ১ জন নির্বাহী সভাপতি ও ৭ জন সহসভাপতি নির্বাচিত হবেন। এর আগে ৯ এপ্রিল মনোনয়ন জমার শেষ দিনে মোট ৪২ জন প্রার্থী মনোনয়ন জমা দিয়েছিলেন। এর মধ্যে বর্তমান সভাপতি হাতেমের প্যানেলে ছিলেন ৩৯ জন। তবে প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ দিনে হাতেম প্যানেলের ৪ জন মনোনয়ন প্রত্যাহার করেন।
হাতেমের প্যানেল থেকে যে ৩৫ জন প্রার্থী হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে ২০ জনই সেলিম ওসমান পর্ষদের। এবার দেখা যাক, এই পূর্ণদৈর্ঘ্য নাটকের শেষাংশে কী অপেক্ষা করছে।
প্রসঙ্গত, ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে নারায়ণগঞ্জে শীর্ষ গডফাদার ওসমান পরিবার পালিয়ে গেলেও তাদের দোসররা এখনো বিভিন্ন সেক্টরে রাজত্ব করছে বলে অভিযোগ ওঠে। ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, ওসমান পরিবারের নির্দেশে নারায়ণগঞ্জ থেকে পরিচালিত দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ীক প্রতিষ্ঠানগেেুলা এখনো পরিচালিত হচ্ছে। এমনি একটি গুরুত্বপূর্ণ শীর্ষ ব্যবসায়ী সংগঠন বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিকেএমইএ)। এই সংগঠনের সভাপতি হিসেবে ২০১০ সাল থেকে বিনা নির্বাচনে দায়িত্বে ছিলেন সাবেক সাংসদ সেলিম ওসমান। তার সঙ্গে দীর্ঘ ১১ বছর ধরে সহসভাপতির দায়িত্ব পালন শেষে ২০২১ সাল থেকে নির্বাহী সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন ওসমান পরিবারের শীর্ষ সহযোগী হিসেবে পরিচিত মোহাম্মদ হাতেম। ৫ আগস্টের পর ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সেলিম ওসমান আত্মগোপনে চলে যাওয়ার পর তাঁর নির্দেশে সংগঠনের সভাপতি হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন মোহাম্মদ হাতেম। এক্ষেত্রে খোদ সেলিম ওসমান ২০২৪ সালের ২৪ আগস্ট চিঠি দিয়ে ব্যবসায়ীদের চিঠি দিয়ে সভাপতি হিসেবে হাতেমকে গ্রহণ করতে নির্দেশনা দেন। এরপর হাতেমকে ফ্যাসিস্টদের দোসর উপাধি দিয়ে ওই পর্ষদ থেকে দুজন পদত্যাগ করেন এবং পরবর্তীতে দুইদিনের মাথায় তা প্রত্যাহার করে নেন। এছাড়া ডিসেম্বরে ব্যবসায়ীদের একাংশ হাতেমের বিরুদ্ধে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব ও উপদেষ্টা বরাবর অভিযোগ দেন। এছাড়া বিকেএমইএ’র ইজিএমএ হাতেমকে নিয়ে অসন্তোষ দেখা দেয়। এসব ঘটনা প্রবাহ নিয়ে দৈনিক যুগের চিন্তায় তথ্যপ্রমাণসহ সংবাদ প্রকাশিত হলে সেলিম ওসমানের ইশারায় ব্যবসায়ীদের একটি পক্ষ যুগের চিন্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে জেলা প্রশাসকের কাছে অভিযোগ করেন। সেসময় সেসব অনুসারী ব্যবসায়ীদের মধ্যে এবারের বিকেএমইএ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে অংশগ্রহণকারী প্রার্থীদের মধ্যে জি. এম. হায়দার আলী বাবলু ও মো. সাজাহান আলমকেও হাতেমকে সমর্থন করে জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে উপস্থিত হতে দেখা গিয়েছিল।