আফ্রিকার সিয়েরা লিওনে ‘সরকারি ভাষা’ বাংলা
যুগের চিন্তা
প্রকাশিত : ১২:২৩ পিএম, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ বৃহস্পতিবার
ডেস্ক রিপোর্ট (যুগের চিন্তা ২৪) : আমাদের ভাষা আন্দোলনের সুবর্ণজয়ন্তী পালিত হয় ২০০২ সালে। ঠিক ওই বছরই বাংলাদেশ থেকে প্রায় ১৫ হাজার কিলোমিটার দূরের দেশ সিয়েরা লিওন বাংলা ভাষাকে তাদের অন্যতম সরকারি ভাষা হিসেবে ঘোষণা দেয়।
সিয়েরা লিওন পশ্চিম আফ্রিকার একটি দেশ। আয়তন ৭১ হাজার ৭৪০ বর্গকিলোমিটার, জনসংখ্যা প্রায় ৬৯ লাখ। দেশটিতে বাস করে ১৬টি ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, যাদের সবার নিজস্ব ভাষা ও সাংস্কৃতিক রীতিনীতি আছে। সাধারণভাবে অধিকাংশ মানুষ নিজেদের মধ্যে ইংরেজির সঙ্গে স্থানীয় ভাষাগুলোর সম্মিলনে সৃষ্ট ক্রিও নামের একটি সংকর ভাষায় ভাবের আদান-প্রদান করে থাকে। সরকারি ভাষা ও শিক্ষার মাধ্যম ইংরেজি।
কীভাবে সিয়েরা লিওনের সরকারি ভাষা বাংলা হলো সেটা জানতে হলে ফিরে যেতে হবে ঠিক ১৯৬১ সালে। সেবছর দেশটি স্বাধীনতা অর্জন করে। স্বাধীনতা লাভের পর বেশ ভালোভাবেই দিন পার করছিল দেশের মানুষগুলো। কিন্তু ভয়াবহ পরিস্থিতি শুরু হয় তার প্রায় ৩০ বছর পর। অশান্ত পরিস্থিতি থেকে আস্তে আস্তে গৃহযুদ্ধের দিকে ধাবিত হয় দেশটি। মূলত, তৎকালীন সরকারের দুর্নীতি ও প্রাকৃতিক সম্পদের অব্যবস্থাপনার ফলে সিয়েরা লিওনে গৃহযুদ্ধ বাধে। প্রায় এক দশকেরও বেশি সময় ধরে দেশটিতে ধংসযজ্ঞ চলে।
পশ্চিম আফ্রিকার দেশগুলো সিয়েরা লিওনের সমস্যা সমাধানে ব্যর্থ হলে ১৯৯৯ সালে জাতিসংঘ শান্তি প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব নেয়। বাংলাদেশসহ ১৩টি দেশ সিয়েরা লিওনে জাতিসংঘের শান্তি মিশনে যোগ দেয়। বাংলাদেশ থেকে ৭৭৫ জন সেনার প্রথম দলটি সিয়েরা লিওনের দক্ষিণ অঞ্চলে লুঙ্গি নামক স্থানে দায়িত্ব নেয়। ধীরে ধীরে বাংলাদেশ থেকে আরো সেনা সিয়েরা লিওন যান এবং সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েন। একপর্যায়ে বাংলাদেশের প্রায় পাঁচ হাজার ৩০০ জন সেনা একত্রে দেশটিতে কর্মরত ছিলেন। শান্তি প্রতিষ্ঠার পর বাংলাদেশ দল ২০০৫ সালে ফিরে আসে। সর্বমোট প্রায় ১২ হাজার সেনা সিয়েরা লিওনে দায়িত্ব পালন করেন।
বাংলাদেশ সেনাদল তাদের নিয়মিত সামরিক কর্মকা-ের পাশাপাশি স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ফিরিয়ে আনার জন্য বিদ্যমান বিভিন্ন জাতির মধ্যে আস্থা ও নিরাপত্তাবোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করে। যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে সাধারণ সেনারা ইংরেজী ভাষার পাশাপাশি বাংলা ভাষাও ব্যবহার করতে থাকেন। বাংলা ভাষা স্থানীয় লোকজনের অপরিচিত হওয়ায় তাদের ধৈর্যের সঙ্গে তা শেখাতে শুরু করেন। সাধারণ মানুষ বাংলা ভাষাকে গ্রহণ করে খুব আগ্রহের সঙ্গে। ভাষার সঙ্গে সঙ্গে তারা বাঙালী সংস্কৃতির পরিচিত হতে থাকে।
২০০২ সালের মধ্যে দেশটির যে জায়গাগুলোতে বাংলাদেশি সেনাদল ছিল, সেখানেই স্থানীয়রা বিশেষত তরুণ-তরুণীরা বাংলায় কথা বলতে পারছে। বিভিন্ন সভায় স্থানীয়রা বাংলা ভাষা ব্যবহার করতে শুরু করে। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে স্থানীয়দের বাঙালী নাচ ও গান পরিবেশন করতে দেখা যায়। বাংলাদেশ সেনাদলের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে সিয়েরা লিওনে বাংলা ভাষা জনপ্রিয়তা পায়। স্থানীয়রা কাজ চালানোর মতো বাংলা ভাষা শিখে নেয়ার ফলে শান্তি প্রতিষ্ঠা এবং দেশ পুনর্গঠনে বাংলাদেশ সেনাদল অন্যদের চেয়ে অনেক এগিয়ে যায়। কারণ বাংলাদেশি সেনাদল তাদের দায়িত্বের প্রতি সব সময় নিষ্ঠাবান ছিল, উপরন্তু সাধারণ মানুষের মন জয় করার চেষ্টা করত। যার কারণে বাঙালী সেনাদের বাংলা ভাষাকে স্থানীয়দের মধ্যে প্রচারের উদ্যোগটি সহজেই সফলতা পায়।
১৯৯১ সালের ওই গৃহযুদ্ধে প্রায় অর্ধ লক্ষ মানুষ মারা যায়, বিশ লক্ষ মানুষ প্রতিবেশী দেশগুলোতে শরনার্থী হিসাবে বাস্তুহারা হয়। ধ্বংস হয় দেশের অধিকাংশ অবকাঠামো। এ দেশের সেনারা সিয়েরা লিওনে শান্তি ফেরাতে রেখেছেন ব্যাপক ভূমিকা। বিদ্রোহীদের দখলকৃত অঞ্চলগুলোকে মুক্ত করতে বাংলাদেশের সেনা সদস্যদের কার্যক্রম ছিল অনবদ্য।
বাংলাদেশি সেনাদল যা করেছেন, তার জন্য সিয়েরা লিওনের সরকার কৃতজ্ঞ। ২০০২ সালে শান্তি ফিরে আসে দেশটিতে। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আহমাদ তেজান কাব্বাহ কৃতজ্ঞতা জানাতে একটুও দেরি করেন নি। বাংলা ভাষাকে সে দেশের দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করেন। বাংলাদেশ সেনাদলের নির্মিত একটি ৫৪ কিলোমিটার সড়ক উদ্বোধনকালে এই ঘোষণা দেন।
দেশটিতে দাপ্তরিক ভাষা হিসাবে সরকারি প্রশাসন ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ইংরেজিতে কথা বলা হয়। বাংলা হচ্ছে সিয়েরা লিওনের দ্বিতীয় দাপ্তরিক ভাষা। কিন্তু দেশটির খুব বেশি মানুষ বাংলা জানে না। এসনকি বাংলা ভাষার ব্যবহারও কদাচিৎ দেখা মেলে। দেশটির সকল বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে ক্রিও ভাষা সবচেয়ে বেশি কথ্য ভাষা। বিশেষ করে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে ব্যবসা বাণিজ্য এবং একে অপরের সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগে ক্রিও ভাষা ব্যবহার করে।
সিয়েরা লিওনে বাংলা ভাষাকে সরকারি ভাষা ঘোষণা দেয়ায় বাংলা ভাষা একটি ভিন্ন মাত্রা পাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়, যদিও তা কাজে লাগানো হয়নি। সিয়েরা লিওন এগিয়ে এলেও আমাদের তরফ থেকে বাংলা ভাষার প্রচার-প্রসারে সিয়েরা লিওনের সঙ্গে যে পরিমাণ সাংস্কৃতিক বিনিময় হওয়া প্রয়োজন ছিল তা হয়নি, তবে সময় এখনো শেষ হয়ে যায়নি।