শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪   অগ্রাহায়ণ ৯ ১৪৩১   ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

করোনাভাইরাস : প্রকৃতির প্রতিশোধ

আহমদ তমিজ

যুগের চিন্তা

প্রকাশিত : ০৫:৩৩ পিএম, ১৪ মে ২০২০ বৃহস্পতিবার

একটি ক্ষুদ্র অনুজীব করোনাভাইাসের দিগি¦জয়ী তান্তবে বিশ্বের কয়েক’শ কোটি মানুষের মনে কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছে। বিশ্ব অর্থনীতি তথা শিল্প উৎপাদন ও তার বিপণন ব্যবস্থাকে নিশ্চল ও স্থবির করে দিয়েছে। বিশ্বে এ ভাইরাসের কোন প্রতিষেধক বা ভ্যাকসিন না থাকার কারণে সাধারণ মানুষ থেকে বিশ্বের বিত্তবান সম্পদশালীরাও মহা আতঙ্কে অসহায় হয়ে পড়েছেন।

 

বিশ্ব মোড়লদের আজ এই উপলব্ধিতে উপনীত করেছে যে, এই পৃথিবী ও তার মানুষদের ধ্বংস করতে তাদের হাতে যথেষ্ট মারণাস্ত্র মজুত থাকালেও প্রাণঘাতী এই ভাইরাসকে প্রতিরোধ বা প্রতিহত করতে তাদের হাতে কোন অস্ত্র মজুত নেই। বিশ্ববাসীর জন্য এই ভাইরাস প্রকৃতির প্রতিরোধ না আশীর্বাদ এ প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।


বছর খানেক আগে বিশ্বের একদল নামি-দামি পরিবেশ বিজ্ঞানীরা এক সম্মেলনে ঘোষনা করেছিলেন, বর্তমান জলবায়ূ পরিবর্তন ও বায়ূ দূষণের গতি অব্যাহত থাকলে এই ধরিত্রী আগামী ২০৪০ সালের মধ্যে মানুষের বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়বে।

 

অর্থাৎ এরপর মানুষ আর বেঁচে থাকতে পারবেনা। কারণ শিল্পোন্নত ও শিল্পোন্নয়নশীল দেশগুলো শিল্পোন্নয়নের নামে লক্ষ লক্ষ মিল কারখানা স্থাপন ও মিল কারখানা চালু করে শিল্প বাণিজ্যের প্রসার ঘটনোর এক অপরিনামদর্শী প্রতিযোগীতায় লিপ্ত হয়। বিশেষ করে গত দুটি বিশ্বযুদ্ধে পর বর্তমান বিশ্ব এক নজীরবিহীন উষ্ণায়ন ও জলবায়ূ পরিবর্তন লক্ষণীয়ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।

 

সেই সব শিল্প-মিল-কারখানা থেকে নির্গত কার্বন-ডাই অক্সাইড বা গ্যাস থেকে বায়ূ দূষণ, পানি দূষণ ও পরিবেশগত দূষণের কারণে জীব-প্রকৃতির শৃঙ্খলা বিনষ্টের কারণ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। কেননা ইতিপূর্বে একই কারণে ভাইরাস বা প্রাণঘাতী ব্যাধির মধ্যে প্লেগ, জলবসন্ত, কষ্টুরোগ, কলেরা, ফ্লু, জিকা ভাইরাস, হাম ইবোলা ও ডেঙ্গু বিশ্বে মহামারী হিসেবে দেখা দেয়। বিশ্বে কোটি কোটি মানুষের প্রাণহানি ঘটেছিল। 


বিজ্ঞানীরা বলেছেন, জীব বৈচিত্র ও তার প্রকৃতি বিনষ্টের কারনে প্রতি একশত বছর পরপর এ ধরনের মহামারীর প্রাদুর্ভাব ঘটে থাকে। তারপরও উন্নত বিশ্বের সাম্রাজ্যবাদীদের অর্থ লিপসা, দেশে দেশে মানুষকে পদানত করে সামরিক ও অর্থনৈতিক শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের ক্ষেত্রে তাদের বেপরোয়া উদ্যোগই আজকের প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঘটিয়েছে।

 

এ ব্যাপারে বর্তমান জাতিসংঘের মহাসচীব এ্যান্তনি গুতেরেস বলেছেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সারাবিশ্বে করোনাভাইরাস সবচেয়ে ভয়াবহ সংকট সৃষ্টি করেছে।


সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি থেকে চীন মুক্তবাজার অর্থনীতিতে সামিল হয়ে দেশে জ্বালানী ও শিল্প কারখানাসহ অর্থনৈতিক উপযোগগুলোর উপর ব্যাপক কর্তৃত্ব লাভ করার জন্য ব্যাপক তৎপরতা শুরু করে খুব দ্রুতই বিশ্বের দুই নম্বর অর্থনীতি শক্তির স্বীকৃতি লাভ করে। এরই ফল স্বরূপ গত ডিসেম্বর মাসের শেষের দিকে চীনের হুবেই প্রদেশের রাজধানী উহান থেকে করোনাভাইরাস বা কোভিড-১৯ নামক এক রহস্যজনক প্রাণঘাতী ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঘটে।

 

এতে কয়েক হাজার মানুষ অনেকটা বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু বরণ করে। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প করোনাভাইরাসকে চীনা ভাইরাস বলে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করার পর তাকে আর বেশীদিন অপেক্ষা করতে হয়নি। অল্প দিনের মধ্যেই করোনাভাইরাস আমেরিকাসহ গোটা ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে চীনের চেয়েও ব্যাপক প্রাণহানি ঘটাচ্ছে।

 

এখন ক্রমান্বয়ে বাংলাদেশেসহ বিশ্বের দুই শতাধিক দেশে ভয়াবহ হারে ছড়িয়ে পড়েছে। পরিস্থিতি এতটাই নাজুক যে দেশগুলোতে ভাইরাস আক্রান্তদের সেবায় নিয়োজিত ডাক্তার-নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীরা জরুরি প্রয়োজনে মাস্ক, গ্লাভস ও পিপিই না পেয়ে তারা রাস্তায় নামতে বাধ্য হয়েছে।

 

এর আগে আমেরিকা জাতিসংঘের জলবায়ু বিষয়ক সংস্থা ক্লাইমেট মিটিগেশন থেকে এই বলে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প চাঁদা প্রদান ও তার সদস্যপদ প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন “জলবায়ূ হচ্ছে প্রাকৃতিক পরিবর্তন, এতে মানুষের কোন হাত নেই।” তার এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে ইউরোপের কিছু কিছু দেশ তাকে অনুসরণ ও সমর্থন করেছিলেন।


চীনের পর এমন গোটা ইউরোপ করোনাভাইরাসের থাবায় মৃত্যুপুরীতে পরিনত হয়েছে। প্রতিদিন হাজার হাজার ভাইরাসে আক্রান্ত মানুষ অনেকটা চিকিৎসাবিহীন অবস্থায় মারা যাচ্ছে। এই ব্যাপারে মার্কিন সংক্রমক ও রোগতত্ত্ব বিশেষজ্ঞ এ্যান্টনি ফোমি “মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কয়েক কোটি লোক আক্রান্ত  হবে এবং অন্তত দুইলক্ষ লোকের প্রাণহানি হবে বলে আশংকা প্রকাশ করেছেন।

 

তার সাথে সুর মিলিয়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেছেন, মৃত্যুর এই মিছিল দুই লাখের মধ্যে থামাতে পারলে আমরা সন্তুষ্ট। অথচ আমেরিকা ও তার ক্ষমতাদিপী মিত্ররা বিভিন্ন ছল-ছুতোয়-বিভিন্ন দেশের উপর অর্থিৈনতক নিষেধাজ্ঞা জারী ও ওয়ার অন টেররিজম এর নামে ইরাক, আফগানিস্তান, ইরান, লিবিয়া, সিরিয়ায় চলমান যুদ্ধে হাজার হাজার টন বোমা ফেলে লাখ লাখ মানুষ হত্যা, জীব প্রকৃতি ও সবুজ বনায়ন ধ্বংস করে এই পৃথিবীটাকে গ্যাস চেম্বারে পরিণত করেছে।

 

গত বছর সংবাদপত্র এ খবর প্রকাশ করে জানিয়েছে- ব্যাপকহারে কার্বন বা গ্যাস নির্গত হওয়ার কারনে বিভিন্ন দেশের আকাশে-বাতাসে গ্যাসের ভারি স্তর সৃষ্টি হওযায় সেখানে দিনের বেলায় সূর্যের দেখা পাওয়া যাচ্ছেনা।


বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (হু) প্রকাশিত এক রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে-“বায়ূ দুষণ জনিত বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যার কারণে বিশ্বে প্রতি বছর ৭০ লক্ষ মানুষের প্রাণহানি ঘটছে। অর্থাৎ প্রতি মাসে প্রায় ৬ লক্ষ মানুষ মৃত্যুর শিকর হচ্ছে। অবশেষে করোনাভাইরাসের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য বিশ্বজুড়ে লাখ লাখ শিল্প কলকারখানা, কোটি কোটি যানবাহন বন্ধ।

 

বিমানের হাজার হাজার ফ্লাইট বাতিল করে লকডাউন, শাটডাউন ঘোষনা করে এবং কোটি কোটি মানুষকে আইসোলেশন ও কোয়ারেন্টাইনের নামে গৃহবন্দী করে কোভিড-১৯ ভাইরাস মোকাবেলার জন্য বিশ্ব রাষ্ট্র নায়করা

 

প্রানান্তকর চেষ্টা চােিয় যাচ্ছেন। তবে এত করে বিপুল অর্থনৈতিক ক্ষতি ও মানুষের চরম ভোগান্তির পাশা পাশি একটি দৃশ্যমান ইতিবাচক পরিবর্তনে বায়ূ দূষণ, পানি দূষণ-নজিরবিহীন ভাবে হ্রাস পেয়ে ধূলিময় গ্যাস আচ্ছাদিত আকাশ-বাতাস এখন শত বছর আগের স্বচ্ছ অবস্থানে ফিরে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে আমাদের রাজধানী ঢাকার বায়ু দূষণ ৫০ ভাগ হ্রাস পেয়েছে বলে জরিপে প্রকাশ পেয়েছে।

 

এ ব্যাপারে ইউরোপীয় স্পেস এজেন্সী ‘রাসা’ এবং আমেরিকার মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র ‘নাসা’ জানিয়েছে কোভি-১৯ এর কারনে সবকিছু লকডাউন ও শাটডাউনের ফলে শিল্পোন্নত দেশগুলোর ধূলিময় দূষিত আকাশ-বাতাশ আবার স্বচ্ছ ও ঝলঁমলে হয়ে শত বছরের আগের অবস্থায় চলে যাচ্ছে। দূষিত নদী ও সমুদ্রের পানির রং ও স্বাদ ক্রমন্বয়ে স্বচ্ছ হয়ে পূর্বের অস্থানে চলে যাচ্ছে।

 

অথচ উদ্বেগ-উৎকণ্ঠিত পরিবেশ বিজ্ঞানীরা বারবার সম্মেলন করে শিল্পোন্নত দেশগুলোর নেতাদের প্রতি কার্বনডাই অক্সাইড নিঃসরনের মাত্রা একটি সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনার জন্য আকুল-আবেদন-নিবেদন করেও তদের সাড়া পায়নি।

 

পাদটীকা: উন্নত বিশ্বের সীমাহীন ভোগবাদিতা, তাদের অনৈতিক জীবনচারীতা বেহায়াপনা ও তাদের উলঙ্গ মৌজ ও মাস্তি আজ দরিদ্র বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের জীবন ও বেঁচে থাকাকে এক অন্তহীন অনিশ্চয়তার পথে ঠেলে দিয়েছে।

 

তাদেরকে বাঁচানোর বিশ্বের কিছু বিবেকবান মানুষের কাতর আহ্বান মিনতি সব ব্যর্থ হাহাকার অবশেষে এক মহাশক্তিধরের পক্ষ থেকে আর্বিভূত তাঁর বাহিনির একটি ক্ষুদ্র জীব করোনা ভাইরাস আতঙ্কে সারাবিশ্ব আজ ভীত ও সন্দিগ্ন হয়ে প্রকৃতির কাছে নতজানু হয়ে পড়েছে।


পুনশ্বঃ- সম্প্রতি আফ্রিকার একটি রাষ্ট্রের (সম্ভবত দেশটি মোজাম্বিক) প্রধানমন্ত্রী ঘোষনা করেছেন “আমাদের দেশে কোন করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগী নেই। এর কারণ হচ্ছে করোনাভাইরাস সংক্রমন সনাক্ত করার কোন যন্ত্রপাতিই আমাদের নেই।