রোববার   ২৪ নভেম্বর ২০২৪   অগ্রাহায়ণ ১০ ১৪৩১   ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জলবায়ু পরিবর্তন :বিশ্ব ও বাংলাদেশ

যুগের চিন্তা

প্রকাশিত : ০৮:৫২ এএম, ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ মঙ্গলবার | আপডেট: ০৮:৫৪ এএম, ১৪ মে ২০১৮ সোমবার

জলবায়ু পরিবর্তনের সমস্যাটি অতি ব্যাপক, বিস্তৃত ও মানব সভ্যতার জন্য হুমকি স্বরূপ, ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে বরফ গলতে শুরু করবে এবং জলভাগ তুলনামূলকভাবে স্ফীত হবে। ফলশ্রুতিতে উপকূলীয় নিম্নাঞ্চলে বসবাসরত প্রায় দু’কোটি মানুষ বাস্তুহারা হবে, এদেশের নিচু এলাকাসমূহ প্লাবিত হবে, স্বাদু পানি এলাকায় লবণাক্ত পানির অনুপ্রবেশ ঘটবে। এমনকি ভূগর্ভস্থ পানির ক্ষেত্রেও এটা হবে।

 

বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস, খরা ও নদী ভাঙ্গনের প্রকোপ বাড়বে। খরা, বন্যা ও লবণাক্ততার ফলে ফসলের উত্পাদন মারাত্মক ভাবে হ্রাস পাবে। পরিবেশ বিজ্ঞানীদের মতে, কার্বন-ডাই-অক্সাইডের মূল উত্স হলো কয়লা, পেট্রোলিয়াম, ডিজেলের মত জ্বালানি ব্যবহার, বন নিধন, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, ব্যাপক শিল্পায়ন ইত্যাদি। অকেজো ও মেয়াদ উত্তীর্ণ যানবাহনে ব্যবহূত জ্বালানি ভালভাবে নিঃশেষ না হওয়ায় স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিঃসরিত হয়। গোটা বিশ্বের জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটায় উন্নত অনুন্নত নির্বিশেষে সব দেশের আবহাওয়াতেই মারত্মক বিপর্যয় শুরু হয়েছে। পৃথিবীর জলবায়ুর পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়।

 

বিশ্বের প্রতিটি দেশেই স্বাভাবিক আবহাওয়া জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটায় কমে যাচ্ছে শীতকালের স্থায়িত্ব, বাড়ছে ভূমি ও পাহাড় ধস, ঘন ঘন দাবানল হচ্ছে, দীর্ঘায়িত হচ্ছে খরা, ঝড়ঝঞ্ঝা, বন্যা, টর্নেডো, সাইক্লোনের মাত্রা আশংকাজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং ভয়াবহভাবে ছড়িয়ে পড়ছে পরিবেশ বিপর্যয়ের ক্ষতিকর প্রভাব। ফলে ধ্বংস হচ্ছে কৃষি, শিল্প, অর্থনৈতিক সমপদ এবং মানুষের জীবন হয়ে পড়েছে হুমকির সম্মুখীন। ১৮৫০-১৮৬০ সময়কার তুলনায় বর্তমান পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে কয়েকগুণ। বর্তমানে বিশ্বের তাপমাত্রা প্রতিদশকে ০.৩ ডিগ্রী সেলসিয়াস হারে বাড়ছে। ২০১৩ সালে আইপিসিসি (আন্ত:সরকার পরিষদ) প্রকাশ করেছে পঞ্চম মূল্যায়ন রিপোর্ট (এআর-৫)। এই রিপোর্টে প্রকাশিত জলবায়ু মডেলের হিসাব অনুযায়ী ২০ শতকে বিশ্বের বায়ু এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা ০.৮ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড বেড়েছে, আর ২১০০ সালের মধ্যে পৃথিবীর উষ্ণতা বেড়ে ৪.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসে এসে দাঁড়াবে। পরিবেশ বিজ্ঞানীদের মতে বৈশ্বিক তাপমাত্রা ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখা না গেলে, বিশ্বে পরিবেশ পরিবর্তনের কারণে প্রাকৃতিক বিপর্যয় অবশ্যম্ভাবী। এবছর কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিঃসরণের পরিমাণ হচ্ছে ৩৯৬ পিপিএম যা গত বছরের চেয়ে ২.৯ পিপিএম বেশি।

 

নেদারল্যান্ড পরিবেশ সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে কার্বন নির্গমনের হার ২.৯ শতাংশ বেড়ে গিয়ে এ বছর রেকর্ড ৩৫ গিগা টনে এসে দাঁড়িয়েছে। তবে বৈশ্বিক নিঃসরণের অর্ধেকের চেয়ে বেশি আসছে অর্থনৈতিক পাওয়ার হাউস যেমন চীন (২৯%), আমেরিকা (১৬%) এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন (১১%) থেকে। এভাবে অন্যান্য ক্ষতিকর গ্যাস মিথেন, নাইট্রাস অক্সাইড ইত্যাদির নির্গমনের পরিমাণ আগের মাত্রার চেয়ে অনেক বেশি। বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের দীর্ঘমেয়াদী পরিবর্তন ঘটছে। বিশ্ব উষ্ণায়নের জন্য একদিকে সমুদ্রের পানির যেমন তাপগত স্ফীতি ঘটছে, তেমনি আবার পর্বতের বরফ শীর্ষ, গ্রীনল্যান্ড এবং এন্টার্কটিকার বরফ গলনের ফলে সমুদ্রস্তরের উচ্চতাকে আরো বাড়িয়ে তুলছে। বায়ুমণ্ডলে যে কার্বন নিঃসরণ হয় তার এক তৃতীয়াংশ সমুদ্রের পানি শুষে নেয়। কিন্তু উষ্ণতা বেড়ে যাবার ফলে সমুদ্রের পানির গ্যাস ধারণ করার ক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে, ফলে যে সব কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্যাস পানিতে দ্রবীভূত ছিল তা আবারো বায়ুমণ্ডলে ফিরে আসছে।

 

বিজ্ঞানীদের মতে গ্রিনল্যান্ডের সব বরফ যদি গলে যায় তাহলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ৬ মিটার বেড়ে যাবে। কি ভয়ানক কথা! আইপিসিসির নতুন জলবায়ু মডেলের হিসাব মতে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ২০০৭ সালের হিসাবের চেয়ে ৬০ শতাংশ বেশি হারে বেড়ে চলেছে। এইভাবে চললে এই শতকের শেষে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা সর্বোচ্চ ১ মিটার পর্যন্ত বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে। জলবায়ু বিজ্ঞানীদের মতে, সমুদ্রস্তরের উচ্চতা যদি ১ মিটার বাড়ে তাহলে ২১ শতকের সমাপ্তিকালের মধ্যে মালদ্বীপ, পাপুয়া নিউগিনি, বার্বাডোজ, কিরিবাতিসহ প্রশান্ত মহাসাগরের অনেক দ্বীপপুঞ্জ পৃথিবীর মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাবে। ডুবে যাবে বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক দেশের সমুদ্র উপকূলবর্তী নিচু এলাকা। মালদ্বীপ হলো ছোট ছোট কোরাল দ্বীপপুঞ্জের সমন্বয়ে গঠিত একটি দেশ যার অধিকাংশ ভূমি সমুদ্রতল থেকে মাত্র ১.৫ মিটার উপরে। জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন সংস্থার মতে, সমুদ্রের উচ্চতা বেড়ে যাওয়ায় মালদ্বীপের অধীন ১২০০ দ্বীপ ডুবে যাবে, গৃহহীন হবে ৪ লক্ষ মানুষ। মালদ্বীপের চেয়ে কোন অংশেই কম ঝুঁকির মধ্যে নেই বাংলাদেশ। বঙ্গোপসাগরের সাথে বাংলাদেশের রয়েছে ৭১০ কিলোমিটার দীর্ঘ উপকূলভাগ। সমুদ্রপৃষ্ঠের স্ফীতির ফলে লোনা পানি উপকূলীয় এলাকার অভ্যন্তরে প্রবেশ করে কৃষিজমি ও মিঠাপানির প্রাণী ও উদ্ভিদ ধ্বংস করে ফেলবে। আগামী ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের তাপমাত্রা ১.৫০ থেকে ২.০০ সেলসিয়াস পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে।

 

বিজ্ঞানীরা আশংকা করছেন বিশ্ব উষ্ণায়ন ও সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে বাষপীভবনের হার বেড়ে গিয়ে বাংলাদেশে বৃষ্টিপাত বৃদ্ধি পাবে; বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের সংখ্যা ও তীব্রতা বৃদ্ধি পাবে। পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে বিশ্বব্যাপী বৈরী প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বিশ্বের বিভিন্ন এলাকায় কখনো বেশি শীত আবার কখনো কম, কখনো মাত্রাধিক গরম, কখনো তুমুল বৃষ্টিতে ভেসে যাচ্ছে সব। রাশিয়াতে ভয়ংকর দাবদাহ, নাইজেরিয়া, চীন, ভারত, পাকিস্তান ও অষ্ট্রেলিয়ায় স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা আঘাত হেনেছে। সিডর-আইলার মতো ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়েছে বাংলাদেশ। সমপ্রতি ইউরোপও ব্যাপক বন্যায় আক্রান্ত হয়েছে।

 

আমেরিকায় আঘাত হেনেছে হ্যারিকেন স্যান্ডি। আমেরিকার বিভিন্ন রাজ্য প্রচণ্ড খরায় আক্রান্ত হচ্ছে যা গত ১০০ বছরে কখনো দেখা যায়নি। ২০১২ সাল আমেরিকার ইতিহাসের সবচেয় উষ্ণ বছর হিসাবে গণ্য করা হচ্ছে। এ বছরের গ্রীষ্ম ছিল বৃটেনের সবচেয়ে জলসিক্ত। বিশ্বব্যাপী জলবায়ুর যে নতুনধারা বিন্যাস সৃষ্টি হবে, সেই পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ-খাওয়াতে সময়োপযোগী পদক্ষেপ অত্যাবশ্যকীয়। মানব বাসের এ পৃথিবীতে যাতে ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে না আসে সেজন্য বিশ্বসংস্থাসহ প্রত্যেকটি দেশ সমস্যা মোকাবিলায় এগিয়ে আসবে প্রত্যাশা এটাই। n লেখক:সহকারী অধ্যাপক, উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগ, আনন্দমোহন কলেজ, ময়মনসিংহ