নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট আহবায়ক কমিটি, ঐক্যবদ্ধ থাকার প্রত্যয়
পাঁচ নেতার প্যাচের কমিটি

মাহফুজ সিহান
প্রকাশ: ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম

নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির নতুন আহবায়ক কমিটির নেতৃবৃন্দ
যে কোন রাজনৈতিক দলের জন্যই নারায়ণগঞ্জের সকল কমিটি গঠন দেয়ার সময় বিশেষ নজর থাকে। বিএনপির মতো বড় দলের ক্ষেত্রে এই ধরণের সতর্কতা আরো বেশি। প্রায় ৪১ দিন আগে মুহাম্মদ গিয়াসউদ্দিন- গোলাম ফারুক খোকনের নেতৃত্বাধীন জেলা কমিটি বিলুপ্ত করা হয়। মাঝের এই সময়টা ছিল শুধু চমকের অপেক্ষা। ৫ সদস্য বিশিষ্ট জেলা বিএনপির আহবায়ক কমিটি দেয়ার পর নারায়ণগঞ্জের নেতাকর্মীরা যতখানি আনন্দিত হওয়ার কথা তাঁর চেয়ে বেশি বলা চলে ধাক্কা খেয়েছে। এর কারণ হিসেবে এই আহবায়ক কমিটিতে স্থান পাওয়া ৫ নেতার নাম দেখে। বিএনপির মতো বড় দলে নেতৃত্বে প্রতিযোগিতা থাকাটা স্বাভাবিক তবে এই প্রতিযোগিতা দীর্ঘদিন ধরেই অসম গতিতে চলে আসছে। এখন এই পাঁচ নেতা একত্রিত হয়ে কী করে জেলা বিএনপির সকল সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে পারবেন এই নিয়েই নেতাকর্মীদের মধ্যে চিন্তার ভাঁজ। তাই এই আহবায়ক কমিটিকে নেতাকর্মীরা নির্বাচনের আগে প্যাচের কমিটি হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। গত ২ ফেব্রুয়ারি বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী স্বাক্ষরিত এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে প্রকাশিত আংশিক কমিটিতে নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও বিএনপির নির্বাহী কমিটির অন্যতম সদস্য অধ্যাপক মামুন মাহমুদকে আহ্বায়ক ও বিএনপির নির্বাহী কমিটির আরেক সদস্য মোস্তাফিজুর রহমান ভূঁইয়া দিপুকে ১ নং যুগ্ম আহ্বায়ক করা হয়েছে। এ ছাড়াও জেলা বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক মাশুকুল ইসলাম রাজিব ও শরীফ আহমেদ টুটুলকে যুগ্ম আহ্বায়ক এবং জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি মুহাম্মদ গিয়াসউদ্দিনকে ১নং সদস্য করে ৫ সদস্য বিশিষ্ট আহ্বায়ক কমিটি ঘোষিত হয়। জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি মুহাম্মদ গিয়াসউদ্দিনকে নিয়ে ব্যাপক নেতিবাচক প্রচারণা চালানোর পরও গিয়াসউদ্দিনের প্রতি ঠিকই আস্থা ধরে রেখেছে বিএনপির হাইকমান্ড। আগের কমিটি থেকে বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের জন্য গোলাম ফারুক খোকন জায়গা হারিয়েছেন।
বিএনপির নেতাকর্মীদের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ার কারণ হিসেবে জানা গেছে, বিলুপ্ত জেলা বিএনপির সম্মেলন হওয়াকালীন সময়েই সাবেক ছাত্রদল নেতা, জেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম আহবায়ক মাশুকুল ইসলাম রাজীব সম্মেলনে গোলাম ফারুক খোকনকে ছাড় দেয়ার বড় মনমানসিকতা দেখানোয় খোদ বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান রাজীবকে এই কমিটিতে মূল্যায়িত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কোন সদস্য সচিবের নাম ঘোষণা না করলেও এই কমিটিতে রাজীবকে যুগ্ম আহবায়ক হিসেবে স্থান দেয়া হয়েছে। এছাড়া নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির আহবায়ক কমিটিতে মূলত সিদ্ধিরগঞ্জ থানা এলাকা এবং রূপগঞ্জ উপজেলাকে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। জেলা বিএনপির আহবায়ক হিসেবে অধ্যাপক মামুন মাহমুদ ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপির প্রাথমিক মনোনয়নপত্র পেয়েছিলেন নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনে। তিনি বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য এবং সাবেক জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক। এই আসনে সাবেক সাংসদ, জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি মুহাম্মদ গিয়াসউদ্দিনও মনোনয়ন পেয়েছিলেন। একই নির্বাচনী আসনে এই দুইজনের নেতাকর্মীর মধ্যেই ব্যাপক প্রতিযোগিতা এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতা রয়েছে। আংশিক এই কমিটিতে দুইজনকেই সম্মানিত করলেও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে ব্যাপক বিপত্তি ঘটতে পারে বলে দুই নেতার অনুসারীদের মধ্যেই ব্যাপক আলোচনা। একই বিষয় রূপগঞ্জের ক্ষেত্রেও। গোলাম ফারুক খোকনকে বাদ দিলেও বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য মোস্তাফিজুর রহমান দিপু ভূঁইয়া জেলা বিএনপির কমিটিতে প্রথম যুগ্ম আহবায়ক হিসেবে স্থান পেয়েছেন। তবে দিপু ভূঁইয়ার এই অন্তর্র্ভূক্তিতে প্রতিযোগিতা আছে খোদ রূপগঞ্জেই। কেননা পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট কমিটিতে যুগ্ম আহবায়ক স্থান পেয়েছেন শরীফ আহমেদ টুটুল। তিনি দাউদপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান। এবং বড় একটি সময় জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি কাজী মনিরুজ্জামান মনিরের ঘনিষ্ঠ হিসেবেই পরিচিত। দিপু ভূইয়া ও কাজী মনির দুইজনেই ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপির প্রাথমিক মনোনয়ন পেয়েছিলেন। যদিও চূড়ান্ত মনোনয়ন পান কাজী মনির। আগামী নির্বাচনের আগে এই দুই পক্ষের মধ্যেই মনোনয়ন প্রতিযোগিতা পাবে এটিই অনুমিত। আহবায়ক কমিটিতে এই চারজন ব্যতিত মাশুকুল ইসলাম রাজীবই শুধু নারায়ণগঞ্জ শহর এলাকার বাসিন্দা। সিদ্ধিরগঞ্জ, রূপগঞ্জের চার নেতার সমন্বিত সিদ্ধান্তে রাজীবের গুরুত্ব সবচাইতে বেশি পাবে বলে মতামত বিশ্লেষকদের। সংখ্যাগরিষ্ট হিসেবে সিদ্ধান্ত নিতে গেলেও রাজীবের মতামতের উপর বেশ বড় আকারে নির্ভর করতে হবে গোটা কমিটিকে।
বিএনপির জেলার সব নেতার হতাশার কমিটি বলে মনে করা হচ্ছে এই আহবায়ক কমিটিকে। কেননা, জেলা বিএনপির কমিটি যখন বিলুপ্ত করা হয় তখন গিয়াসউদ্দিনের বিরুদ্ধে বেশ সরব ছিলেন ফতুল্লার বিএনপির নেতারা। সাবেক বিএনপি নেতা শাহ আলম, ফতুল্লা থানা বিএনপির সভাপতি শহিদুল ইসলাম টিটু, সাংগঠনিক সম্পাদক রিয়াদ মোহাম্মদ চৌধুরীও কমিটিতে শীর্ষ পাঁচে ঠাঁই পাওয়ার ব্যাপারে আশবাদী ছিলেন। কিন্তু ফতুল্লার কেউই জেলা বিএনপির তালিকায় নিজের নাম লেখাতে পারেনি। শুধু যে ফতুল্লা এমনটি নয়, সোনারগাঁ, আড়াইহাজার এলাকার কেউউ জেলা বিএনপির এই ছোট তালিকায় ঠাঁই পাননি। ফলে ফতুল্লা, আড়াইহাজার, সোনারগাঁ এসব এলাকার নেতাদের এই আহবায়ক কমিটির নেতাদের সদিচ্ছার উপর রাজনীতি পরিচালনা করতে হতে পারে বলে মত বিশ্লেষকদের। আগামী নির্বাচনের আগে নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির এই কমিটির নেতাদের কাছে বিরাট চ্যালেঞ্জ হয়ে দায়িত্ব পতিত হয়েছে। বিশেষ করে যে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে এই নেতাদের মধ্যেই ব্যাপক মতানৈক্য হওয়ার সম্ভাবনা হবেই বলে মত রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের। কেননা, একই দলের হলেও নেতাদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির অগ্রযাত্রা অনেক ক্ষেত্রে বাধাগ্রস্ত হবে এবং এটি অতিদ্রুত আগামী নির্বাচনের আগেই প্রত্যক্ষ হবে বলে মত রাজনৈতিক বোদ্ধাদের। জেলার বিভিন্ন থানা এবং উপজেলার প্রথম সারির নেতাদের উপেক্ষা করায় সাংগঠনিক শ্লথ তৈরি হবে বলে মনে করেন তারা। উপজেলাভিত্তিক আগের বিএনপি কমিটিগুলো ভেঙে নতুন কমিটি করার ক্ষেত্রেও বলয়ভিত্তিক প্রতিযোগিতা নিয়ে ব্যাপক দ্বন্দ্ব ও পারস্পরিক দোষারোপ করার ঘটনার অবতারণা অনেকটাই অনুমিত বলছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। যদিও নতুন কমিটিতে স্থান পাওয়া ব্যক্তিরা কেন্দ্রীয় রোষানলে পড়ার ভয়ে এই বিষয়ে এখনও নীরব ভূমিকায় রয়েছেন এবং সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করার ব্যাপারে প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন।
যদিও এ বিষয়ে জেলা বিএনপির নবাগত আহ্বায়ক অধ্যাপক মামুন মাহমুদ যুগের চিন্তাকে বলেন, ‘আমাদের দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়ে কমিটি দিয়েছেন অতি অল্প সময়ের মধ্যে। আমি সকলকে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানাবো আমাদের লক্ষ অর্জন না হওয়া পর্যন্ত। বিএনপি যেহেতু একটি বড় দল সেই ক্ষেত্রে দলের মধ্যে অনেকের সাথে অনেকের নানান বিষয় নিয়ে দ্বন্দ্ব থাকতে পারে কিন্তু দলের স্বার্থে আমরা সকলেই ঐক্যবদ্ধ। আমি সবাইকে নিয়ে কাজ করবো। কারও সাথে আমার ব্যক্তিগত বিরোধ নেই।’
জেলা বিএনপির ১ নং যুগ্ম আহ্বায়ক মোস্তাফিজুর রহমান ভূঁইয়া দিপু যুগের চিন্তাকে বলেন, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত। তিনি যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তাকে স্বাগত জানাই। বিগত দিনে ও জেলা বিএনপি ঐক্যবদ্ধ ছিলো আগামীতে ও ঐক্যবদ্ধভাবে সকল কাজ করবো।
জেলা বিএনপির নবাগত যুগ্ম আহ্বায়ক মাসুকুল ইসলাম রাজীব যুগের চিন্তাকে বলেন, বাংলাদেশের মানুষের কথা চিন্তা করে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তাকে স্বাগত জানাই। আমরা সকলেই ঐক্যবদ্ধ হয়ে নারায়ণগঞ্জের মানুষের আশা আকাঙ্খার প্রতিফলন ঘটানোর জন্য যা যা করা দরকার তাই করবো। এ ব্যাপারে আমরা অঙ্গীকারবদ্ধ। আমরা সবাই মিলে এ দলটা করতে চাই।
জেলা বিএনপির নবাগত যুগ্ম আহবায়ক শরীফ আহমেদ টুটুল যুগের চিন্তাকে বলেন, চমৎকার কমিটি হয়েছে। ব্যক্তি পছন্দ আলাদা হলেও দলের স্বার্থে সম্মিলিত কাজ হবে।
জেলা বিএনপির নবাগত কমিটির একমাত্র কার্যকরী সদস্য ও জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মুহাম্মদ গিয়াসউদ্দিন যুগের চিন্তাকে বলেন, তারেক রহমানের বিচক্ষণতার আরেকটি জ¦লন্ত প্রমাণ এই কমিটি। যারা আমাকে এবং আমার ছেলেদের বিরুদ্ধে লাগাতার অপপ্রচার চালিয়েছে, তাদের জন্য এই কমিটিই যোগ্য জবাব। এই কমিটির মধ্যে থাকা নেতাদের মধ্যে আমাকে একমাত্র সদস্য হিসেবে পদায়ন করে সম্মানিত করায় আমি দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। সবাইকে সাথে নিয়ে আমরা সংগঠনকে আরো বেশি গতিশীল করবো।