একজন তরুন কবির চোখে বঙ্গবন্ধু
যুগের চিন্তা
প্রকাশিত : ০১:২১ পিএম, ১২ আগস্ট ২০১৮ রোববার
একজন তরুন কবির চোখে বঙ্গবন্ধু
-
সাকিব জামাল : “শোন একটি মুজিবরের থেকে লক্ষ মুজিবরের কন্ঠস্বরের ধ্বনি-প্রতিধ্বনি আকাশে বাতাসে ওঠে রণী বাংলাদেশ, আমার বাংলাদেশ।। - গৌরী প্রসন্ন মজুমদার”
প্রথমেই ক্ষমা প্রার্থণা করে নিচ্ছি - এতো উচ্চমানের একটি প্রবন্ধ আমার মত ক্ষুদ্র মানুষ লিখতে বসেছি হয়তো আমার জ্ঞান স্বল্পতায় ভুলত্রুটি হতে পারে । দ্বিতীয়ত লেখার স্বার্থে নিজেকে "কবি" ধরে নিতে হচ্ছে । এ দুটো বিষয় ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে সবাইকে দেখার অনুরোধ করছি ।
একুশ-ছাব্বিশ-ষোল : এই আমার অস্তিত্ব । একুশ-ছাব্বিশ-ষোল : ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি, ১৯৭১ সালের ২৬ শে মার্চ এবং ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর এই তিনটি তারিখ খোচিত আমার অস্তিত্ব । বায়ান্নো এবং একাত্তর এই দুটো চেতানা নিয়েই একজন বাঙালি তরুন কবির সত্ত্বা । শুধু কবিগন নয় - পুরো বাঙালি জাতির অভ্যুদয় এই দুটি সালের সেতুবন্ধন থেকে উৎসারিত । একাত্তরে বিজয় অর্জিত বাঙালি জাতির কবিতা কাহনে, লাল-সবুজের পতাকার দেশে কবিতা নিয়ে আলোচনা শুরু করলে দেশত্ববোধক কবিতার কথা প্রথমে আসে । কবিতামাতৃক বাংলাদেশে দেশের কবিতা নানা আঙিকে চিত্রিত হয় কবির কলমের আঁচরে । যারা লেখালেখি করেন তারা বাংলার রূপ সৌন্দর্য্য, ঋতু বৈচিত্র্য যেমন এড়াতে পারেন না কোনভাবেই - তেমনি একটি মহান চরিত্রকে উপেক্ষা করতে পারেন না কোনমতেই । আর সে চরিত্রটি হচ্ছেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, বাংলাদেশের স্থপতি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান । “ লাল সবুজের পতাকায়-মুজিব তোমায় দেখা যায়” এটি শুধু রাজনৈতিক স্লোগানই নয়, বাস্তবতা প্রতিচ্ছবি । এজন্যই বিভিন্ন প্রেক্ষিতে, বিভিন্ন উপলক্ষ্যে, বিভিন্ন দিবসে বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠেন তরুন কবিদের লেখনিতে অন্যতম প্রধান চরিত্র ।
“বিশ্বকবির সোনার বাংলা
নজরুলের বাংলাদেশ ,
জীবনানন্দের রূপসী বাংলা
রূপের যে-তার নেইকো শেষ”
- দেশত্ববোধক কবিতার কথাই তাই প্রথমে বলি । দেশত্ববোধক কবিতা, গান সব সময়ই বাঙালিদের প্রাণের খোরাক । আমার প্রিয় বাংলাদেশকে নিয়ে কবিতা আমি যখন লিখতে বসি, দেশমাতার সমান কোন ব্যক্তিত্ব কল্পনা যদি করতে হয় কবিতার প্রয়োজনে, তবে তিনি একমাত্রই বঙ্গবন্ধু । কবি মাত্রই দেশপ্রেমিক । দেশপ্রেম তার মনকে বিভিন্নভাবে প্রভাবিত করে । দেশের সমসাময়িক বিষয়াবলী ধনাত্মক এবং ঋনাত্মক উভয়ভাবেই ফুটে ওঠে দেশের কবিতায় । মজার ব্যাপার- দুই ধরনের কবিতায় কবির অন্তরকুঞ্জে বাস করেন জাতির জনকের চেতনার, তার দ্রোহের কন্ঠস্বরের পাখিরা । প্রায় সব কবির দেশের কবিতায় তাই অপ্রতিদ্বন্ধী একক চরিত্র বঙ্গবন্ধু । দেশের সাথে জড়িত সব ঘটনায় বঙ্গবন্দু এতিহাসিকভাবে জড়িত । ইতিহাসের বিভিন্ন ঘটনা প্রবাহের কবিতায় তিনি উজ্জ্বলতম চরিত্র । ১৯৬৩ এর ২৮ আগস্ট বর্ণবাদী আন্দোলনের নেতা মার্টিন লুথার কিং এর সেই 'আই হ্যাভ অ্যা ড্রিম' মহাকাব্যের পর আরো একটি মহাকাব্য রচিত হয় ১৯৭১ এর ৭ মার্চ রেসকোর্সে । যেমন এতিহাসিক ৭ মার্চ নিয়ে আমার লেখা“একটি মুজিব- একটি তর্জনী আঙুল” কবিতায় বলেছি –
“এই প্রজন্মের এই আমি কৃতজ্ঞ সদা –
একটি মুজিবের, একটি তর্জনী আঙুলের নির্দেশে -
জন্মেই পেয়েছি প্রিয় বাংলাদেশ, প্রিয় স্বাধীনতা ।”
এ বিষয়ে জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার মো. ফজলে রাব্বী মিয়া বলেছেন, “জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু সাধারণ কোন নাম বা উপাধি নয়-একটি ইতিহাস, একটি স্বাধীন বাংলাদেশ, একটি স্বাধীন জাতিসত্ত্বা” -এই উক্তিটি প্রণিধানযোগ্য । (সুত্র : এই বেলা ।) দেশের কবিতা, দেশপ্রেমের কবিতা - এসব ক্ষেত্রে শুধু তরুন কবিদেরই নয় সবই কবির কবিতায় তিনি অপ্রতিদ্বন্ধী চরিত্র । এ দেশের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা থেকে জাতির জনক বলেছিলেন - “এখন যদি কেউ বাংলাদেশের স্বাধীনতা হরণ করতে চায়, তাহলে সে স্বাধীনতা রক্ষা করার জন্যে মুজিব সর্ব প্রথম তার প্রাণ দেবে।“
স্বাধীনতার কবিতার কথা বলি এবার । স্বাধীনতা হীনতায় কেউ থাকতে চায় না, বাঁচতে চায় না । যুগে যুগে শুধু স্বাধীনতার জন্যই পৃথিবীর বুকে লড়াই হয়েছে, হচ্ছে । আমরাও করেছি ১৯৭১ সালে দীর্ঘ নয় মাস । বাঙালি জাতি যখন নির্যাতন নিপীড়নে ক্লান্ত তখন আশার আলোকবাতি জ্বালিয়ে রেখেছিলেন একমাত্র বঙ্গবন্ধু । ইতিহাস জানা আছে সবার । আমি আলোচনাকে সাহিত্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখছি তাই ।
"Our sweetest songs are those that tell of saddest thought." - Percy Bysshe Shelley তিনি বলেছেন এ কথা, আর আমি বলি-"Our sweetest songs are those that tell of maximum freedom." আর এ কথাটি আমাকে শিখিয়েছেন বঙ্গবন্ধু ! কিভাবে শিখালেন তা আপনিও জানেন, যখন তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামের ডাক দিয়ে সাথেই বলে দিলেন এটি আমাদের মুক্তিরও সংগ্রাম । সে কারণেই তরুন কবিদের স্বাধীনতার কবিতা, মুক্তির কবিতা লেখার প্রেরণার ব্যাক্তিত্ব বঙ্গবন্ধু । তরুন কবিদের স্বাধীনতার কবিতা একাত্ত্বর থেকে পাওয়া, এর প্রেক্ষিতে আমি আমার "আমার স্বাধীনতা" কবিতায় বলেছি –
“আপনমনে ঘর বাধা—আপনমনে বাস,
আপনমনে সবার সনে—ন্যায্য ভূমির চাষ,
এ আমার ভালোবাসা—এগিয়ে যাওয়ার প্রথা
একাত্তরে যুদ্ধে পাওয়া—আমার স্বাধীনতা।“
পক্ষান্তরে অগ্রজ কবিদের স্বাধীনতার কবিতা ছিলো একাত্তরপূর্ব নানা বিষয়, নানা ব্যাক্তি, নানা রাজনৈতিক প্রক্ষাপট সহ একাত্ত্বর থেকে পাওয়া । এর মানে একাত্ত্বরপূর্ব এবং উত্তর দুটো সময়ই অগ্রজ কবিরা দেখেছেন, আমরা দেখেছি একটি সময় একাত্ত্বর উত্তর থেকে সমসাময়িক- এতটুকুই পার্থক্য । আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে ভুমিকা রাখা ব্যক্তিবর্গ থেকে তরুন কবিদের কবিতায় অন্যান্য নেতৃবৃন্ধের বঙ্গযন্ধু স্বমহিমায় প্রধান চরিত্র হয়েছেন । “বাংলাদেশ” কবিতায় আরেক তরুন কবি শুভাশিস দাশ বলেছেন-
“স্বাধীনতা তোমার নামে
শপথ নিয়ে বলি
শেখ মুজিবের পথেই যেন
ন্যায়ের পথে চলি!”( সূত্র : চিন্তাসূত্র )
জাহাঙ্গীর হাবীবউল্লাহ তার কবিতা “পতাকায় পেল সুখ” এ বলেছেন –
“আহ্বান ধ্বনি আকাশে বাতাসে অন্তরে এলো ভেসে
মার্চের ডাক মহান নেতার মুক্তিযুদ্ধ দেশে,
বীরযোদ্ধারা ন’মান যুদ্ধে পতাকায় পেল সুখ
স্বাধীন হয়েছি বিজয়ের ফলে দেখি সূর্যের মুখ।“(সূত্র : ইনকিলাব )
বাংলাদেশের স্বাধীনতা পূর্বের বঙ্গবন্ধুর সব ভাষণ ছিলো বলতে গেলে এক একটি দ্রোহের কবিতা । বর্তমান প্রজন্মের দ্রোহের কবিতায় বঙ্গবন্ধু তরুনদের মন জয় করেছেন তাঁর আপোষহীন নেতৃত্বের গুনাবলী দিয়ে । অধিকারহারা মানুষের জন্য লেখা দ্রোহের কবিতা তিনি ভালোবাসতেন এটি নিশ্চিত করে বলা যায় কেননা জাতীয় কবি নির্বাচনের জন্য তিনি বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামকেই বেছে নিয়েছেন- যিনি লেখাতে ছিলেন বিদ্রোহী, তেমনই জীবনে – কাজে তিনি "বিদ্রোহী কবি"। এটি অবশ্যই একটি উত্তম প্রমাণক । প্রসঙ্গত, দ্রোহের কবিতা লেখেননি এমন কবি সাহিত্যজগতে বিরল । আমাদের সাহিত্যে তরুন, উদীয়মান কবিরাও দ্রোহের কবিতা প্রতিনিয়ত রচনা করে যাচ্ছেন । দ্রোহের কবিতায় দেশ, জাতি, সমাজ, বিশ্বের বিভিন্ন অসংগতি তুলে ধরা হয় ফলে এ ধরনের কবিতা লিখতে সাহসের প্রয়োজন বটে । আর বিভিন্ন প্রভাবক এই সাহস যোগায় ।“ বঙ্গবন্ধু সর্বকালের সাহসী নেতা ”- প্রণবকুমার মুখোপাধ্যায় ভারতের ত্রয়োদশ রাষ্ট্রপতি তাঁর এই উক্তির প্রেক্ষিতে বলা যায় বঙ্গবন্ধু দ্রোহের কবিতার ক্ষেত্রে উত্তম প্রভাবক - যিনি মাথা নত না করার শিক্ষাটি বাঙালি জাতিকে দিয়েছেন । সেখানে থেকে তরুন কবিরা “উন্নত মম শির!” নতুন করে পেয়েছে । আমিও ! “বাঙালির শপথ” কবিতায় আমি লিখেছি –
“ভয় দিওনা, ভয় পাইনা - এদেশ আমার
স্বাধীনতা, পতাকা রক্ষায় মোরা দুনির্বার ।“
বঙ্গবন্ধু সব সময় সাধারণ মানুষের বিজয় চেয়েছেন । মুক্তিকামী বাঙালি জাতিকে মুক্তির বাণী শুনিয়েছিলেন । তিনি বাঙালির ম্যাগনাকার্টা বলে পরিচিত যে ছয় দফা কর্মসূচি দিয়েছেন, সেখানেও রয়েছে সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির কথা। সাধারণ মানুষের কল্যান সাধনই ছিলো তাঁর ধ্যান । তার সুরেই আমি “তোমার কবিতায় শোনাও বিপ্লবের গান” কবিতায় বলেছি –
“জাগো আছো যত তরুন প্রাণ বিশ্বজুড়ে - হও মানুষের হৃদয়ের কবি
তোমার কবিতায় শোনাও বিপ্লবের গান, আঁকো সাধারণের বিজয়ের অসাধারণ ছবি ।“
স্বাপ্নিক কবিতার স্বপ্ন দেখাতেও শুরু করেছেন বঙ্গবন্ধু । বাংলাদেশ নিয়ে দিনরাত পুরো জীবনজুড়ে স্বপ্ন দেখেছেন বঙ্গবন্ধু, স্বপ্নের জন্মও দিয়েছেন বাঙালির মনে অবিরত।একটি ব্যক্তির সাথে কিভাবে একটি জাতির পুরো আবেগ, স্বপ্ন, জাগরণ, মুক্তি, ভবিষ্যত লেপ্টালেপ্টি করে থাকতে পারে বঙ্গবন্ধু তার সার্থক উদাহরণ । বঙ্গবন্ধুর আশা ছিল বাঙালি জাতি সুখী হোক। এখন মা মাটি মানুষ নিয়ে স্বপ্ন দেখছি আমরা তরুন কবি যারা । সোনার বাংলাকে বাস্তবায়নের জন্য লিখে যাচ্ছি নানা স্বপ্নের কবিতা । বিশ্বজয়ে পদযাত্রা শুরু করেছি জাতির জনকের স্বপ্নের হাল ধরে । কোনমতেই সোনার বাংলার স্বপ্ন ধুসর হতে দেয়া যাবে না এই প্রত্যয়ে তরুন কবিদের কলম দিয়ে দুষ্টজনকে খোঁচা দিতে হবে আলপিনের মত । আমিও দেই, তুমিও দাও । তাই “আসুক না একটা কাল বৈশাখি” কবিতায় আমার প্রার্থণার সুর একটু চড়ে গিয়ে সপ্তমে পৌছেছে-
“ঈশান কোনের মেঘ তব
আসুক নেমে আজ ভীষন করে
ধুয়ে মুছে যাক আছে যত অন্যায়, অবিচার ।
পবিত্র আত্মায় আজ নব জাগরণে
দিয়ে যাক নতুন স্বপ্ন বুনে
সমৃদ্ধি, সুশাসন আর পূর্ণ গণতান্ত্রিক বাংলার ।“ (কাব্যগ্রন্থ : কচুরিপানার ডকুমেন্টারি)
একটি আক্ষেপ মূলক দ্রোহের কবিতা, ক্ষোভের কবিতা, অপ্রাপ্তির কবিতাও রচনা করে চলেছেন তরুন কবিদের ঝাঁক । বঙ্গবন্ধু বিভিন্ন রাজনৈতিক বক্তব্যে আক্ষেপের সুর ছিলো । ৭ মার্চের বক্তৃতায় তিনি আক্ষেপ করে বলেছিলেন , "কিন্তু কি পেলাম আমরা? বাংলার নিরস্ত্র জনগণের উপর অস্ত্র ব্যবহার করা হলো। আমাদের হাতে অস্ত্র নেই। কিন্তু আমরা পয়সা দিয়ে যে অস্ত্র কিনে দিয়েছি বহিঃশত্রুর হাত থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্যে, আজ সে অস্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে আমার নিরীহ মানুষদের হত্যা করার জন্য। আমার দুখি জনতার উপর চলছে গুলি।“-সত্যি কথা বলতে দ্বিধা নেই - আমার দেশে আমার করের টাকায় চলা অনেকেই দুর্নীতিগ্রস্থ । এসব নিয়ে কবিতা লেখার অন্যতম প্রেরণা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু। আমার "কবিতা ক্যু" কাব্যগ্রন্থের "আকাঙ্ক্ষা" কবিতায় বলেছি –
“আমি দেখতে চাই
স্বধীন বিচার ব্যবস্থা
দুর্নীতি মুক্ত প্রশাসন
এবং ন্যায়পাল”।
এ প্রসঙ্গে আপনারা জানেন, সরকারি কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধু ভাষণে বলেছিলেন-“আপনি চাকরি করেন, আপনার মাইনে দেয় ঐ গরীব কৃষক। আপনার মাইনে দেয় ঐ গরীব শ্রমিক। আপনার সংসার চলে ওই টাকায়।“
শোকের কবিতা, বিষাদের কবিতা সাহিত্যের একটি বড় অংশ । আমাদের বাংলা সাহিত্যে বহু শোকের কবিতা আছে । তবে স্বাধীনতা উত্তর সময়ে ১৫ই আগস্ট, ১৯৭৫ সবচেয়ে মার্মান্তিক শোক কাব্যের জন্ম হয়েছে এদেশে । কলংকিত সময়ের বিষাদ কবিতা ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট । ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট বাংলাদেশের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করেছিল দেশদ্রোহীরা। সেই থেকে বছর ঘুরে আগস্ট মাস এলেই বাংলাদেশের মানব হৃদয়ে শোকের বোবাকান্নার অশ্রুধারা বেগবান হয়। আমি লিখেছিলাম-
“স্টেনগান হাতে উদ্ভ্রান্ত হায়েনার দল এসে ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সড়ক
স্বপরিবারে জাতির জনককে করে খুন - জাতির কপালে ছাঁপে কলঙ্ক তিলক ।
খুন করে বাংলাদেশকে । বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার স্বপ্নকে করে ধুলিস্যাত –
ভোর হলোনা আর সেদিন- কালো আধারে ঢাকে ফের বাঙলীর ভবিষ্যত ।“
( কবিতা : সেদিনও ভোর হবার কথা ছিলো , কাব্যগ্রন্থ : কচুরিপানার ডকুমেন্টারি)
“এই শোক ফুরাবার নয়” কবিতায় বলেছি
“শোকের মাসে বাঙালীর বুকে
সদা দুঃখের নদী বয়,
বঙ্গবন্ধুর রক্তে ভেজা বাংলায়
আগস্ট মাস বিষাদময় ।।“
এ শোকে মূহ্যমান হয়ে অগ্রজ, অনুজ অথবা প্রবীন,নবীন সব কবিই কবিতা বা গান রচনা করেছেন । আমি দু জন তরুন কবির অনুভুতি তুলে ধরছি । (সূত্র : বাংলা কবিতা ডট কম )
“বঙ্গবন্ধু তুমি” কবিতায় মোহাম্মদ মুসা লিখেছেন-
“বঙ্গবন্ধু তুমি রবে বাংলার বুকে চিরকাল,
যতদিন আকাশ মাথার উপর দেবে সামাল ।
হে বঙ্গবন্ধুর তুমি রবি ঠাকুরের সোনার বাংলা!
নজরুলের বিদ্রোহী!
জসিম উদ্দিন নকসী কাঁথার মাঠ!
শামসুরের স্বাধীনতা তুমির
কবিতার অনন্ত চির হিমাদ্রি।“
শাহীন আহমদ রেজা তার কবিতা “মহানায়কের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি” এর কয়েকটি পঙতি-
“তোমার শোকে আজও কাঁদছে সারা বাঙ্গালী
অদ্যাবধি দেশের মানুষ তোমার কাঙ্গালী।
হে মহানায়ক তোমাকে জানাই শ্রদ্ধাঞ্জলি
অঙ্গ জুড়ে মাখি তোমার অমূল্য পদ-ধূলি ।“
এমনকি ভালোবাসার কবিতা, প্রেমের কবিতায়ও বঙ্গবন্ধু প্রেরণা হিসেবে কাজ করেন । যারা “অসমাপ্ত আত্মজীবনী” পড়েছেন তারা নিশ্চয়ই জানেন বঙ্গমাতা এবং বঙ্গবন্ধুর সম্পর্ক কতো সুন্দর ছিলো - সর্বংসহা সহধর্মিণী বেগম ফজিলাতুন্নেসার কথা, যিনি তাঁর রাজনৈতিক জীবনে সহায়ক শক্তি হিসেবে সকল দুঃসময়ে অবিচল পাশে ছিলেন। সহযাত্রী হিসেবে বঙ্গমাতা সব সময় জাতির জনককে রাজনৈতিক কর্মকান্ডে সহযোগিতা করেছেন, পরিবার সামলেছেন । এমন যুগলবন্ধি পারিবারিক সম্পর্ক অবশ্যই কবিদের প্রেরণার জায়গা । পরিশীলিত দাম্পত্য জীবন নিয়ে কবিতা লেখার সুন্দর উদাহরণ এটি । এ যেন ঠিক এমন -
“কর্ম কাজে কিবা সমাজ রাজে
ফেলবো কদম সমান তালে ।
জয় হোক কেবলই মানবতার
নারী-পুরুষ বৈষম্যহীন কালে । (আমার কবিতার “নারীকে মোর প্রতিশ্রুতি” এর কবিতাংশ ।)”
মানবাধিকার, শ্রমিক অধিকার সহ আম জনতার বিভিন্ন অধিকার নিয়ে বঙ্গবন্ধু সব সময় সক্রিয় ছিলেন । এজন্য তাকে জেলে যেতে হয়েছে বারবার । এসব ঘটনা কতো কবিতার জন্মদাত্রী ! তিনি তাই বলেছিলেন - "আমি সব ত্যাগ করতে পারি, তোমাদের ভালোবাসা আমি ত্যাগ করতে পারিনা ।“ এই পৃথিবী সাজানোর জন্যই - জগতে হয়েছে পঙতিমালার অভ্যুদয়, শুরু ভালোবাসার বারতা ! "মানুষের জন্য মানুষের ভালোবাসার জাগরণ সৃষ্টি করা" - এটি নিশ্চিত কবির দায়বদ্ধতা । এ দায়বদ্ধতা তরুনদের মধ্যে প্রবাহিত করেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রাহমান । শোষণ নিপীড়ণ নিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন- “বিশ্ব দুই শিবিরে বিভক্ত - শোষক আর শোষিত। আমি শোষিতের পক্ষে।“মানবাধিকার, সাম্যবাদ, নায্যতা নিয়ে তরুন কবিদের কবিতা লিখতেই হবে । বাংলাদেশের সংবিধান নিয়ে তিনি বলেছিলেন - লাখ শহীদের রক্তের অক্ষরে লেখা এই সংবিধান । সেই রক্তের ঋণ শোধ করতেও লিখতে হবে বাঙালির অধিকার আদায়ের কবিতা । “বাংলাদেশের সংবিধানে "অসমতার" কথা নাই” কবিতায় আমি লিখেছি–
“কতো লোকে কতো কথা বলে-
তার মাঝে কি আমার কথা চলে !
যদি চলে –
একটা কথা বলতে চাই !
বাংলাদেশের সংবিধানে "অসমতার" কথা নাই ।
রক্তের অক্ষরে লেখা সংবিধানে "অসমতার" কথা নাই ।“
তিনি আরও বলেছিলেন “জীবন অত্যন্ত ক্ষণস্থায়ী। এই কথা মনে রাখতে হবে। আমি বা আপনারা সবাই মৃত্যুর পর সামান্য কয়েক গজ কাপড় ছাড়া সাথে আর কিছুই নিয়ে যাব না। তবে কেন আপনারা মানুষকে শোষণ করবেন, মানুষের উপর অত্যাচার করবেন?”- এ সুরে আমি আমার “কবিতা ক্যু” বইয়ের “তুমি এসো, জ্বালাবো মনে প্রেমের আগুন” কবিতায় বলেছি -
“পলাশ-কৃষ্ণচুড়া রাঙা প্রেমের রঙে - জাগাবো সবাইকে দ্রোহের বাণী মুখে,
এ পৃথিবীটা মানবেরই তরে, প্রাণী থেকে মানুষ হও মানুষ! থাকি সবাই মিলে সুখে ।
কি বলো ! সমতার রণভুমে আসবেতো তুমি ?
দেবো ভালোবেসে প্রিয় দ্রোহের ললাটখানি চুমি !”
নায্যতা, সম্যতার কান্ডারি ছিলেন বঙ্গবন্দু । তিনি বলেছেন , “যদি কেউ ন্যায্য কথা বলে, আমরা সংখ্যায় বেশী হলেও, সে একজনও যদি হয়, তার ন্যায্য কথা আমরা মেনে নেবো” একজন তরুন কবি হিসেবে আমিও এই কথার সাথে শতভাগ সহমত পোষণ করি । অন্য কবির কবিতায়ও এটি অনুসরণ, অনুকরণ করা উচিৎ ।
প্রকৃতি এবং পরিবেশ বিষয় কবিতায়ও তিনি উৎসাহ দাতা আমাদের । সর্বপ্রথম তিনিই দেশের হাওর-বাঁওড়, নদ-নদী ও অন্যান্য জলাভূমি উন্নয়নের রূপরেখা প্রণয়ন করেন। প্রকৃতি ও পরিবেশের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসার কারণে জাতীয়করণ ও আধুনিকায়ন করা হয় বাংলাদেশ বনশিল্প উন্নয়ন কর্পোরেশনের । (সূত্র : টেলিভিশন অনুষ্ঠান ‘প্রকৃতি ও জীবন প্রচারিত হচ্ছে চ্যানেল আই)
“সবুজেই করো নিজের আত্মপ্রকাশ” কবিতায় লিখেছিলাম-
“মহাবিশ্ব নিয়ে এ পর্যন্ত যত গবেষণা প্রকাশ-
একমাত্র পৃথিবীই বসবাসযোগ্য, অন্য কোথাও যাবার- মানুষের নেই অবকাশ ।
অন্য কোথাও সবুজ নেই । অন্য কোথাও তাই প্রাণও বাঁচে না ।
এ পৃথিবীতে সবুজ না থাকলে - অনুরূপ ফলাফল পেতে ব্যতিক্রম হবে না !”
নীতিবোধের কবিতায় তিনি অপরিহার্য প্রেরণা । তিনিই সর্বপ্রথম যিনি আহবান জানিয়েছেন এভাবে -“ আমাদেরকে সোনার দেশের সোনার মানুষ হতে হবে ” । তিনি আরও বলেন - “ অযোগ্য নেতৃত্ব, নীতিহীন নেতা ও কাপুরুষ রাজনীতিবিদদের সাথে কোনোদিন একসাথে হয়ে দেশের কাজে নামতে নেই। তাতে দেশসেবার চেয়ে দেশের ও জনগণের সর্বনাশই বেশি হয়। ” আর এসব উক্তি জাতির চরিত্র গঠনে যেমন ভুমিকা রাখে তেমনই বাংলা কবিতায় এর প্রভাব আছে । বিশেষকরে তরুন প্রজন্ম যারা লেখালেখি করেন তাদের এটি মাথায় রাখতে হবে কিভাবে জাতির চরিত্রকে উন্নত করা যায়, কিভাবে মানবিক গুনাবলী কবিতার মাধ্যমে মানুষের মনে বিকশিত করা যায় । আর এ কাজটি করতে হবে বঙ্গবন্ধুর মত নির্মোহ স্বদেশবোধ, মানবপ্রেম অনুসরণ করে । বর্তমান ক্ষয়িষ্ণু সমাজে নৈতিকতা জাগানো একান্ত অপরিহার্য । “চরিত্র কথা কয় !” কবিতায় লিখেছি-
“ফাও চাই, সস্তায় চাই,
গায়ের জোরেও চাই !
অন্যের অধিকার বা প্রাপ্যতা
ওসবের নাই বালাই !”
আমাদের চরিত্র এমন হওয়া উচিৎ নয় । এটি বঙ্গবন্ধু যেমন বারবার বলেছেন । আমদের তরুন প্রজন্মকেও বারবার বিষয়টি সামনে তুলে ধরতে হবে কবিতা, গানে ।
রাজ দরবারের রাজনৈতিক কবিতায়, রীতিনীতির কবিতায়, আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে বাংলা কবিতায়, বাংলাদেশির কবিতায় - বঙ্গবন্ধু মহোত্তম নির্দেশক কবি! বিশ্বব্যাপী বাংলাভাষার প্রসারে-প্রচারে, বাংলাদেশের ব্রান্ডিং করণে বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে তুলে ধরতে হবে তরুন কবিদের কবিতায় যত বেশি পারা যায় । বঙ্গবন্ধু জাতিসংঘে ‘বাংলা ভাষায়’ তাঁর ভাষণ প্রদান করে দেশের ভাষা ও সংস্কৃতিকে বিশ্বসভায় সম্মানিত করেন মানবজাতির কঠিন সমস্যাগুলো যা তিনি তাঁর ভাষণে তুলে ধরেন সেগুলো আজও বিশ্ববাসীর জীবনকে করে তুলেছে সংকটময় ও বিপদসংকুল। বঙ্গবন্ধুর জাতিসংঘে ভাষণ তাই এক অনন্য ভাষণ—এর ব্যাপ্তি, এর অ্যাপিল, এর আহ্বান আজও অবাক হওয়ার। (সূত্র : কালের কন্ঠে প্রকাশিত সাবেক রাষ্ট্রদূত এবং জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি অধ্যাপক ড. এ কে আব্দুল মোমেন স্যারের প্রবন্ধ) “ জাতিসংঘে কবিতার হস্তক্ষেপ চাই” কবিতায় আমার কিছু কথা ছিলো এমন –
“মুক্তির কবিতার বারতায়-
পৃথিবীতে জন্ম নেয়া সব মানুষের জন্যই
স্বাধীন, নিরাপদ চারনভুমি নিশ্চিত করতে -
জাতিসংঘে কবিতার হস্তক্ষেপ চাই ।
মানবিকবোধের পঙতিমালায়-
সব মানুষের মানবাধিকার রক্ষায়
নায্য অধিকার বন্টনে -
জাতিসংঘে কবিতার হস্তক্ষেপ চাই”।
স্বনির্ভর জাতি গঠনে তিনি দৃঢ় প্রত্যয়ী ছিলেন । ভিক্ষুক জাতির ইজ্জত থাকে না। বিদেশ থেকে ভিক্ষা করে এনে দেশকে গড়া যাবে না। দেশের মধ্যেই পয়সা করতে হবে। ”এ উক্তি তার উজ্জ্বল প্রমাণ । উত্তর আধুনিক কবিতার যুগে সব কিছু নিয়েই কবিতা হয় । অর্থনীতি হালের একটি জনপ্রিয় শাখা কবিতার । এক্ষেত্রেও তার নির্দেশনা আছে-“ এই স্বাধীনতা তখনি আমার কাছে প্রকৃত স্বাধীনতা হয়ে উঠবে, যেদিন বাংলার কৃষক-মজুর ও দুঃখী মানুষের সকল দুঃখের অবসান হবে” - বঙ্গবন্ধুর এ উক্তিটি উত্তম কবিতার স্রষ্টা । “বরং উত্তম যে কবিতা!” এই কবিতায় আমি বলেছিলাম –
“মজলুমের জীবনে আবার প্রেম? প্রেমের কবিতা-
নিছক সময় অপচয়!
তার চেয়ে বরং উত্তম কবিতা:
রাজপথে ধ্বস্তাধস্তি করে জারী করা সমতার সমন,অধিকার আদায়ের যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা !
তার চেয়ে বরং উত্তম কবিতা:
দুর্দশার জীবনে চক্রময় কক্ষপথের চারপাশের শোষকের, ক্ষুদার রুঢ় প্ররিভ্রমন অক্ষ ভেঙে ফেলা”।
সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির কবিতায় বঙ্গবন্ধু তাই সব কবির প্রেরণার জায়গা অনন্ত তরুন কবিদের কবিতায় ।
পরিশেষে, শ্রদ্ধেয় আহমদ ছফার ভাষায় বলতে হয়- “দিবসের উজ্জ্বল সূর্যালোকে যে বস্তু চিকচিক করে জ্বলে তা হলো মানুষটির সাহস। আর জ্যোৎস্নারাতে রুপোলি কিরণ ধারায় মায়ের স্নেহের মতো যে বস্তু আমাদের অন্তরে শান্তি ও নিশ্চয়তার বোধ জাগিয়ে তোলে তা হলো তার ভালোবাসা। জানো খোকা তার নাম? শেখ মুজিবুর রহমান ।“
বাংলা সাহিত্যে বঙ্গবন্ধু একটি মহকাব্যের নাম । বাংলাদেশের অমর স্বাধীনতা মহাকাব্যের মহাকবি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু তরুন কবিদের কাছে আজীবন প্রেরণার জায়গা - চলার সথে চেতনার সঙ্গী অবিরাম । যতদিন বাংলাদেশ থাকবে ততদিন তিনিও কবিতায় বেঁচে থাকবেন সগৌরবে দেদীপ্যমান হয়ে নবীন-প্রবীন সব কবির কবিতায় ।
----------------------------------