Logo
Logo
×

নগরের বাইরে

বন্দরের তেলচোর দেলু চেয়ারম্যান গ্রেপ্তার

Icon

প্রকাশ: ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম

বন্দরের তেলচোর দেলু চেয়ারম্যান গ্রেপ্তার

বন্দর উপজেলার কলাগাছিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও জাতীয় পার্টির নেতা দেলোয়ার হোসেন প্রধানকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।

 বন্দর উপজেলার কলাগাছিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও জাতীয় পার্টির নেতা দেলোয়ার হোসেন প্রধানকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তিনি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সশস্ত্র হামলা ও হত্যার অভিযোগে একাধিক মামলায় অভিযুক্ত। গতকাল রোববার (১৬ ফেব্রুয়ারি) রাত সাড়ে আটটার দিকে বন্দর ঘাট সংলগ্ন এলাকা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয় বলে জানান বন্দর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ তরিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, “তার বিরুদ্ধে একাধিক হত্যা ও হত্যাচেষ্টার অভিযোগে মামলা রয়েছে। মামলাগুলো যাচাই-বাছাই চলছে। তাকে কোন মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হবে সে বিষয়ে কাজ চলছে।” দেলোয়ার হোসেন নারায়ণগঞ্জ জেলা জাতীয় পার্টিরও সহসভাপতি। তিনি ওসমান পরিবারের ঘনিষ্ঠ একজন নেতা ছিলেন।



অভিযোগ আছে, বন্দরে ওসমানদের ছত্রছায়ায় থেকে এই দেলোয়ার প্রধান ওই এলাকার বাসিন্দাদের কাছ থেকে অবৈধ গ্যাস লাইন সংযোগের প্রতি লাইনের জন্য ৩০ থেকে ৬০ হাজার টাকা করে নিয়েছে। বিনিময়ে বৈধ গ্যাস না দিয়ে সে অবৈধ গ্যাস সংযোগ দিয়েছে। পরে সরকার এইসব অবৈধ লাইন কেটে নিলেও দেলোয়ার সে টাকা আর ফেরৎ দেননি। এলাকাবাসী জানান, শুধু গ্যাস সংযোগ না, দেলোয়ারের বিরুদ্ধে মাঠে তদন্ত করলে অনেক প্রতারণার চিত্রই ফুটে উঠবে। চেয়ারম্যান থাকাকালীন সে বিভিন্ন উপায়ে সাধারণ জনগণ থেকে টাকা পয়সা হাতিয়ে নিয়েছে। জন্মনিবন্ধনসহ ইউনিয়ন পরিষদের বিভিন্ন সেবায় জনগণের কাছ থেকে অবৈধভাবে কয়েকগুন বেশী টাকা আদায় করতো। এছাড়াও এলাকার কোথায় জায়গা সম্পত্তির বিষয়ক সমস্যা আছে সেসব বিষয়ে খোঁজ খবর রাখার জন্য তার আলাদা একটি বাহিনী প্রস্তুত থাকতো। এসব বিষয় নিষ্পত্তির নামে সেখান থেকে বিরাট অংকে টাকা হাতিয়ে নিতো দেলোয়ার প্রধান। দেলোয়ার প্রধান একদিকে ইউনিয়ন চেয়ারম্যান অন্যদিকে এমপি সেলিম ওসমানের লোক হওয়ায় তার বিরুদ্ধে কথা বলার মতো সাহস সহজে কারো হতো না। এলাকাবাসী মনে করেন দেলোয়ার প্রধানের দেলু থেকে দেলোয়ার প্রধান হওয়ার ইতিহাস যদি ঠিক মত টান দেয়া যায়, তাহলে দেখা যাবে এই শীতলক্ষ্যা নদীর বলগেট (বাল্ক-হেড) তেলের জাহাজ কোন কিছুই তার কাছ থেকে নিরাপদ ছিল না। তার ফতুল্লার তেলের পাম্পেও তেল চুরির অভিযোগ আছে। সে দেউল্ল্যা থেকে কীভাবে এত তাড়াতাড়ি কোটিপতি দেলোয়ার প্রধান হলেন তার ইতিহাস এই এলাকার মানুষের কাছে অজানা নয়।



এছাড়া কলাগাছিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেন প্রধানের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জন, মানি লন্ডারিংসহ বিভিন্ন অভিযোগে করা একটি মামলার চার্জশিট দেয় দুর্নীতি দমন কমিশন। চার্জশিটে দুর্নীতির সকল অভিযোগের প্রমাণ পাওয়া গেছে বলে তখন উল্লেখ করে দুদক। অভিযুক্ত দেলোয়ার হোসেন সর্বশেষ ২০২১ সালের ১১ নভেম্বর অনুষ্ঠিতব্য কলাগাছিয়া ইউপি নির্বাচনে জাতীয় পার্টির মনোনীত লাঙ্গল প্রতীকের প্রার্থী ছিলেন। দুদক সূত্রে তখন জানা যায়, কলাগাছিয়া ইউপি নির্বাচনে লাঙ্গলের প্রার্থী ও বর্তমান চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেন প্রধানের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জন, নামে-বেনামে জ্ঞাত বহির্ভূত আয়, মানি লন্ডারিংয়ের বিভিন্ন অভিযোগ পায় দুদক। অভিযোগের তদন্তে নেমে প্রাথমিক সত্যতাও পায় সংস্থাটি। পরে ২০১৯ সালের ২৬ ডিসেম্বর দেলোয়ার প্রধানের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয় ঢাকা-১। প্রায় দুই বছর দীর্ঘ তদন্ত শেষে এই মামলার চার্জশিট দিয়েছে দুদক। ২০২১ সালের ৭ সেপ্টেম্বর দেলোয়ার প্রধানের বিরুদ্ধে করা এই মামলার চার্জশিট প্রদানের অনুমোদন দেয় দুদক। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা দুদকের সহকারী পরিচালক মানসী বিশ্বাস। দুদক সূত্র জানায়, গত ১৩ বছর কলাগাছিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেন প্রধান। দীর্ঘ এই সময়ে ক্ষমতার অপব্যবহার করে বিভিন্ন উপায়ে দুর্নীতির মাধ্যমে জ্ঞাত বহির্ভূত সম্পদ অর্জন করেছেন দেলোয়ার হোসেন। মানি লন্ডারিংয়ের সাথেও সম্পৃক্ত তিনি। এসব বিষয়ে দেলোয়ার প্রধানের কাছে তথ্য চাইলে তিনি তথ্য গোপন করেন। তদন্তে অভিযোগের প্রমাণ পেয়ে আসামি দেলোয়ার প্রধানের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪ এর ২৬(২) ও ২৭(১) ধারা এবং মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ এর ৪(২) ও ৪(৩) ধারায় চার্জশিট দেয় দুদক।

স্থানীয়রা বলছেন, কথায় বলে ‘পাপ ছাড়ে না বাপকে’ আর এই কথাটিই যেন এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন বন্দর কলাগাছিয়ার ইউনিয়ন পরিষদের জাতীয়পার্টি মনোনীত চেয়ারম্যান প্রার্থী দেলোয়ার হোসেন প্রধান। তার মাথার উপর নারায়ণগঞ্জের প্রভাবশালী এমপি একেএম সেলিম ওসমানের সমর্থনের হাত থাকায় স্থানীয়রা তার শত অপকর্মের সাক্ষী হয়েও প্রকাশ্যে বলতে পারেননি। কীভাবে দেলু থেকে দেলোয়ার প্রধান হলেন, কীভাবে ভাঙ্গা ঘর থেকে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়ে ফতুল্লায় জ্বালানী তেলের পাম্প ও আলিশান বাড়ি গাড়িসহ অভৈব সম্পদের মালিক হলেন তা জানা সত্ত্বেও প্রকাশ করতে পারেননি এলাকাবাসী। কিন্তু ‘ধর্মের কল বাতাসে নড়ে’ এই প্রবাদটি তো আর মিথ্যে নয়।

স্থানীয়রা বলছেন, ভাঙ্গা টিনের বেড়া থেকে আজ বিশাল অট্টালিাকার মালিক এবং ওসমান পরিবারের হাত ধরে দেলু থেকে দেলোয়ার প্রাধানের পরিচিতি পাওয়ার বিষয়টি দেলোয়ার প্রধান নিজেই বিভিন্ন নির্বাচনী সভায় ঘোষণা করেন। অন্যদিকে বন্দর আওয়ামী লীগের একাধিক নেতার মুখে দেলোয়ারের আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে উঠার গল্প শোনা যায়। তাই কোন্ যাদুর কাঠির বলে তিনি এত দ্রুত সফল হয়েছেন তার ইতিহাস উদ্ধার করতে কলাগাছিয়া ইউনিয়নের লোকজনের সাথে কথা বলে এবং বিভিন্ন মাধ্যম থেকে তথ্য উপাত্ত নিয়ে জানা যায়, দেলোয়ার প্রধানের পিতা হারেছ প্রধান ছিলেন একজন নামকরা ডাকাত। সেই ডাকাতির পেশাটা তিনিও দীর্ঘদিন চালিয়ে গেছেন। শীতলক্ষ্যা নদীর বন্দর কলাগাছিয়া এলাকা দিয়ে একসময় ডাকাতদের ভয়ে কোন প্রকার নৌযান দিয়ে চলাচল করার সময় ব্যবাসীয়ার আতঙ্কিত হয়ে থাকত। সে সময় কলাগাছিয়া ডাকাতির ঘটনা ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। এমনকি এখান দিয়ে চলাচলরত ভরাটবালু পরিবাহী বাল্কহেড থেকে ডাকাতি ও চাঁদাবাজিতেও দেলোয়ার প্রধান ওরফে দেলুর নাম জড়িত ছিল বলে জানান তারা।
 
২০১৬ সালের ৪ মে মঙ্গলবার এরশাদের হাতে ফুল দিয়ে দেলোয়ারসহ মুসাপুরের ইউপি চেয়ারম্যান মাকসুদ ও বন্দরের চেয়ারম্যান এহসান জাতীয়পার্টিতে যোগদান করেন। বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এর আগে দেলোয়ার কখনোই জাতীয়পার্টিকে পছন্দ করতেন না। শুধু তা-ই নয়, জাতীয়পার্টি নিয়ে ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করে সারাজীবন যে ব্যক্তি ‘যাত্রাপার্টি’ বলে হাস্যরস করতো, সেই তেল চোরা দেইল্লা-ই এখন লাঙ্গল কাঁধে যাত্রা পার্টির খলনায়ক তথা ভিলেন বলে বিভিন্ন মিডিয়ায় সংবাদও প্রকাশ করা হয়।
 
২০১৬ সালের ইউপির নির্বাচনে জাতীয়পার্টিতে যোগদানের তিন সপ্তাহ না পেরুতেই এক শিক্ষককে লাঞ্ছিত করার ঘটনায় এলাকাবাসীর কাছে ধাওয়া খেয়ে দৌড়ে পালিয়ে নিজের প্রাণ রক্ষা করেন তখনকার জাপা মনোনীত চেয়ারম্যান প্রার্থী দেলোয়ার। সে সময় প্রত্যক্ষদর্শী জানিয়ে ছিল সেদিন বিকেলে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মনোনীত নৌকার প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলমের একটি নির্বাচনী উঠান বৈঠক চলাকালে বৈঠকের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন জাহাঙ্গীর আলমের স্কুল জীবনের শিক্ষক আসগর আলী। তখন সে তার প্রিয় শিক্ষককে ডেকে এনে জনতার উদ্দেশ্যে কিছু বলতে বললে আসগর আলী বলেছিলেন নির্বাচনে নৌকা বিপুল ভোটে জয় লাভ করবে আর নাঙ্গল থাকবে ৩ নম্বরে। সেদিন রাত সাড়ে আটটার দিকে বৈঠক শেষে বাড়ি ফেরার পথে দেলোয়ারের সমর্থকরা পথি মধ্যে তার উপর হামলা চালায় এবং লাঞ্ছিত করে। এ ঘটনায় তখন বিক্ষুব্ধ এলাকাবাসী দেলোয়ার প্রধানের বিরুদ্ধে ঝাড়ু ও জুতা মিছিল বের করলে কয়েজন সন্ত্রাসীকে সাথে নিয়ে ছুটে আসেন দেলোয়ার প্রধান। তাতে এলাকাবাসী আরো উত্তেজিত হয়ে তাকে ধাওয়া করলে  সেখান থেকে দ্রুত ত্যাগ করে প্রাণ বাঁচান তিনি।

সে সময় জাতীয়পার্টির নিবেদিত প্রাণ কর্মী হিসেবে পরিচিত প্রয়াত এমপি আলহাজ্ব নাসিম ওসমানের গড়া নারায়ণগঞ্জ জেলা জাতীয়পার্টির ১ম যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক স্বতন্ত্র প্রার্থী আজিজুল হক আজিজকে বিভিন্ন নির্যাতন ও ভয়ভীতি দেখিয়ে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয় দেলোয়ার। তার পর লুটপাটসহ জনকল্যাণের নামে পরের জমি জবরদখল করা, মিমাংসার নামে নামকাওয়াস্তে দাম দিয়ে ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে জমির মালিককে জমিহারা করা ইত্যাদি নানা কর্মকাণ্ডে সে আবারো বিতর্কিত হয়।
 
সেসময় তাকে কেউ তেল চোরা দেউল্লা আবার কেউ তেউল্লা দেলোয়ার বলে চিনত। ভিলেনের চরিত্রে তাকেই মানায় উল্লেখ করে সেসব মিডিয়া জানায়, লেখাপড়া করে প্রাইমারী স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে খুব বেশীদুর যেতে পারেনি দেলোয়ার। তবে উচ্চ শিক্ষিত না হলেও শিখেছেন তেল চুরির কৌশল। পুলিশ প্রশাসনকে ম্যানেজ করা মাধ্যমে ওপেন-সিক্রেট চোরাই তেলের ব্যবসা করে, অবৈধ টাকার তেলেসমাতিতে বাংলা সিনেমার ভিলেনের মত বাড়িওয়ালা, গাড়িওয়ালায় পরিণত হয় দেলোয়ার। আর এ ধরণের হাজার গুনের অধিকারী দেলোয়ার কোটি কোটি টাকা খরচ করে ভোট কেনাসহ বিভিন্ন ছল-চাতুরী ও অভিনয় করে কলাগাছিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার মাধ্যমে তার তেল চোরা খ্যাতি মুছে আলহাজ্ব দেলোয়ার হোসেন প্রধানের ভূমিকায় আসার চেষ্টা করেন।
 
এর আগে ২০১৯ সালে ৪ নভেম্বর দেলোয়ার প্রধানের মালিকানাধীন ফতুল্লার ‘মেসার্স প্রধান সিএনডি এ্যন্ড ফিলিং স্টেশন’-এর বিরদ্ধে তেল পরিমাপে কম দেয়ার অপরাধে মামলা করা হয়। এ সময় বিএসটিআইয়ের পক্ষ থেকে তেল সরবরাহকারীকে সেখানে তেল সরবরাহ বন্ধ করার জন্য অনুরোধও জানানো হয়। অন্যদিকে দেলোয়ার প্রধানকে ১৯ কোটি ১৩ লক্ষ টাকা ব্যাংকে জমা দেয়ার নির্দিষ্ট তারিখ বেধে দেয়া হয়েছে। তার বিরুদ্ধে ৯ কোটি টাকার চেক জালিয়াতির অভিযোগসহ স্থানীয় এলাকাবাসীর কাছ থেকে গ্যাস সংযোগের নাম করে অবৈধ গ্যাস সংযোগ প্রদানের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়াও বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে।

Abu Al Moursalin Babla

Editor & Publisher
ই-মেইল: [email protected]

অনুসরণ করুন