Logo
Logo
×

রাজনীতি

হাসিনার নির্দেশেই সাত খুনের মামলা থেকে বাদ দেয়া হয় শামীম ওসমানকে

Icon

প্রকাশ: ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম

হাসিনার নির্দেশেই সাত খুনের মামলা থেকে বাদ দেয়া হয় শামীম ওসমানকে

হাসিনার নির্দেশেই সাত খুনের মামলা থেকে বাদ দেয়া হয় শামীম ওসমানকে

 পেটে ইট বাঁধা অবস্থায় শীতলক্ষ্যার নদ থেকে ভেসে উঠছিলো একের পর এক মৃতদেহ। নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যার পাড় তখন স্বজনদের আহাজারি আর আর্তনাতে যেনো ভারি হয়ে উঠেছিলো। ডুবুরী দিয়ে একে একে তুলে আনা হয়, সাতটি মরদেহ। আর তা দেখে কান্নায় ফেটে পড়েছিলেন খুন হওয়া সেই মানুষগুলোর স্বজনরা। যাতে সরাসরিভাবে জড়িত ছিলেন  স্বৈরাচার আওয়ামী লীগের দোসররা। নারায়ণগঞ্জের ইতিহাসে সেই চাঞ্চল্যকর সাতখুনের ঘটনা, যেটা সে সময় নাড়িয়ে দিয়েছিলো গোটা বাংলাদেশকে। অথচ সাতখুনের প্রধান কুশীলব হাসিনার ঘনিষ্ঠ শামীম ওসমান ছিলেন ধরা ছোঁয়ার বাইরে। সে সময় তৎকালীন নারায়ণগঞ্জ কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম এবং আইনজীবী চন্দন সরকারসহ নিখোঁজ হন সাতজন। এর তিনদিন পরই শীতলক্ষ্যা নদী থেকে উদ্ধার করা হয় তাদের লাশ। তদন্তে বেড়িয়ে আসে নির্মম সেই হত্যাকান্ডে র‌্যাবের সরাসরি সংশ্লিষ্টতা। আটক করা হয় র‌্যাব-১১ এর অধিনায়ক তৎকালীন আওয়ামী লীগের প্রতাপশালী মন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার জামাতা কর্নেল তারেক সাঈদসহ বেশ কয়েকজন কর্মকর্তাকে। ঘটনার পরপরই ভারতে পালিয়ে যায় মামলার আরেক অভিযুক্ত নূর হোসেন।


নারায়ণগঞ্জের বেশিরভাগ অবৈধ কাজের গডফাদার খ্যাত এই ব্যক্তিকে বলা হতো শামীম ওসমানের ডান হাত। যদিও সে বছরের জুনেই কলকাতা থেকে নূর হোসেনকে গ্রেপ্তার করে সেখানকার পুলিশ। একবছর পর ২০১৫ সালের নভেম্বরে তাকে বাংলাদেশ পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। পরবর্তীতে আদালতের বিভিন্ন বিচারের কার্যক্রম শেষে নূর হোসেন, তারেক সাঈদ, মোহাম্মদ ও মেজর আরিফ হোসেনসহ ১৫জনের মৃত্যুদন্ড বহাল রেখে বাকিদের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদন্ড দেন হাইকোর্ট। কৌশলে বাদ দেয়া হয় সাতখুনের মাস্টার মাইন্ড হাসিনার ঘনিষ্ঠ শামীম ওসমান, তৎকালীন নারায়ণগঞ্জ পুলিশ সুপার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যার এফ. রহমান হলের সাবেক সভাপতি নুরুল ইসলামসহ বেশ কয়েকজনকে। তবে কেনো এই হত্যাকান্ড সেই বিষয়টি থেকে যায় আড়ালেই। সেই উত্তর পরিষ্কার হয় ৫ আগষ্টে হাসিনা পতনের পরপরই। সে মামলার তদন্তে দায়িত্বে থাকা মূলত সাতখুনের এই কলঙ্কিত ঘটনার সাথেও জড়িত থাকার অভিযোগ পাওয়া যায় র‌্যাবের সাবেক গোয়েন্দা প্রধান মেজর জেনারেল অবসর প্রাপ্ত জিয়াউল হক। ছাত্রজনতার বিপ্লবে হাসিনার পতনের পর জিয়াউল হক আটক হলে সাত খুন নিয়ে বেরিয়ে আসে বেশকিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য। সরাসরি শামীম ওসমানের সংশ্লিষ্টতার কথাও উঠে আসে জিয়াউল হকের বয়ানে। ফ্যাসিস্ট হাসিনার সরাসরি সংশ্লিষ্টতার বিষয়ও সামনে আসে। ঘটনার শুরু থেকেই শেখ হাসিনা বিষয়টি জানতেন। এমনকি সাতজনকে অপহরণ ও হত্যা করে শীতলক্ষ্যা নদীতে ফেলে দেওয়ার বিষয়ও জানতেন হাসিনা। একই সাথে মামলা থেকে শামীম ওসমানকে হাসিনার নির্দেশেই বাদ দেয়া হয়েছে বলে জানা যায় জিয়াউলের বয়ানে। ২০১৮ সাথে আসামীদের ফাঁসির আদেশ হলেও সেটি ঝুলিয়ে রাখা হয় হাসিনার নির্দেশেই। এরপর কেঁটে গেছে আরো প্রায় ৬টি বছর। মামলাটি এখনো অপেক্ষায় সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের শুনানির। যে কারণে এখনো সেই প্রমাণিত আসামিদেরও শাস্তির মুখোমুখি হতে হয় নি।



প্রসঙ্গত, ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ আদালতে মামলায় হাজিরা দিয়ে ফেরার পথে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোড থেকে অপহরণ করা হয় নজরুল, তার বন্ধু মনিরুজ্জামান স্বপন, তাজুল ইসলাম, গাড়িচালক জাহাঙ্গীর আলম, আইনজীবী চন্দন সরকার ও তার গাড়িচালক ইব্রাহিমকে। ৩ দিন পর ৩০ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ শীতলক্ষ্যা নদীর বন্দর উপজেলার কলাগাছিয়া শান্তি নগর এলাকা থেকে তাদের হাত-পা বাঁধা লাশ উদ্ধার করা হয়। পরদিন একই জায়গা থেকে উদ্ধার হয় নজরুলের আরেক বন্ধু সিরাজুল ইসলাম লিটনের লাশ। সব লাশের পেটে ছিল আঘাতের চিহ্ন। প্রতিটি লাশ ইটভর্তি দুটি করে বস্তায় বেঁধে নদীতে ডুবিয়ে দেওয়া হয়েছিল।এই ঘটনায় নিহত নজরুল ইসলামের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি ও নিহত আইনজীবী চন্দন সরকারের জামাতা বিজয় কুমার পাল বাদি হয়ে ফতুল্লা থানায় আলাদা দু'টি মামলা করেন।



এছাড়া এই ঘটনার পর নজরুলের শ্বশুর তখন অভিযোগ করেন, ‘র‌্যাবের তিন কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কর্নেল তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মাসুদ রানা ও মেজর আরিফ হোসেন ছয় কোটি টাকার বিনিময়ে এ সাতজনকে অপহরণের পর খুন করে। এরপর ২০১৪ সালের ১১ মে নারায়ণগঞ্জ আইনজীবী সমিতির তৎকালীন সভাপতি সাখাওয়াত হোসেন, সদস্য মাহবুবুর রহমান ইসমাইল ও চন্দন সরকারের জামাতা বিজয় কুমার পালের রিট আবেদনে হাই কোর্ট তিন র‌্যাব কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেয়। নির্দেশের পর প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ১৫ মে পুলিশকে চিঠি দিয়ে কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিওর (সিআরপিসি) অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে বলে। ওইদিন রাতেই মিলিটারি পুলিশের সহায়তায় ঢাকা সেনানিবাসের বাসভবন থেকে তারেক সাঈদ ও মেজর আরিফ হোসেনকে গ্রেপ্তার করে নারায়ণগঞ্জ পুলিশ। পরদিন রাতে নৌ-বাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগের কর্মকর্তারা মাসুদ রানাকে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থানা পুলিশের কাছে তুলে দেয়। আইন শৃংখলা বাহিনীর জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসে পুরো ঘটনা। এ ঘটনার নেপথ্যে ছিলেন ৪ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর নূর হোসেন। ঘটনার পর নূর হোসেন পালিয়ে ভারত গেলে ওই বছরের ১৪ জুন কলকাতার দমদম বিমানবন্দর সংলগ্ন বাগুইআটি থানা পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। পরে ২০১৫ সালের ১৩ নভেম্বর বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে তাকে বাংলাদেশের পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। ১৪ নভেম্বর তাকে নারায়ণগঞ্জ আদালতে হাজির করা হলে বিচারক তাকে জেল হাজতে পাঠায়। এই হত্যা মামলাটি তদন্ত করেন নারায়ণগঞ্জ জেলা গোয়েন্দা পুলিশ। হত্যাকান্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে ৩৫ জনকে আসামি করে ২০১৬ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি অভিযোগ গঠন করে আদালত।  ২০১৭ সালের ১৬ জানুয়ারি নারায়ণগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ সৈয়দ এনায়েত হোসেন আদালতে চাঞ্চল্যকর সাত খুনের মামলায় সাবেক কাউন্সিলর নূর হোসেন ও সাবেক তিন র‌্যাব কর্মকর্তাসহ ২৬ আসামিকে মৃত্যুদন্ড দেয়। দুই মামলায় ৩৫ আসামির মধ্যে বাকি নয়জনকে দেয়া হয়েছে বিভিন্ন মেয়াদের কারাদণ্ড। দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা উচ্চ আদালতে আপিল করলে হাইকোর্ট নারায়ণগঞ্জের আলোচিত সাত খুন মামলার রায়ে কাউন্সিলর নুর হোসেন এবং সাবেক র‌্যাব অধিনায়ক তারেক সাঈদসহ ১৫ জনের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ বহাল রাখেন। বাকি ১১ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন। এছাড়া ৯জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ডের রায় হাইকোর্টেও বহাল রয়েছে।



গত ১৯ নভেম্বর ২০১৮ তারিখে নারায়ণগঞ্জের চাঞ্চল্যকর সাত খুনের ঘটনায় আনা দুই মামলায় ১ হাজার ৫৬৪ পৃষ্ঠার রায় প্রকাশ করা হয়। রায় প্রদানকারী বিচারপতি ভবানী প্রসাদ সিংহ ও বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম রায়ে স্বাক্ষর করেন। পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর ২০১৯ সালের ৩ মার্চ মৃত্যুদণ্ডাদেশ থেকে খালাস চেয়ে হাই কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে দণ্ডপ্রাপ্তরা। এরপর থেকে মামলাটি শুনানির অপেক্ষায় আছে। দীর্ঘ প্রায় সাড়ে ছয় বছর ধরে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে মামলাটি শুনানির অপেক্ষায় আটকে থাকায়  ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন নিহতের স্বজনেরা।

চাঞ্চল্যকর এই মামলার বাদিপক্ষের আইনজীবী ও মহানগর বিএনপির আহবায়ক সাখাওয়াত হোসেন খান বলেন, ‘‘নিম্ন আদালতে এই মামলার রায় দ্রুত হয়েছে। নিম্ন আদালতে সাজার বিরুদ্ধে আসামিরা উচ্চ আদালতে আপিল করলে, হাইকোর্ট আপিলটি দ্রুত নিষ্পত্তি করেন। তবে সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগে মামলাটি দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে আছে, মামলাটি উপস্থাপন করা হয়নি। আসামিপক্ষের লোকজন দীর্ঘদিন থেকেই চেষ্টা করছেন মামলার রায় যেন দ্রুত সম্পন্ন না হয়। তাদের সেই চেষ্টা সফল হয়েছে। আমরা চাই, রায় বহাল রেখে মামলাটি দ্রুত নিষ্পত্তি করা হোক ও এই মামলার রায় কার্যকর করা হোক।

Abu Al Moursalin Babla

Editor & Publisher
ই-মেইল: [email protected]

অনুসরণ করুন