লিপি ওসমানের ক্যাশিয়ার জীবু’র সাতকাহন

যুগের চিন্তা রিপোর্ট
প্রকাশ: ১৩ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০০ এএম

লিপি ওসমানের ক্যাশিয়ার জীবু’র সাতকাহন
বিগত ১৬ বছর আওয়ামী লীগের লাগাতার শাসনামলে নারায়ণগঞ্জের সবকিছুই ছিলো ওসমান পরিবারের দখলে। বিভিন্ন সেক্টরে খোলামেলা চাঁদাবাজি করতেন ওসমান পরিবারের ছোটবড় প্রায় সব সদস্যই। বিনাপুঁজিতে শতভাগ লাভজনক চাঁদাবাজির ব্যবসাটি সুনিপুণভাবেই রপ্ত করেছিলেন ওসমান পরিবারের তৃতীয় ও চতুর্থ প্রজন্ম। ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের প্রবল পরাক্রমশালী এমপি ছিলেন শামীম ওসমান। রাষ্ট্রীয় এবং সামাজিকভাবে দলীয় ক্ষমতার দাপট দেখাতেন প্রকাশ্যেই। তার দেখানো পথে হাঁটতে হাঁটতে একটা সময় তার স্ত্রী লিপি ওসমান নিজেও অনেক ক্ষমতাধর হয়ে ওঠেন। বিভিন্ন এলাকায় তার নিয়ন্ত্রণে বেশ কয়েকটি সন্ত্রাসী বাহিনী গড়ে ওঠে। সব চাইতে বেশী শক্তিশালী ছিলো তার নিজহাতে গড়া পুর্ব ইসদাইর বুড়ির দোকান এলাকার জীবু বাহিনী। এ বাহিনীর অন্যতম শক্তিধর নেতা সাইফুল খান জীবন ওরফে জীবু ছিলেন লিপি ওসমানের ক্যাশিয়ার। চাঁদাবাজির মাস্টারমাইন্ড হিসেবে খ্যাত জীবু ছিলেন একজন ধূর্ত প্রকৃতির লোক। কিন্তু তার শ্মশ্রুমণ্ডিত মুখমণ্ডল দেখে কেউ বুঝতেই পারতেন না যে, ভেতরে ভেতরে তিনি ছিলেন একজন ঠান্ডামাথার ক্রিমিন্যাল।
জীবু তার দুই সিপাহসালার এলাকার চিহ্নিত মাদকব্যবসায়ী ও হত্যামামলার আসামী জামান এবং শিমুলকে দিয়ে চাঁদা উঠাতেন। গরু গিয়াসের পুত্র জামান এলাকায় একজন দাগী সন্ত্রাসী হিসেবে পরিচিত। মাদকব্যবসার পাশাপাশি পরের জমি দখল, পরকীয়া, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাইসহ হেন অপকর্ম নেই যা জামান ও শিমুল করতো না। জীবু এই দুই ক্রিমিনালকে পাঠিয়ে বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির কাছ থেকে মোটা অংকের চাঁদা আদায় করে তার কাছে জমা রাখতেন। মাস শেষে লিপি ওসমান হিসেব করে নিজের অংশ রেখে বাকীটা জীবুর মাধ্যমে অন্যদের ভাগ করে দিতেন। এই ভাগ-বাটোয়ারার সিংহভাগটাই যেতো জীবুর পকেটে। লিপি ওসমান প্রায় প্রতি মাসেই বুড়ির দোকান এলাকায় নানারকম সভা করতেন। এসব সভায় কখনো কখনো শামীম ওসমানও প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকতেন। সভায় উপস্থাপক হিসেবে নিজেকে তুলে ধরতে কখনো পিছপা হতেন না জীবু। এর মাধ্যমে তিনি এলাকাবাসীর কাছে একটা নীরব বার্তা পৌঁছে দিতে পেরেছিলেন যে, ওসমান পরিবারের সাথে তার একটা ‘গভীর সম্পর্ক ’ রয়েছে। চাঁদাবাজির ক্ষেত্রে তিনি এ সম্পর্কটাকে সফলতার সাথে কাজে লাগাতেন। বিভিন্ন সভা সফল করতে আলাদা ফান্ড গঠন করে বাড়তি চাঁদা আদায় করতেন বলেও শোনা যায়।
আচমকা হাসিনা সরকারের পতনের পর শামীম ওসমান তার পরিবার নিয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাবার পর মব সন্ত্রাস থেকে বাঁচতে জীবুও সপরিবারে এলাকা ত্যাগ করেছেন। তবে এখন শোনা যায়, ৫ আগস্টের পর নতুন ডানা মেলা এলাকার কিছু নেতাকে বিপুল অংকের টাকার বিনিময়ে হাত করে বুড়ির দোকানে ফিরতে চেষ্টা চালাচ্ছেন তিনি। একাজে তাকে সহায়তা করছেন তার মেঝো ভাই রফিকুল ইসলাম খান মানিক ওরফে ‘মাইগ্যা মানিক’। নিজের স্ত্রীর কামাইয়ে সংসার চালান বলে বেকার মানিকের নামের আগে ‘মাইগ্যা’ টাইটেল বসিয়েছেন এলাকার দুষ্টু পোলাপান। মানিক একসময় নারায়ণগঞ্জের একটি মার্কেটে রেডিমেইড পোশাকের ব্যবসা করতেন। তখন ছোটভাইয়ের প্রভাবে কারণে অকারণে আশপাশের দোকানদের সাথে নিজের কর্তৃত্ব ফলাতেন। প্রায় সময়ই নানরকম ঝামেলা বাঁধাতেন। তখন জীবু দলবলসহ গিয়ে ওই মার্কেটের দোকানদের শাসিয়ে আসতেন। নিজের মহল্লাতেও মাইগ্যা মানিক তার ছোটভাই জীবুর প্রভাব খাটিয়ে হামবড়া ভাব নিয়ে চলতেন। জীবু তার ভাইয়ের সাথে বুড়ির দোকান এলাকায় সিরাজ মিয়ার বাড়িতে একই ফ্ল্যাটে ভাড়া থাকতেন।
জীবুর আসল নাম সাইফুল খান। ডাকনাম হলো জীবন। কিন্তু তিনি নিজে তার ডাকনাম জীবনের পরিবর্তে ‘জীবু’ রেখেছেন বলে তার বন্ধুমহল জানিয়েছেন। তারা জানান, জীবন একদিন মাংস কিনতে গিয়ে জানতে পারেন দোকানের কসাইয়ের নাম জীবন। আরেকদিন জুতা সেলাই করতে গিয়ে জানলেন, রাস্তার পাশে ড্রেনের স্লাভের ওপর বসা সেই মুচির নাম জীবন। এখানেই শেষ নয়। একদিন রাস্তা দিয়ে হাঁটতে গিয়ে এক জায়গায় মানুষের জটলা দেখে এগিয়ে যান। উঁকি দিয়ে দেখেন, এক পকেটমারকে লাথিপেটা করা হচ্ছে। লাথি মারতে মারতে একজন নাম জিজ্ঞেস করলে কিশোরবয়সী সেই পকেটমার কাঁদতে কাঁদতে বলে,‘জীবন, জীবন’। সেদিন থেকেই তার জীবন থেকে ‘জীবন’ নামটির কবর রচিত হয়ে যায়। আর জীবন থেকে জীবু হয়েই তিনি নিজেকে নতুনরূপে তুলে ধরার প্রয়াস নেন। তিনি মসজিদ কমিটিতে জোরপূর্বক নিজের নাম লেখান। বিভিন্ন জাতীয় দিবস উদযাপনে উপস্থাপক সাজেন। লিপি ওসমানের ‘পাতানো দেবর’ বনে যান। মাদকব্যবসায়ীদের বুকে টেনে নেন। চাঁদাবাজির দোকান খুলেন। শামীম ওসমান ও লিপি ওসমানের ছবি ব্যবহার করে জামান, শিমুল ও জীবু নাম দিয়ে রাস্তার মোড়ে মোড়ে ব্যানার আর ফেস্টুন টানিয়ে নেতার ভাব নেন। এভাবেই টাকার পাহাড় গড়তে থাকেন। কিন্তু বিধি বাম! ফ্যাসিস্ট সরকারে আকস্মিক পতনের পর জীবু’র জীবনও নিভু নিভু হয়ে যায়। বেছে নেন পলাতক জীবন। তবে খুব শীঘ্রই এলাকায় ফিরে আসছেন বলে জোর গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে।
এরকম গুঞ্জন কানে আসার পর জীবু’র নানা অত্যাচারে জর্জরিতরা আতংকে রয়েছেন বলে জানা গেছে। সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে তারা বলছেন, ‘ আমরা ডেভিল জীবু’র প্রত্যাবর্তন চাই না। বরং তাকে আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি জানাচ্ছি।’