Logo
Logo
×

রাজনীতি

হাতেমকে বিকেএমইএ’র সভাপতি বানান সেলিম ওসমান

বিগত স্বৈরাচারের দোসর ছিলেন হাতেম

হাতেমকে বাংলাদেশ এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি করেন সালাম মুর্শেদী

Icon

যুগের চিন্তা রিপোর্ট

প্রকাশ: ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম

বিগত স্বৈরাচারের দোসর ছিলেন হাতেম

সেলিম ওসমান, ঝুট ব্যবসায়ী মোহাম্মদ হাতেম, সালাম মুর্শেদী

ছাত্রজনতার গণঅভ্যুত্থানের পর স্বৈরাচারের পতনের পর থেকে নারায়ণগঞ্জের ঝুট ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত মোহাম্মদ হাতেম নিজেকে স্বৈরাচারের দোসর ছিলেননা বলে প্রমাণিত করার আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। এমনকি নারায়ণগঞ্জের গডফাদার খ্যাত ওসমান পরিবারের সাথে তার কোন সখ্যতা ছিলোনা এমন অলীক কাল্পনিক বিষয় প্রমাণের চেষ্টা করছেন। ফ্যাসিস্টদের পলায়নের পর দূর থেকে হাতেমের পক্ষে ওসমান অনুসারী পদলেহনকারী কিছু ব্যবসায়ীদের দিয়ে সেই আজব দাবিই প্রমাণের চেষ্টা করছেন। এতে বিস্মিত গোটা নারায়ণগঞ্জ। ঝুটব্যবসায়ী হাতেমের পক্ষে সেসব ওসমান দোসর ব্যবসায়ীরা জেলা প্রশাসকের কাছে যুগের চিন্তার ডিক্লারেশনের দাবি জানিয়ে যে স্মারকলিপি দিয়েছেন সেটিতে তাই বলার চেষ্টা করেছেন। অথচ নারায়ণগঞ্জসহ দেশের নামকরা ব্যবাসায়ীরা একবাক্যে ফ্রাঙ্কস্টাইন সেলিম ওসমানের অন্যতম দোসর হিসেবে পরিচিত হাতেমকে গত ১৬ বছর ব্যবসায়ীদের উপর ছড়ি ঘোরাতে দেখেছেন। এই হাতেমকে দিয়েই সেলিম ওসমান বহু ব্যবসায়ীকে নারায়ণগঞ্জ থেকে ব্যবসা ছাড়া করেছেন, গডফাদার সেলিম ওসমানের হয়ে হাতেমই টাকা উঠাতো, ঝুট বিতরণ করতো, ব্যবসায়ীদের জিম্মি করে রাখতো। মোটা দাগে বললে ২০১০ সাল থেকে সেলিম ওসমানের প্রেসক্রিপশনের হাতেম কাজ করতো। ব্যবসায়ীদের আতঙ্ক সেলিম ওসমানের ডায়াবেটিসসহ নানা জটিলতার কারণে ডায়াপার পরেই চলাফেরা করতে হতো। আর তার সাথে ছায়ার মতো থাকতো এই হাতেম। দেশে কিংবা দেশের বাইরে সেলিম ওসমান যেখানেই থাকতো না কেন হাতেমকে নির্বাহী সভাপতি হিসেবে তার সকল আদেশ নির্দেশ মোতাবেক কাজ করতে হতো। বিসিক এলাকায় কিংবা ফতুল্লার উইজডমের মধ্যে যেখানে সেলিম ওসমান থাকতো সেখানেই তাঁর গাড়িতে রাখা ডায়াপারের মতোই হাতেম হুকুম তামিলের জন্য লেগে থাকতেন। এতো বিশস্ব হাতেমকেই তাই সেলিম ওসমান পালিয়ে যাওয়ার পর গত ২৫ আগস্ট অসুস্থতার কথা বলে পাঠানো বিকেএমইএর পদত্যাগপত্রে সুস্পষ্টভাবে হাতেমকে সভাপতি করার নির্দেশ দেন। পদত্যাগপত্রের চতুর্থ পয়েন্টে সেলিম ওসমান উল্লেখ করেন,  আপনারা সকলেই স্বীকার করবেন যে, বর্তমান নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম দীর্ঘদিন ধরে আমাকে , বিকেএমইএকে ও নীট সেক্টরের উন্নতির জন্য সহায়তা করে গেছে।  বর্তমান প্রেক্ষাপটে আমি পরিচালনা পর্ষদের সকলের কাছে অনুরোধ রাখতে চাই, আমার বিদায়ের পর পর বিকেএমইএ ও নীট সেক্টরের উন্নয়ন কল্পে মোহাম্মদ হাতেম এর অবদান এবং প্রচেষ্টার কথা স্মরণ কওে তাকে এই নতুন বিকেএমইএ  পরিচালনার জন্য সভাপতির দায়িত্ব অর্পণ করা হোক।  

অথচ ওসমান দোসর সুবিধাপ্রাপ্ত কিছু ব্যবসায়ী স্মারকলিপিতে দাবি করেছেন, হাতেম সেলিম ওসমানের বিরোধী হিসেবে বিকেএমইএতে ছিলেন। তাহলে প্রশ্ন উঠেছে, বিকেএমইএতে কি এমন মধু ছিল যাতে হাতেমকে সেলিম ওসমানের সাথে নির্বাহী হিসেবে বছরের পর বছর থাকতে হলো। সেলিম ওসমানের দোসর ও আজ্ঞাবহ হিসেবে যে হাতেম গত ১৬ বছর কাজ করেছে তা যেমন প্রশাসন, পুলিশ, ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ, জনগণ, সুধীসমাজ সবাই জানে। ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের সময় এই হাতেমের কথাতে ফতুল্লা মডেল থানা চলতো। ফতুল্লা মডেল থানা সেই সময়ে তাই করতো যা হাতেম বলতো। এককথায় ওসমানদের ছায়ায় হাতেম বিসিক এলাকায় সর্বেসর্বা হয়ে উঠেছিল। আর তাই সেলিম ওসমান হাতেমকেই ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের পর তার দোসরদের নিরাপত্তা দেয়ার জন্য সবচাইতে বড় দায়িত্বটা তাকে দেন।

হাতেম যে কুখ্যাত ওসমান পরিবারের কতটা ঘনিষ্ট ছিল এবং সেলিম ওসমানের আস্থাভাজন ছিলো সেটি আরেকটি বিষয় খেয়াল করলে পরিষ্কার হয়ে যাবে। ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের সময় নিয়ম করা হয় এমপি (সংসদ সদস্য) থাকাকালীন কেউ কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গভর্র্নিং বডির সভাপতি হতে পারবেননা। তৎসময়ে নারায়ণগঞ্জ কলেজের গভর্নিং বডির সভাপতি ছিলেন সেলিম ওসমান। হাসিনা সরকারের ওই সিদ্ধান্তে সেলিম ওসমান তখন এই হাতেমকেই নারায়ণগঞ্জ কলেজের গভর্নিং বডির সভাপতি বানিয়েছিলেন। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর সভাপতি পদ শুন্য ঘোষণার আগ পর্যন্ত সেলিম ওসমানের জায়গায় হাতেমই নারায়ণগঞ্জ কলেজের গভর্নিং বডির সভাপতি হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন। সেলিম ওসমানের কতটা ঘনিষ্ট দোসর হাতেম তা বুঝা যাবে আরেকটি বিষয় পরিষ্কার হলে। সেলিম ওসমানের স্ত্রী নাছরিন ওসমানের পিতার বাড়ি খুলনা। অর্থাৎ সেলিম ওসমানের শ^শুরবাড়ি খুলনায়। সেখানেই সেলিম ওসমানের গরুর ফার্মসহ নানা ব্যবসা রয়েছে। ওই এলাকার সর্বশেষ এমপি বিতর্কিত সালাম মুর্শেদী। তিনি বাংলাদেশ এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (ইএবি) এর সভাপতি ছিলেন স্বৈরাচার সরকারের পতনের আগ পর্যন্ত। ব্যবসায়ী সমিতির শীর্ষ পদগুলো তিনি ব্যবহার করেছেন ব্যবসা সম্প্রসারণ এবং নিজের ইচ্ছা পূরণের হাতিয়ার হিসেবে। নির্বাচনে জালিয়াতি, আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা এবং গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টার অভিযোগ তাঁর বিরুদ্ধে উঠেছে বহুবার। প্রিমিয়ার ব্যাংকের পরিচালক হিসেবে প্রভাব খাটিয়ে কয়েকজন তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা ভুয়া ঋণ মঞ্জুরের অভিযোগ ওঠে সালাম মুর্শেদীর বিরুদ্ধে। গত ২৩ জুন দুদক বিষয়টি নিয়ে তদন্ত শুরু করে এবং মুর্শেদীর ঘনিষ্ঠ চার কর্মকর্তাকে দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেন আদালত। দুদক এখনও বিষয়টির তদন্ত করছে। এই সালাম মুর্শেদী বাংলাদেশ এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (ইএবি) এর সভাপতি পদেও জন্য তার এবং সেলিম ওসমানের অন্যতম দোসর মোহাম্মদ হাতেমকেই বেছে নিয়েছেন। সেলিম ওসমান তার পদত্যাগের প্রেসক্রিপশনে বিকেএমইএর সভাপতি বানিয়েছেন হাতেমকে। আবার স্বৈরাচার পলায়নের পর সালাম মুর্শেদীর প্রেসক্রিপশনে  বাংলাদেশ এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (ইএবি) এর সভাপতিও এই হাতেম। এই ঘটনাগুলোই প্রমাণ করে ঝুট ব্যবসায়ী মোহাম্মদ হাতেম স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকারের কত বড় দোসর!

জুলাইয়ে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় যখন প্রচুর ছাত্র-জনতা মারা যাচ্ছিল। ফ্যাসিস্ট হাসিনার থাবায় রাজপথে ছাত্রজনতার রক্তের ফোয়ারা বইছিল, ১৮ জুলাই থেকে ছাত্র-জনতার রক্তের যেই স্রোত রক্ত স্রোতে বইছিল ঠিক সেই সময় ২২ জুলাই ব্যবসায়ীদের সঙ্গে ফ্যাসিস্ট হাসিনার ডাকে গণভবনে গিয়ে বক্তব্য দেন মোহাম্মদ হাতেম। তার সেই বক্তব্য এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও ভাইরাল। বিকেএমইর তৎকালীন নির্বাহী সভাপতি (বর্তমান সভাপতি) মো. হাতেম বলেন, 'এরকম একটি সঙ্কটকালে আমরা এমন সিচুয়েশন দেখবো সেটা আশা করিনি। যে তান্ডব আমরা গত কয়েক দিনে দেখেছি, আমরা আশা করব, সরকারের গোয়েন্দা সংস্থাসহ অন্য যারা আছেন, তারা তা উদ্ঘাটন করবেন এবং আইনের আওতায় আনবেন। আমরা সরকারের পাশে সবসময়ই ছিলাম, এখনো আছি, ভবিষ্যতেও থাকবো।’
ব্যবসায়ীরা জানায়, হাতেমের সাথে যে স্বৈরাচারদের সম্পর্ক শেষ এমনটি নয়। হাতেমের সাথে এখনও পালিয়ে থাকা সেলিম ওসমান এবং ওসমান পরিবারের যোগাযোগ আছে। ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, সেলিম ওসমানের পারপাস সার্ভ করছে হাতেম। সেলিম ওসমানের সময়কালে যেসকল ব্যবসায়ীদের সেলিম ওসমান নেতা বানিয়েছেন তাদের রক্ষা করার দায়িত্ব দিয়েছেন তাদের সর্বশ্রেষ্ঠ দোসর মোহাম্দ হাতেমকে। পদলেহনকারী ব্যবসায়ীরা তাই হাতেম ধরা পড়ে যাওয়ায় এখন বেশ বদল করার চেষ্টা করছেন। যার প্রমাণ পাওয়া যায় বিকেএমইএর সিনিয়র সহসভাপতি মনসুর আহমেদের কাণ্ডে। ২৫ আগস্ট যখন সেলিম ওসমান প্রেসক্রিপশন করে হাতেমকে নির্বাহী সভাপতি থেকে সভাপতি বানালো তখন কিছুটা রুষ্ঠ হন মনসুর আহমেদ। কেননা গঠনতন্ত্র অনুযায়ী সেলিম ওসমানের বর্তমানে বিকেএমইর সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট মনসুরেরই সভাপতি হওয়ার কথা। তা না করে, সেলিম ওসমান তার খুব কাছের দোসর হাতেমকে বেছে নেন। ফলে ২৮ নভেম্বর বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি মনসুর আহমেদ ও পরিচালক খুরশীদ আহমেদ তানিম পদত্যাগ করেন। পদত্যাগপত্রে তারা দুইজনই বিকেএমইএ’র সভাপতি মোহাম্মদ হাতেমকে ‘ফ্যাসিস্টের দোসর’ উল্লেখ করে বর্তমান নেতৃত্বের বিরুদ্ধে ফ্যাসিবাদী আচরণ এবং অনৈতিক কার্যক্রমের অভিযোগ তুলেছেন। ২৮ নভেম্বর) সংগঠনের নির্বাহী সভাপতি বরাবর পদত্যাগ দেন এ দুই নেতা।  তাদের অভিযোগ, ‘বর্তমান সভাপতি মোহাম্মদ হাতেমের নেতৃত্বে সংগঠনের মূল্যবোধ ও নৈতিক মানদণ্ড ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তারা বলেন, ‘আমরা লক্ষ্য করেছি যে বর্তমান নেতৃত্বের অধীনে এমন কিছু কর্মকাণ্ড ঘটছে যা আমাদের আমাদের সংগঠনের মূলনীতি- ন্যায়পরায়ণতা, সততা এবং গণতান্ত্রিক চর্চাকে লঙ্ঘন করছে।” গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে পাওয়া তথ্যের বরাতে সংগঠনের এ দুই পরিচালক বলেন, “বর্তমান সভাপতি (মো. হাতেম) এবং কিছু সিনিয়র বোর্ড সদস্যরা ফ্যাসিজমকে সহযোগিতা করেছে এবং প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জুলাই-আগস্টের গণহত্যা ও সাধারণ ছাত্র-জনগণের ওপর নির্যাতনকারী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে জড়িত ছিলেন।” তারা আগামী ৫ ডিসেম্বরে ডাকা সংগঠনের বিশেষ সাধারণ সভা (ইজিএম) ও বার্ষিক সাধারণ সভা (এজিএম) বাতিলের আহ্বান জানান।  তারা আরও বলেন, “মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে এবং আমাদের বিবেকের তাড়নায়, আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে, যারা এই ফ্যাসিবাদকে সমর্থন করে, তাদের সঙ্গে আর কাজ করব না। আশ্চর্যের বিষয় এরদুই দিন পরে অদৃশ্য এক চাপে নিজের পদত্যাগপত্র প্রত্যাহার করে নেন মনসুর। তবে নিজের পদত্যাগপত্রে গোয়েন্দা সংস্থার বরাতে যে তথ্য দিয়েছেন তা ডকুমেন্ট হিসেবেই রয়ে যায়। গোয়েন্দা সংস্থার বরাতে মনসুর বলেন, “বর্তমান সভাপতি (মো. হাতেম) এবং কিছু সিনিয়র বোর্ড সদস্যরা ফ্যাসিজমকে সহযোগিতা করেছে এবং প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জুলাই-আগস্টের গণহত্যা ও সাধারণ ছাত্র-জনগণের ওপর নির্যাতনকারী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে জড়িত ছিলেন।” আর এই মনসুরই এখন চাপে তাপে হাতেমের পক্ষে জেলা প্রশাসকের কাছে ওসমান দোসর ব্যবসায়ীদের একত্রিত করে ২২ ডিসেম্বর জেলা প্রশাসকের কাছে স্মারকলিপি দেন। ফলে সেলিম ওসমান, তার দোসর ঝুট ব্যবসায়ী মোহাম্মদ হাতেম এবং ওসমানদের অন্যান্য দোসরদের নিজস্ব কার্যকলাপেই সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হাতেম ওসমানদের দোসর হিসেবে কী করতে চাইছেন।

Abu Al Moursalin Babla

Editor & Publisher
ই-মেইল: [email protected]

অনুসরণ করুন