
জেলা বিএনপির ৩৩ সদস্যের বর্ধিত কমিটি অনুমোদন
নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির আংশিক কমিটির ৪৯ দিন পর দলীয় আন্দোলন সংগ্রামে সক্রিয় থেকে নেতৃত্ব দেওয়া নেতাদের মুল্যায়নে কেন্দ্র ঘোষিত পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটিকে ৩৩ সদস্যের বর্ধিত কমিটির অনুমোদন দেয়া হয়েছে। গতকাল সোমবার (২৪ মার্চ) দলটির কেন্দ্রীয় জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী এ পূর্ণাঙ্গ কমিটির অনুমোদন দেন। এই কমিটির মাধ্যমে জেলা বিএনপি আগামীতে রাজপথে আরো জোড়ালো ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হবেন বলে মনে করছেন নেতাকর্মীরা।
এর আগে গত (২ ফেব্রুয়ারি) অধ্যাপক মামুন মাহমুদকে আহ্বায়ক করে ৫ সদস্যের একটি কমিটি ঘোষণা করে বিএনপি। এবার ৩৩ সদস্যের কমিটিতে জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক মোস্তাফিজুর রহমান ভূঁইয়া দিপু, যুগ্ম আহ্বায়ক মাশুকুল ইসলাম রাজীব, শরীফ আহমেদ টুটুল। এছাড়া সদস্য পদে রয়েছেন ১নং সদস্য মুহাম্মদ গিয়াসউদ্দিন, আজহারুল ইসলাম মান্নান, গোলাম ফারুক খোকন, লুৎফর রহমান আবদু, অ্যাডভোকেট মাহফুজুর রহমান হুমায়ুন, মো. ইউসুফ আলী ভূঁইয়া, শহিদুল ইসলাম টিটু, মাজেদুল ইসলাম, মো. মোশারফ হোসেন,
আশরাফুল হক রিপন, মজিবর রহমান ভূঁইয়া, মুশকাত আহমেদ, শাহজাহান মেম্বার, শামসুল হক মোল্লা, মো. বাছির উদ্দিন বাচ্চু, অ্যাডভোকেট আব্দুল বারী ভূঁইয়া, তাসিকুল হক ওসমান, মো. জুয়েল আহমেদ, মাহমুদউল্লাহ, একরামুল কবির মামুন, মো. সিরাজুল ইসলাম, আনোয়ার সাদাত সায়েম, রিয়াদ মোহাম্মদ চৌধুরী, রহিমা শরিফ মায়া, মো. অকিল উদ্দিন ভূঁইয়া, সেলিম হক রূমি, মো. নূরনবী ভূঁইয়া, নাদিম হাসান মিঠু ও হামিদুল হক খান। গত ২০২৩ সালের ১৭ জুন সম্মেলনের মধ্য দিয়ে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন সাবেক সংসদ সদস্য মুহাম্মদ গিয়াসউদ্দিন ও গোলাম ফারুক খোকন। তবে, দেড় বছরেও এই দুই নেতা কমিটি পূর্ণাঙ্গ করতে পারেননি।পরে গত বছরের (২৪ ডিসেম্বর) জেলা বিএনপির কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করে বিএনপির হাইকমান্ড।
এদিকে দীর্ঘদিন পর ধীরে ধীরে উন্নীতির দারপ্রান্তে যাওয়ায় জেলা বিএনপির নেতাকর্মীদের মাঝে উৎসাহ-উদ্দীপনা লক্ষ্য করা যায়। এদিকে জেলা বিএনপির কমিটিতে আরো গতিশীল করতে গত (১০ ফেব্রুয়ারী) নির্দেশনা দেয়া হয়েছিলো কেন্দ্র থেকে। এতে বলা হয়েছিল, সাত দিনের মধ্যে জেলা বিএনপিকে বড় আকারে উন্নীত করার তালিকা প্রস্তুত করে কেন্দ্রীয় দফতরে জমা দেওয়ার কথা উঠলেই। সেদিকে লক্ষ্য রেখে (২৬ ফেব্রুয়ারীর) মধ্যে দফতরে তালিকাটি জমা দেন জেলা বিএনপির নেতাকর্মীরা।
এদিকে সারাদেশের ন্যায় নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপি কেন্দ্রীয় ঘোষিত নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি রোধ, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন, দ্রুত নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণা ও ফ্যাসিবাদ মোকাবিলার দাবিতে জনসমাবেশের তারিখ ঘোষণা পরেন (২৫ ফেব্রুয়ারী) যা জেলা বিএনপির নতুন কমিটি চ্যালেঞ্জ হিসেবেই দেখা গিয়েছিলো। কিন্তু সমাবেশকে উভয় নেতাকর্মীরা তাদের সাংগঠনিক দক্ষতায় সফল করেছে। যার মাধ্যমে সেখানে উপস্থিত থাকা কেন্দ্রীয় নেতাকর্মীরা জেলা বিএনপির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পরেন। সকলেই আংশিক ৫ সদস্য নেতাদের বা হা বা দিতে থাকেন। যার ফল হিসেবেই পরীক্ষিত নেতাদের সমন্বয়ে উন্নীত হলো জেলা বিএনপির কমিটি।
সূূত্র বলছে, গত ২০০৬ সালে ক্ষমতা ছাড়ার পর দীর্ঘ ১৭ বছর ক্ষমতার বাহিরে ছিল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি। সারা দেশের ন্যায় নারায়ণগঞ্জেও বিএনপি নেতা, কর্মী ও সমর্থক এমনকি তাদের পরিবারের সদস্যদেরও কোনঠাসা করে রাখে স্বৈরাচারী হাসিনার সরকারের দোসররা। একদিকে সরকার দলীয় ক্যাডারদের হামলা অন্যদিকে পুলিশি গ্রেফতারের কারনে অনেকটাই কোনঠাসা হয়ে পড়েছিলেন নারায়ণগঞ্জ বিএনপির রাজনীতি। প্রায় দেড় যুগের এই সময়কালে নির্যাতন নিপীড়ন সহ্য করা ছাত্র-জনতার গণ আন্দোলনের মুখে অবশেষে গত ৫ আগষ্ট দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যায় স্বৈরাচারী সরকারের প্রধান শেখ হাসিনা।
হাসিনা সরকারের পতনের পর দেশ জুড়ে যে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়, সেই আনন্দ দ্বিগুন হয়ে ফিরে আসে বিএনপি নেতা, কর্মী ও সমর্থকদের মধ্যে। দীর্ঘ সময়ের আন্দোলন সংগ্রামের মাধ্যমে স্বৈরাচারী সরকারের পতনের পর নারায়ণগঞ্জ বিএনপির নেতৃবৃন্দের মুখেও তৃপ্তির হাসি ভেঁসে উঠে, নতুন করে দেখতে শুরু করে স্বপ্ন। তাই এবার ত্যাগী ও প্রকৃত বিএনপি প্রেমিকদের দলে স্থান দেওয়ার বিষয়ের বিষয়ে তারা আশাবাদী। তা ছাড়া কমিটি গঠনের কয়েকদিন পরপরই ঢাকার কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সাথে ভার্চুয়ালি মিটিং করেছে নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির নতুন আহবায়ক কমিটির নেতৃবৃন্দ।
এতে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভীও উপস্থিত ছিলেন। মিটিংয়ে সাংগঠনিক তৎপরতা এবং যোগ্য ব্যক্তিদের সমন্বয়ে কমিটি গঠনের নানা দিক নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে বলে জানিয়েছে সূত্রটি। সেই মিটিংয়ে আলোচিত নানা বিষয়কে ফাইন্ড আউট করেই জেলা বিএনপির পূর্ণাঙ্গ কমিটি আসতে পারে বলে ধারনা করা যাচ্ছে। এদিকে আরো জানা গেছে, গত কয়েক দশকে নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির যতগুলো সম্মেলন হয়েছে সবগুলোই হয়েছে একই পদ্ধতিতে, একই কায়দায়। কোন কমিটিই সম্মেলনের মাধ্যমে হয়নি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এদিকে ১৯৭৮ সালে বিএনপি প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির প্রথম সভাপতি হিসেবে আব্দুল মতিন চৌধুরীকে নির্বাচিত করা হয়। একই কমিটির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন যুদ্ধকালীন কমান্ডার সিরাজুল ইসলাম। এরপর ১৯৯২ সালে সম্মেলনের মাধ্যমে নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হন রোকন উদ্দিন মোল্লা। রূপগঞ্জের মুড়াপাড়ায় এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই কমিটিরও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন যুদ্ধকালীন কমান্ডার সিরাজুল ইসলাম।
২০০৪ সালে নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় চাষাঢ়াস্থ শহীদ জিয়া হলে। এই সম্মেলনে জেলা বিএনপির সভাপতি নির্বাচিত হন অধ্যাপক রেজাউল করিম ও সাধারণ সম্পাদক হন অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকার। ওয়ান ইলেভেনের সময় সংস্কারবাদী হিসেবে অধ্যাপক রেজাউল করিমের নাম আলোচনায় থাকায় ২০০৯ সালের ২৫ নভেম্বর শহরের আলী আহমেদ চুনকা পৌর মিলনায়তনে জেলা বিএনপি'র সর্বশেষ সম্মেলনে তাকে বাদ দেয়া হয়।
সম্মেলনে তৈমূর আলম খন্দকারকে সভাপতি ও কাজী মনিরুজ্জামানকে নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপি'র সাধরণ সম্পাদক করা হয়। কিন্তু দীর্ঘ ৭ বছরেও তারা পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করতে না পারায় ২০১৭ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি জেলা বিএনপি'র সাধারণ সম্পাদক কাজী মনিরুজ্জামানকে সভাপতি ও জেলা যুবদলের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক মামুন মাহমুদকে সাধারণ সম্পাদক করে নতুন জেলা কমিটি ঘোষণা করে কেন্দ্রীয় বিএনপি। পূর্ণাঙ্গ কমিটি আলোর মুখ না দেখায় সাড়ে ৩ বছর পর জেলা কমিটি ভেঙে দিয়ে ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর কেন্দ্র থেকে পুনরায় অ্যাডভোকেট তৈমুর আলম খন্দকারকে আহবায়ক ও অধ্যাপক মামুন মাহমুদকে সদস্য সচিব করে নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির ৪১ সদস্যবিশিষ্ট আহবায়ক কমিটি গঠন করে দেয়া হয়।
নির্দেশনা ছিল ৩ মাসের মধ্যে থানা, উপজেলা, ইউনিয়ন পর্যায়ের কমিটি গঠন করতে হবে। কিন্তু নির্ধারিত সময় পার হলেও এই আহবায়ক কমিটি সবগুলো ইউনিট কমিটি গঠনের কাজ শেষ করতে পারেনি। এর মধ্যে ২০২২ সালের জানুয়ারিতে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দলীয় সিদ্ধান্তের বাহিরে গিয়ে মেয়র নির্বাচন করায় তৈমূর আলমকে আহবায়কের পদ থেকে সরিয়ে দিয়ে ভারপ্রাপ্ত আহবায়ক করা হয় মনিরুল ইসলাম রবিকে।
দুই বছরের মাথায় একই বছরের ১৫ নভেম্বর মনিরুল ইসলাম রবি ও মামুন মাহমুদের আহবায়ক কমিটি ভেঙে দিয়ে কেন্দ্র থেকে নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মুহাম্মদ গিয়াস উদ্দিনকে আহবায়ক ও জেলা যুবদলের আহবায়ক গোলাম ফারুক খোকনকে সদস্য সচিব করে ৯ সদস্যবিশিষ্ট নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপি'র আহবায়ক কমিটি ঘোষণা করা হয়।
২০২৩ সালের ১৭ জুন জেলা বিএনপির সভাপতি হন মুহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন এবং সাধারণ সম্পাদক হন গোলাম ফারুক খোকন। গত ২৪ ডিসেম্বর জেলা বিএনপির সভাপতি মুহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন ও সাধারণ সম্পাদক গোলাম ফারুকের নেতৃত্বাধীন আহবায়ক কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করে কেন্দ্রীয় বিএনপি। কমিটি বিলুপ্তির প্রায় দেড় মাস পর (২ ফেব্রুয়ারী) নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক মামুন মাহমুদকে আহবায়ক করে ৫ সদস্যবিশিষ্ট কমিটির ঘোষণার পর যোগ্যতার ফল হিসেবে গতকাল নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপি ৩৩ সদস্য উন্নীত হয়।