রওশন মেম্বারের দাপটে অতিষ্ঠ ক্রোকেরচরবাসী

যুগের চিন্তা রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২ মার্চ ২০২৫, ১২:০০ এএম

রওশন মেম্বারের দাপটে অতিষ্ঠ ক্রোকেরচরবাসী
নারায়ণগঞ্জ জুড়ে ছিল গড ফাদার খ্যাত শামীম ওসমান ও তার দোসরদের ত্রাস ও রাজত্ব। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের দেশ পলায়নের আগে নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের তৎকালীন এমপি শামীম ওসমানের ক্যাডারদের ভয়ে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে ব্যবসায়ী এমনকি প্রশাসনও থাকতো নির্বিকার। আর শামীম ওসমান কিংবা ওসমান পরিবারের ক্যাডারদের বেশিরভাগই ছিল সিদ্ধিরগঞ্জ ও ফতুল্লা কেন্দ্রীক। কেননা এই এলাকা ছিল শামীম ওসমানের নির্বাচনী এলাকা।
এরমধ্যে শামীম ওসমানের ভাই নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের এমপি সেলিম ওসমানের রাজত্ব ছিল ফতুল্লার আলীরটেক ও গোগনগরসহ বন্দর উপজেলা এলাকা। তাই আলীরটেক ইউনিয়নে ওসমান পরিবারের নিয়ন্ত্রণে থাকা ক্যাডার বাহিনীর ছিল রোমহর্ষক অপকর্ম। যেখানে আলীরটেক ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান জাকির হোসেন ওরফে ঘি জাকিরের নেতৃত্বে চলতো এসব অপকর্ম।
এই ইউনিয়নের ৪ নং ওয়ার্ডের মেম্বার রওশন আলী ওরফে নওশেদ মেম্বারের দাপটে ও বিভিন্ন অপকর্মে সব সময়ে আতঙ্কিত থাকতেন এলাকাবাসী। তবে ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পরও সাবেক ইউপি মেম্বার রওশন আলীর সেই দাপট এখনও বিদ্যমান। রওশন মেম্বার ও তার পাঁচ ভাইয়ের ভয়ে এখনো তটস্থ থাকে স্থানীয়রা। এতটাই আতঙ্কিত যে তাদের ভয়ে এখনও তাদেরর কোন অপকর্মের কথাই প্রকাশ্যে আসছে না। রওশন মেম্বারের অবাধ্য হওয়ায় স্থানীয় দিদার নামক একজনকে খুন করার প্রায় দু’বছর পার হলেও এখনও বহাল তবিয়তে ঘুরে বেড়াচ্ছে রওশন। কেড়ে নেওয়া হয়েছে দিদারের পরিবারের মাথা গুজার জায়গাটুকু।
স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা যায়, আলীরটেক ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জাকির হোসেন এক সময়ে ঘি এর ব্যবসা করতো বলে তাকে এখনও মানুষ ঘি জাকির হিসেবে চিনে। গত ইউপি নির্বাচনে ওসমান পরিবারকে বড় অঙ্কের টাকার মাধ্যমে সন্তুষ্ট করে ঘি জাকির। আর এই ঘি জাকিরের সকল অপকর্মের প্রধান সেনা ছিল রওশন মেম্বার। এর আগেও সে এই ওয়ার্ডের মেম্বার হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিল।
কিন্তু গত ইউপি নির্বাচনের পূর্বে তার সকল অপকর্মের কারণে নিশ্চিত পরাজয় জেনে বিপুল টাকা খরচ করে এই ওয়ার্ডের মেম্বারের পদটি ধরে রাখে। বৈষম্য জুলাই আন্দোলনের সময় ওসমান পরিবারের সহচর হয়ে নারায়ণগঞ্জের হাফেজ সোলাইমান হত্যা মামলার আসামি এই রওশন ওরফে নওশাদ আলী মেম্বার। ওসমান পরিবারের ঘনিষ্ঠজন ও হত্যা মামলার আসামি হওয়ার পরেও এখনো প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে তারা নিজ এলাকায়। তাকে আইনের আওতায় এনে সঠিক তদন্তের মাধ্যমে তার সকল অপকর্ম উদঘাটন করে ন্যয্য শাস্তি প্রদানের দাবি জানিয়েছেন ভূক্তভোগী পরিবারসহ স্থানীয়রা।
বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, রওশন আলী ও তার সহযোগী পাঁচ ভাই যথাক্রমে রতন, জুলকার, ফারুক, আলমগীর, সাইফুল মিলে ওসমান পরিবারের ছত্রছায়ায় আলীরটেক ইউনিয়নকে ত্রাসের রাজত্ব কায়েমের মাধ্যমে নারায়ণগঞ্জ থেকে প্রায় আলাদা করেই রেখেছিল। শত অপরাধ করার পরও জেলার কোন আইন কানুনই তাদের স্পর্শ করতে পারেনি। স্বৈরাচার আওয়ামী শাসনের সময় ওসমান পরিবারের দোসর হয়ে এবং অয়ন ওসমানকে কোটি টাকার গাড়ি উপহার দিয়ে সম্পর্ক তৈরি করে বলে খবর পাওয়া যায়।
আর ওসমান পরিবারের এই ট্যাগ ব্যবহার করে আলীরটেক ইউনিয়নের গরীব ও নিরীহ মানুষের চাষের ও বসতবাড়ির জমিসহ সরকারি খাস জমি জবরদখল করে বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। ছাত্র জনতার আন্দোলনের সময় হাফেজ সোলাইমান হত্যার সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় দায়েরকৃত এজহারভুক্ত আসামি রওশন আলী ও তার ভাই রতন।
৫ আগস্ট সরকার পতনের পরও অবৈধ টাকার বিনিময়ে এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে এই রওশন মেম্বারসহ তার ভাই ও সহযোগিরা। এতে করে আলীরটেক ইউনিয়নের ৪ নং ওয়ার্ডের সাধারণ জনগণের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। কিন্তু ছাত্র-জনতার আন্দোলনের হত্যা মামলার আসামি হয়েও এখনো নিজ এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করে চলেছে মেম্বার তার দলবলের সন্ত্রাসী বাহিনী। এতে করে জনমনে প্রশ্ন প্রশাসনকে ফাঁকি দিয়ে কিভাবে মেম্বার ও তার সন্ত্রাসী বাহিনী প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে ও আধিপত্য বিস্তার করছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রওশনের বাবা কাদের মিঞা নদীতে মাছ ধরার মাধ্যমে জীবীকা নির্বাহ করতেন। রওশনেরা ৬ ভাই ও ৪ বোন। তাই এত বড় সংসার চালাতে গিয়ে খুবই অভাব অনটনে চলতে হতো তাদের। অভাবে তাড়নায় দ্বিতীয় ছেলে রওশন আলীকে মুন্সীগঞ্জের এক আত্মীয়ের বাসায় কাজের ছেলে হিসেবে দিয়ে দেয়। সেখান থেকে টাকা চুরি করে বিদেশ গিয়েও কোন উন্নতি করতে পারেনি। রওশন আলীর ছোট ভাই জুলকারনাইন এলাকায় মাদ্রাসা করার নামে এলাকার মানুষসহ দেশ-বিদেশ থেকে আসা বিশাল পরিমাণ টাকার আত্মসাৎ করে পালিয়ে যায়।
এছাড়া হজ¦ এজেন্সীর নামে হাজীদের কাছ থেকেও প্রচুর পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ জেল কেটেছেন বলেও জানা যায়। অথচ বর্তমানে ক্রোকের চর গ্রামে তাদের বিশাল এরিয়া নিয়ে তিন তলা আলিশান বাড়ি, বাজারে রয়েছে তিনটি দ্বিতলা ভবন। বুড়িগঙ্গা নদীর সরকারি খাস জমিসহ গ্রামের নিরীহ মানুষদেরকে জিম্মি করে অবৈধভাবে জমি দখল করে গড়ে তুলেছেন ইটভাটা। আর এই ইট ভাটার জন্য মাটি সরবরাহ করতেন গ্রামের কৃষি জমি জবরদখল করে ও শামীম ওসমানের ভয় দেখিয়ে।
এর বাইরেও মাসদাইর কবরস্থানের পাশে ১২ তলা নির্মাণাধীন ভবন, মুসলিম নগর নয়াবাজারে একটি সাত তলা ভবন, আরেকটি তিন তলা ভবন ও মার্কেট আছে বলে জানা গেছে। আলীরটেক ইউনিয়ন পরিষদের পাশের ১০০ বিঘা জমি জোরজবরদস্তি করে দখল করেছেন বলেও অভিযোগ আছে। তাছাড়া কক্সবাজারেও ৬ তলা বিশিষ্ট আলিশান রিসোর্ট বলে জানা গেছে। তার এই আলাদীনের চেরাগের রহস্য উদঘাটনের জোর দাবি জানাচ্ছেন এলাকাবাসী।
ক্রোকের চরবাসী জালাল ব্যাপারী ও তার স্ত্রী মোমেনা বেগম বলেন, দুই বছর আগে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকার সময় আমার ছেলে দিদার হোসেনকে মেরে ফেলে ঘরের চালে (বাথ রুমের ফলস ছাদের উপর) তুলে রাখে রওশন আলীর লোকজন। আমার ছেলে মসজিদ থেকে নামাজ পড়ে বের হওয়ার পর তার তাকে জোর করে তুলে নিয়ে গিয়ে একটি রুমের ভিতর নিয়ে মেরে ফেলে।
এরফলে তার আমাদের পরিবারকে মেরে ফেলার হুমকি দিয়ে আমার সকল জায়গা সম্পত্তি দখল করে নিয়ে যায়। আমাদেরকে আমাদের বাড়ি থেকে বের করে দেয়। সে সময় আমরা নারাণগঞ্জ সদর থানায় অভিযোগ করলে তারা টাকা খেয়ে আমার মামলা একেবারে হালকা করে দেয়। আমাদের সন্তানেরা তেমন একটা বুঝতো না বলে এবং আসামীরা প্রভাবশালী থাকায় আমরা কিছুই করতে পারিনাই।