‘স্বরণ’ স্মরণ এবং একটি স্মরণীয় ঘটনা
যুগের চিন্তা
প্রকাশিত : ১২:১৮ পিএম, ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ রোববার
আমার এক বন্ধু আনোয়ার আশরাফ বিত্তবান পিতার সন্তান। নিজেও অতি অল্প বয়সে পাটের ব্যবসা করে প্রভূত অর্থবিত্তের মালিক হয়েছে। অল্পবয়সী পয়সাওয়ালা ব্যক্তিদের বন্ধুর অভাব হয়না । এরকম বন্ধুদের বেশিরভাগই হয় তোষামোদকারী মোসাহেব- আজকালকার ভাষায়‘চামচা’। আশরাফ সম্ভবত তোষামোদকারীদের একট পছন্দ করতো । আর এ কারণে ওর চারিদিকেই সর্বক্ষণ চাটুকারের দল মাছির মতো ভনভন করতো।
আশরাফ সংস্কৃতিমনষ্ক লোক ছিলো। সে নিজে লেখক ছিলোনা, কিন্তু লেখক, কবি, সাহিত্যক বন্ধুদের সান্নিধ্য কামনা করতো। ফলে সে আমাদের “সাহিত্যবিতান”-এর একবার সভাপতিও হয়েছিলো। নাটক সিনেমার প্রতি আশরাফের খুব আগ্রহ ছিলো। সে দুয়েকটা ছবিও প্রযোজনা করেছে। বলাবাহুল্য, ওর একটা ছবিতে আমাকে গান লেখার সুযোগও দিয়েছিলো। সত্তর দশকের মাঝামাঝি সময়ে আশরাফ ওর চাটুকার নিয়ে ‘সিনেমেট’ নামে একটি সিনেক্লাব প্রতিষ্ঠাকরেছিলো।
আমি দিব্যি করে বলতে পারবো, সিনেক্লাব আন্দোলনটা কি, আশরাফের চাটুকারদের সে সম্বন্ধে তেমন ধারণা ছিলোনা । যা হোক আমার আজকের লেখাটি সেসব বিষয়ে নয়। আশরাফের সিনেমেট-এর দুই মাতাল চাটুকার সে সময়ে এক গভীর রাতে আমার ছোট্ট ছাপাখানাটিতে যেভাবে হামলা করেছিলো সে ঘটনাটিই আজ আমি বর্ণনা করবো।
আশরাফের“সিনেমেট”ক্লাবের উদ্বোধনের আগের রাতের কাণ্ড। “সিনেমেট” অনুষ্ঠানের স্মরণিকাটি আশরাফ আমার প্রেসে ছাপতে দিয়েছিলো। পরেরদিন অনুষ্ঠান, কাজেই সারারাত প্রেসে কাজ করতে হবে। প্রুফসেট গুলোতে আমি আরেকবার চোখ বুলাতে লাগলাম, দেখলাম কে যেনো আমার দেখা প্রুফসিটে “স্মরণিকা”বানানটি কেটে “স্বরণিকা”করে দিয়েছে।
মেশিনম্যান ইউসুফকে ডেকে কাটাপ্রুফ দেখিয়ে বললাম, এটা কে করেছে? ইউসুফ বললো- আশরাফ সাহেবের বন্ধু“অমুকে আর অমুকে”। এই দু’জন ‘অমুকের’ সামান্য পরিচয় দেয়া আবশ্যক। এ দু’জনের শখ ছিলো, সিনেমালাইনে ডাইরেক্টরজাতীয় কিছু হবার। যেহেতু আশরাফ সিনেমা প্রযোজনায় ছিলো, কয়েকটি ছবিও করেছে, সেহেতু এরা দু’জন আশরাফের পেছনে জোঁকের মতো লেগেছিলো, যাতে ওর প্রতিষ্ঠানে কাজ করার সুযোগ দেয়।
এদের একজন আবার সাহিত্য-টাহিত্য করতো। আমাদের সাহিত্য বিতানের সভায় কবিতা, গল্প পড়তো- সেই সাথে সাংবাদিকতাও নাকি করতো । তিনিই নাকি ‘স্মরণিকা’ বানানটি“ শুদ্ধ করে ‘স্বরণিকা’ করে দিয়েছিলেন। যা-হোক আমি রাত এগারোটার দিকে সবকিছু ঠিকঠাক করে দিয়ে বাড়িতে চলে গেলাম। রাত একটার দিকে ইউসুফ বাড়িতে ছুটে এসে উচ্চস্বরে আমাকে ডাকতে শুরু করলো। আমি উৎকণ্ঠা নিয়ে দ্রুত বেরিয়ে এসে জানতে চাইলাম ব্যাপার কি? ইউসুফ বললো, ‘আপনে নাকি কি একটা বানান ভুল কইরা দিছেন, তাই ওরা প্রেসে গিয়া সব তছনছ কইরা ফালাইছে, তাড়াতাড়ি চলেন।’
আমি দ্রুত প্রেসে এসে ঢুকতেই একটা বোটকা গন্ধ পেলাম। দুই মহাজন অবনত অবিন্যস্ত অবস্থায় বসে আছে, ওদের মুখ দিয়ে লালা ঝরছে। আমার টেবিলের গ্লাসটা ভেঙ্গে চুরমার করা হয়েছে। টেলিফোন সেটটা ভাঙ্গা, টুকরা টুকরা অবস্থায় নিচে পড়ে আছে। টেবিলের কাগজপত্র লন্ডভন্ড। কম্পোজরুমে গিয়ে দেখি, টাইপের কেসগুলি উল্টে পড়ে আছে। অতো দামের টাইপগুলো ছড়িয়েছিটিয়ে একাকার। মাথা অস্বাভাবিক গরম হয়ে গেলো।
আমি ওদের জিজ্ঞেস করলাম, এই সব কি করছো? একজন উত্তর দিলো, “আপনে ‘স্মরণিকা’বানান ভুল কইরা দিলেন ক্যান- আমারে বানান শিখান!” রাগলে আমার হিতাহিত জ্ঞান থাকেনা। এক্ষেত্রেও তাই হলো, কবি-সাংবাদিক সাহেবকে এমন একটা চড় দিলাম যে, চেয়ার থেকে পড়ে গেলো। তার অপর সাথি আমাকে কখনো তেমন পাত্তা দেয় না- থোরাই কেয়ার করে।
কিন্তু এক্ষেত্রে আমার অস্বাভাবিক রূপ দেখে বললো, “এ্যাইসবকিছু আমি করি নাই- অরে আমি বাধা দিছিলাম...।” আমি কোনো কথা না বলে ওদের দু’জনকে ধাক্কা মেরে বের করে দিয়ে প্রেসে তালা লাগিয়ে বাড়িতে চলে এলাম। খুব ভোরে আশরাফকে বিস্তারিত বললাম। সকাল নয়টার দিকে ওর সাঙ্গপাঙ্গ এবং ওই দু’জনকে নিয়ে প্রেসে এসে সব দেখে হতবাক হয়ে শুধু বললো, “এসবের জন্য আমিই দায়ী, তুই আমারে মাফ কইরা দে ভাই। যেমনে পারস আমার বইটা বাইর কইরা দে, আমি তর সব ক্ষতিপূরণ দিমু।”
এই দুইজন পরবর্তীকালেও মদ্য বর্জন করতে পারেনি। এখন তাদের বয়স হয়েছে, একজন সিনেমা জগতে সুবিধা করতে না পেরে হতাশ জীবনযাপন করছে, অপরজন সাংবাদিকতায় ব্যর্থ হয়ে এখন নিজ পরিবারের ‘বাজার সরকার।’
শাহেদ আলী মজনু