রূপগঞ্জে লোকবল সংকটে ব্যাহত পরিবার পরিকল্পনা মা ও শিশুর স্বাস্থসেবা
যুগের চিন্তা রিপোর্ট
প্রকাশ: ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
রূপগঞ্জ উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয়
রূপগঞ্জ উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয়ে অধীনে ইউনিয়ন ও পৌর কেন্দ্রগুলোতে লোকবল সংকটের অযুহাতে ৭ দিন ২৪ ঘন্টার সেবা দিচ্ছেন মাঝে মধ্যে। এতে উপজেলার প্রায় ৮ লাখ বাসিন্দাদের মাঝে গর্ভবতী মা ও শিশুর স্বাস্থ্যসেবা,টিকাদান ও স্বাস্থ্য পরিচর্যা সেবা চরমভাবে ব্যহত হচ্ছে। শুধু তাই নয়, বেশ কয়েকটি ইউনিয়নে কার্যালয় না থাকা, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অধীনে অপরিকল্পিত ও পৃথক পৃথক কক্ষ ব্যবহার, কোথাও শুন্য পদে লোকবল না থাকায় হতাশ হয়ে ফিরছেন সেবাপ্রার্থীরা।
সরেজমিনে ঘুরে জানা যায়, রূপগঞ্জ উপজেলার ২ টি পৌরসভা,৭ টি ইউনিয়নের স্থায়ী ও অস্থায়ী বাসিন্দা রয়েছেন প্রায় ৮ লাখ। এদের মাঝে গর্ভবতী মা ও নবজাতকসহ শিশু, গৃহবধূদের স্বাস্থ্যসেবা দিতে বিধি অনুযায়ী প্রতিটি ইউনিয়ন ও পৌর কার্যালয়ে একজন করে এসএসিএমও, এফডব্লিউভি, এফপিআই, ফার্মাসিস্ট, এমএলএসএস, আয়াসহ ৩জন ভিসিটর থাকার কথা। যাদের মাধ্যমে স্ব স্ব ইউনিয়নের ৭দিন ২৪ ঘন্টা নিয়োজিত রেখে যে কোন স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা সেবা প্রদান নিশ্চিত করা হয়ে থাকে। কিন্তু রূপগঞ্জের সব কয়টি ইউনিয়ন স্যাটেলাইটে দেখা গেছে ভিন্ন চিত্র। যেখানে কোথাও নেই নিজস্ব কার্যালয় আবার কার্যালয়সহ সব আয়োজন থাকলেও নেই প্রয়োজনীয় লোকবল। আবার লোকবল থাকলেও অনেকেই অফিস করেননা নিয়মিত। এমন চিত্র গত দেড় যুগ ধরে হলেও সুরাহা পাচ্ছেনা সংশ্লিষ্টরা। এতে সেবাদান করতে অনেকটা হিমসিম খেতে হয় খোঁদ উপজেলা পরিকল্পনা কর্মকর্তাকেই। অভিযোগ রয়েছে পরিদর্শকদের ম্যানেজ করে কতিপয় অসাধু কর্মচারীদের মাধ্যমে ঔষুধ ও নানা সরঞ্জাম সরিয়ে নেয়ারও। যদিও এমন অভিযোগ অস্বীকার করেছেন পরিদর্শকরা।
২১ ডিসেম্বর দুপুরে উপজেলার দাউদপুর ইউনিয়ন পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয়ে প্রবেশ করতে চাইলে দ্বিতল বিশিষ্ট ভবনের উপরে তাকালে দেখা যায় সাইনবোর্ডে লেখা রয়েছে ৭ দিন ২৪ ঘন্টা খোলা থাকার বার্তা। নিচে প্রধান ফটকে চোখ পড়তেই দেখা যায় দুটি তালা ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। তবে পকেট দরজা বাহির থেকে তালাবদ্ধ থাকায় স্থানীয় রোগীদের নিয়ে ভেতরে মূল ভবনের দরজার আরও একটা তালাবদ্ধ। তবে ভবনে উড়ছে জাতীয় পতাকা। জানালা রাখা হয়েছে খোলা। পাশের একটি সাইনবোর্ডে পাওয়া যায় এফডব্লিউভি শিরিনা নামের একজনের মুঠোফোন নাম্বার। কথা হয় এই মুঠোফোনে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে। শিরিনা বলেন,আমি টিকাদানে গোবিন্দপুর এসেছি। আরও কেউ দায়িত্বে আছেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি একাই এ হাসপাতাল চালাই। আমি ছাড়া আর কেহই এখানে দায়িত্বে নেই। সব পদশুন্য। নিয়মিত অফিস করেননা বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন,আমি হাসপাতালেই থাকি স্বামীসহ। কেউ ডাকলে সেবা দেই।
স্থানীয় বাসিন্দা আব্দুল গাফফার বলেন, মাঝে মধ্যে কার্যালয় খোলেন,তবে রাতে এখানে একজন মহিলা থাকেন। দিনে মাঝে মাঝে দেখা যায়। কথা হয় অপর বাসিন্দা রেহানার সঙ্গে। তিনি বলেন, আমার মেয়ে গর্ভবতী গত ৫ মাস ধরে। শুনেছি এখানে সরকারিভাবে বিনামূল্যে প্রসব,ও প্রসবকালীন সেবা দেয়া হয়। ৪ দিন পূর্বে একবার এসেছিলাম,কয়েকটা আয়রন বড়ি দিয়ে পাঠাই দিছে। এখন এসে দেখি তালা ঝুলানো।
একই চিত্র মুড়াপাড়া ইউনিয়ন সেন্টারে। সংশ্লিষ্ট ইউনিয়নে দায়িত্বরত এফপিআই আওলাদ হোসেন বলেন, আমাদের নিজস্ব ভবন নাই তাই উপজেলা পরিষদের পুরাতন গোডাউনের একটি কক্ষে সপ্তাহে ১/২ দিন সেবাদান অব্যাহত রেখেছি। আমাদের এ ইউনিয়নে ৩০ শতক জমি ছিলো,যাতে পাবলিক টয়লেট তৈরী করেছিলেন সাবেক উপজেলা পরিষদের কর্মকর্তারা। এ সময় তিনি বলেন, লোকবল আর কার্যালয় না থাকায় আমাদের কাজ করতে সমস্যা হচ্ছে। কথা হয় কায়েতপাড়া ইউনিয়ন পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয়ের দায়িত্বরত এফপিআই আল আমিনের সঙ্গে। তিনি বলেন, আমাদের কার্যালয় আছে, তবে জমি বেদখল। প্রচুর রোগী আছে,লোকবল নেই। এতে সাধারণ লোকজনের কাছ থেকে অভিযোগ শুনতে হয়।
ভয়াবহ চিত্র দেখা গেছে ভোলাবো ইউনিয়ন কেন্দ্রেও।এখানেও এফডব্লিউভি পদীয় নুরজাহান ছাড়া বাকি সবকয়টি পদ শুন্য রয়েছে। আবার রূপগঞ্জ সদর উপজেলার প্রধান কার্যালয়ে যুক্ত থাকায় এদের কার্যক্রম চোখে পড়ে না খুব একটা। সূত্রমতে,এখানে রয়েছে শুন্য পদ। এখানে এফডব্লিউভি ও ভিসিটর নাছিমা খাতুন ছাড়া আর কাউকে দেখা যায়নি।
কাঞ্চন পৌরসভায় থাকা কার্যালয়টি যেন এক নর্দমার ময়লার ভাগার। পুরাতন দ্বিতল ভবনটির সামনে নোংরা তোবা আর মাদকাসক্তদের আনাগোনায় এক ভুতুরে চিত্র দেখা গেছে কার্যালয়টিতে। সূত্রমতে এখানে আছমা বেগম এসএসিএমও হিসেবে দায়িত্বে থাকার কথা হলেও তিনি মাতৃত্বকালীন ছুটি ভোগ করছেন। ফলে এফডব্লিউভি সুমাইয়া রানী একাই সামলাচ্ছেন কার্যালয়টি। যদিও অনিয়মিত থাকার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধেও। এফপিআই লুৎফর রহমানের থাকার কথা হলেও কার্যালয়ে দেখা যায়নি তাকে। এছাড়াও গোলাকান্দাইল ইউনিয়নে ওয়াহিদা, মরিয়ম মিলে সেবা দিচ্ছেন। সেখানেও ৪ টি পদ শুন্য রয়েছে। তবে কিছুটা ভালো চিত্র তারাবো পৌর কার্যালয়ে। এখানে পদশুন্যের তালিকা মাত্র ২ জন। সেবায়ও জেলার মধ্যে প্রথম স্থান ধরে রেখেছেন বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে রূপগঞ্জ উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা মেডিকেল অফিসার (এমসিএইচ, এফপি) শুভাগত সাহা বলেন, ভয়াবহ ও তীব্র লোকবল সংকটের মাঝেই সেবাদানের চেষ্টা করছি। সংকট নিয়ে উর্ধতন মহলে কথা বলেছি। তবে কোন কর্মকর্তা ও কর্মচারীর বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ পেলে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেব।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে রূপগঞ্জ উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা রোমানুর নাহার বলেন, আমাদের উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অধীনে পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের সবগুলো কক্ষ পাশাপাশি না থাকায় সদর থেকে সেবাদানে সমস্যা হয়। পাশাপাশি প্রতিটা ইউনিয়ন ও পৌর কার্যালয়ে লোকবলের অভাব নিয়েই সেবাদান করে আসছি। এতো সংকটের মাঝেও পুরো উপজেলায় আমাদের সেবাদান কার্যক্রম সক্রিয় রয়েছে। চিকিৎসা পরামর্শ, সেবা ও সরকারীভাবে প্রাপ্ত ঔষধ বিণামূল্যে সরবরাহসহ মা ও শিশুদের সেবাদান করছি। লোকবল কম থাকায় পরিপত্র অনুযায়ী ঢেলে সাজাতে হয় সেবাদানকারীদের অবস্থান।এতে মাঠে কাজ করায় অনেক সময় অফিসে সবাইকে পাওয়া না গেলে অনুপস্থিত বা অনিয়মিত বলা যায়না। তারপরও কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।