রূপগঞ্জের চনপাড়া পুনর্বাসন কেন্দ্রের (চনপাড়া বস্তি)
আ.লীগের রাজত্বে যুবদল স্বেচ্ছাসেবক দলের হানা

যুগের চিন্তা অনলাইন
প্রকাশ: ১৯ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০০ এএম

আ.লীগের রাজত্বে যুবদল স্বেচ্ছাসেবক দলের হানা
বজলুর রহমান ওরফে বজলু মেম্বার মারা যান ২০২৩ সালের মার্চে। দীর্ঘ ১৪ বছর পর নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের চনপাড়া পুনর্বাসন কেন্দ্রের (চনপাড়া বস্তি) অপরাধ জগতের নিয়ন্ত্রণ নেন কায়েতপাড়া ইউপি সদস্য ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সমশের আলী খান। গত বছর ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর পালিয়ে যান সমশের। এর পর আত্মগোপন থেকে ফেরেন চনপাড়া বিএনপি, এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতারা। তাদের মধ্যে আধিপত্য বিস্তার ও মাদক কারবার নিয়ে মুখোমুখি অবস্থান নেন যুবদল এবং স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতারা। ইতোমধ্যে দু’পক্ষ একাধিকবার সংঘর্ষে জড়িয়েছে; হয়েছে প্রাণহানিও। এতে আবারও আতঙ্কিত বস্তির সাধারণ বাসিন্দারা।
পুলিশ ও স্থানীয়রা জানান, রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর রূপগঞ্জ থানা যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক (সদ্য বহিষ্কৃত) শামীম হোসেন চনপাড়া বস্তির নিয়ন্ত্রণ নেন। তার সহযোগী চনপাড়া ইউনিয়ন যুবদলের সভাপতি মনির দেওয়ান, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আইয়ুব আলী, দপ্তর সম্পাদক মো. বাবু ওরফে দারোয়ান বাবা ও ৯ নম্বর ওয়ার্ডের মো. ইসহাক মাদকসহ বিভিন্ন কারবার নিয়ন্ত্রণ করতে থাকেন। অন্যদিকে, বস্তির নিয়ন্ত্রণ পেতে মরিয়া ইউনিয়ন বিএনপির প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক লিটন হাওলাদার। তার সহযোগী চনপাড়া স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা ২ নম্বর ওয়ার্ডের রাব্বানি ও শাকিল এবং ৭ নম্বর ওয়ার্ডের আব্দুল করিম। করিম আবার লিটনের আপন ভাগনে।
মাদক কারবারের নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্য নিয়ে সর্বশেষ গত ১৮ মার্চ রাতে সংঘর্ষ হয় দু’পক্ষের। ভোর পর্যন্ত দফায় দফায় সংঘর্ষ, গোলাগুলি এবং বাসাবাড়িতে চলে লুটপাট। গুলিতে ইউনিয়ন যুবদল নেতা মো. বাবু ওরফে দারোয়ান বাবুর ভাই মো. হাসিব নিহত হন। পরে রাব্বানী, শাকিল, করিমসহ ১৬ জনের বিরুদ্ধে রূপগঞ্জ থানায় মামলা করেন তার ভাই যুবদল নেতা দারোয়ান বাবু। তার অভিযোগ, ‘চনপাড়ায় মাদকের অন্তত ২০০ স্পট রয়েছে। ৫ আগস্টের পর শামীম হোসেনসহ যুবদল নেতারা মাদকের বিরুদ্ধে সোচ্চার হন। কিন্তু স্বেচ্ছাসেবক দলের রাব্বানি, শাকিল ও করিম মাদক কারবার করায় শামীমের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন।’
রূপগঞ্জ থানা যুবদলের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আমিনুল ইসলাম জানান, সংঘর্ষের ঘটনায় থানা যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক শামীম হোসেনকে বহিষ্কার করা হয়েছে।
জানা যায়, ৫ আগস্টের পর থেকে যুবদল নেতা শামীম হোসেনের একক নিয়ন্ত্রণ চলছিল চনপাড়ায়। যুবদলের কমিটিতে থাকা রাব্বানি, করিম, শাকিলসহ তাদের লোকজন ছিল শামীমের ডান হাত। তবে মাস তিনেক আগে তারা শামীমকে ছেড়ে স্বেচ্ছাসেবক দলে নাম লেখান। এর পরই শামীম হোসেনের প্রতিপক্ষ হয়ে ওঠেন রাব্বানি-করিমের গ্রুপ। বস্তি নিয়ন্ত্রণে দু’পক্ষই শক্তি প্রদর্শন করতে থাকে। অবাধে দখল, চাঁদাবাজি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে লুটপাট, মাদক কারবারসহ নানা অপরাধ করে আসছে।
স্থানীয়রা জানান, গত সেপ্টেম্বরে ১ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের কর্মী মনির হোসেন এবং চনপাড়া ইউনিট স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি শফিকুলের মোটরসাইকেল ছিনিয়ে নেন লিটন হাওলাদার ও তার ভাগনে আব্দুল করিম। গত ফেব্রুয়ারিতে স্বামীর অনুপস্থিতিতে ৭ নম্বর ওয়ার্ডের এক নারীর বাসায় জোর করে ঢুকে শ্লীলতাহানির চেষ্টা করে লিটন। তার চিৎকারে লোকজন জড়ো হলে লিটন পালিয়ে যান। আগস্টের শেষ দিকে ৪ নম্বর ওয়ার্ডের এক নারীর বাসায় ঢুকলে লোকজন ধরে লিটনকে গণধোলাই দেন। ৭ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের পলাতক আনিসুর রহমানের দুটি দোকান দখল করে স্বেচ্ছাসেবক দলের ক্লাব বানিয়েছেন রাব্বানি ও করিম। একই ওয়ার্ডের দুটি সমিতির অফিস দখল করে ব্যবসা করছেন গ্যাস সিলিন্ডারের। চনপাড়ায় প্লট বা ঘর বেচাকেনা হলে লিটনকে ২০ থেকে ৫০ হাজার টাকা চাঁদা দিতে হয়। টাকা না দিলে লুটপাট চালানো হয় বাসায়। মার্চের শুরুতে ৭ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা মাসুম একই ওয়ার্ডে একটি প্লট কেনেন সাড়ে ৫ লাখ টাকায়। মাসুমের কাছে ৫০ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করেন লিটন। চাঁদা না দেওয়ায় তার বাড়িতে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট চালায় লিটনের লোকজন। ভয়ে মাসুম আইনের আশ্রয় নেননি।
অন্যদিকে, নিরীহ মানুষের বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে তালা মেরে চাঁদা আদায় করছেন শামীম ও তার অনুসারীরা। আওয়ামী লীগের পলাতক নেতাদের ঘরবাড়িতে লুটপাট চালায় তারা। গত সেপ্টেম্বরে চনপাড়ার একটি প্রতিষ্ঠানে হামলা চালায় শামীম ও তার লোকজন। প্রতিষ্ঠানটির কর্মচারীদের মারধর করে ১ লাখ টাকা চাঁদা নেন।
অভিযোগের বিষয়ে যোগাযোগ করেও লিটন হাওলাদার, আব্দুল করিম, রাব্বানি ও শাকিলের বক্তব্য জানতে পারেনি। শামীম হোসেনের ফোন নম্বরও বন্ধ পাওয়া যায়নি।
রূপগঞ্জ থানা স্বেচ্ছাসেবক দলের আহ্বায়ক রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘চনপাড়ার আধিপত্য নিয়ে স্থানীয় যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে। করিম, রাব্বানি, শাকিলসহ অপরাধ কার্যক্রমে জড়িতদের সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।’
রূপগঞ্জ থানার ওসি লিয়াকত আলী বলেন, ‘চনপাড়ায় আধিপত্য বিস্তার নিয়ে একাধিক গ্রুপ সক্রিয়। গুরুত্ব বিবেচনায় চনপাড়ায় মাঝেমধ্যে ব্লক রেইড হচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘শামীম, করিম, রাব্বানিসহ অনেকের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা রয়েছে। তাদের ধরতে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।’