মঙ্গলবার   ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪   অগ্রাহায়ণ ১৯ ১৪৩১   ০২ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

কবি হতে গিয়ে মানবসেবক হলেন জাব্বার

ইউসুফ আলী এটম

যুগের চিন্তা

প্রকাশিত : ১১:০০ পিএম, ২৯ জুলাই ২০২০ বুধবার

বড় অসময়ে পরপারে পাড়ি জমালেন নারায়ণগঞ্জ শহরে ‘সাদামনের মানুষ’ হিসাবে পরিচিত ডা. জিএম জাব্বার চিশতী। জীবিকার তাগিদে হোমিওপ্যাথি ডাক্তারিকে পেশা হিসেবে বেছে নিলেও আপাদমস্তকে তিনি ছিলেন মানবতার একজন সাচ্চা সেবক।

বিপদগ্রস্ত ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষের পাশে দাঁড়াতেন সর্বশক্তি নিয়ে। দরিদ্রদের বিনে পয়সায় চিকিৎসা সেবা দিতেন। খুবই সাদামাটা জীবনযাপনে অভ্যস্ত জাব্বার চিশতী আগাগোড়াই একজন নিরহঙ্কারী ও নির্লোভ চরিত্রের মানুষ ছিলেন।

একজন দক্ষ সংগঠক হিসেবেও স্থানীয় প্রশাসন এবং সমাজের বিভিন্ন স্তরে তার পরিচিতি ছিল ব্যাপক। নিজের অর্থ ও শ্রম দিয়ে ‘কল্যাণী সেবা সংস্থা’ নামে একটি সেবা সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন।

এই সংগঠনের মাধ্যমে তিনি নিজেকে মানবসেবার সাথে অষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রাখেন। প্রচুর ছাত্রছাত্রী ও কিশোর কিশোরীকে তিনি এই সংগঠনের সাথে যুক্ত করতে সমর্থ হন। নিরলসভাবে রাতদিন পরিশ্রম করে তিনি তার কাজের স্বীকৃতি অর্জন করেন। একে একে তার কণ্ঠাভরণ শোভিত হতে থাকে বিভিন্ন পদক আর পুরস্কারে।

জাতীয় শ্রেষ্ঠ যুবসংগঠক, আলোকিত সাদামনের মানুষ, অনুপ্রাসের শ্রেষ্ঠ সংগঠক, গুণীজন সম্মামনা, হেমিওপ্যাথি সুবর্ণ জয়ন্তী ও বেস্ট অর্গানাইজার পদক, এবং বাংলাদেশ স্কাউটস এর মেডেল অব মেরিট এ্যায়ার্ডসহ আরো অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত হন তিনি।

তবে অবাককরা কান্ড হলো, তার যৌবনের শুরুটা হয়েছিল কবিতা লেখা দিয়ে। নিজেকে একজন কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে তিনি সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তার বহুমুখি প্রতিভার বিচ্ছুরণ ঘটান। ওই সময় ‘অনুপ্রাস’ নামে চিত্রনায়ক আলমগীরের প্রথম স্ত্রী কবি ও গীতিকার খোশনূর আলমগীর (কন্ঠশিল্পী আঁখি আলমগীরের মাতা) এর একটি সাড়াজাগানো কবি সংগঠন ছিল।

জাব্বার চিশতী ১৯৮৫ সালে নারায়ণগঞ্জে ‘অনুপ্রাস’এর শাখা গঠন করে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত  নিয়মিত সাহিত্যসভা করে গেছেন। অনুপ্রাসের সাংগঠনিক কার্যক্রম চালাতে গিয়ে তার অভিজ্ঞতার ঝুলিতে অনেককিছু জমা হতে থাকে। সমাজ ও রাষ্ট্রের নানা স্তরের মানুষের সাথে কাজ করতে করতে একসময় তিনি মানব সেবকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। কবি পরিচয় ছাপিয়ে জাব্বার চিশতী বনে যান মানবতার সেবক।

পাকিস্তান আমল থেকেই জাব্বারের সাথে আমার আত্মীক সম্পর্ক ছিল। প্রাইমারি স্কুলের ছাত্র থাকা অবস্থায় জাব্বার আমাদের মিশনপাড়ার বাসায় আমার শিক্ষক পিতার কাছে প্রাইভেট পড়তে আসতো। আমি তখন নারায়ণগঞ্জ হাইস্কুলের ৭ম শ্রেণীর ছাত্র। আব্বা কোন কাজে ব্যস্ত কিংবা বাসায় না থাকলে আমি জাব্বারের খন্ডকালিন শিক্ষক হয়ে যেতাম।

আমার কাছে পড়তে জাব্বারও খুব স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতো। কারণ আমি নাকি আব্বার মতো এতো রাগী শিক্ষক ছিলাম না। এইসূত্রে কয়েক বছরের বড় হলেও তার সাথে আমার একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। কলেজজীবন থেকেই আমি লেখালেখি করি ,এ খবর জাব্বার জানতো।

সে কারণে কবি হতে গিয়ে সে পুণরায় আমার সাথে গাঁটছড়া বাঁধল। অনুপ্রাসের সাথে আমাকে সম্পৃক্ত করে নিয়মিত সাহিত্যসভার আয়োজন করতো। আমি সাহিত্যসভা সফলে তাকে সাধ্যমতো সহায়তা করতাম। কিন্তু পরিপূর্ণ কবি হতে পারেনি জাব্বার।

চানমারিতে জাব্বারদের বিশাল বাড়ি। কৈশোরে সেই বাড়িতে অনেকবার গিয়েছি আমি। তার পিতা মো. হাবিবুর রহমান আদমজী জুট মিলে চাকরি করতেন। তিনি দুধেল গাভী পালতেন। সেই গাভীর দুধ রোজে আমাদের বাসায় পাঠাতেন। আমার এখনো মনে আছে, সেই দুধের সর তোলে ঘি বানাতেন মা।

১৯৯৫ সালে হাবিবুর রহমান মারা যান। জাব্বারের স্ত্রী ফাতেমা সুলতানা মিলি জানান, ৬ বোন ও ২ভাইয়ের মধ্যে জাব্বারের অবস্থান ছিল তৃতীয়। সব বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। ছোট ভাই মাহবুবুর রহমান বাবু কেমিক্যাল ব্যবসায়ী। কোন দলিল ছাড়াই মুখে মুখে বাড়ি ভাগ করা হয়েছে।

ছোট ভাই তার অংশে ঘর তোলে ভাড়া দিলেও জাব্বারের অংশে তোলা ঘরে তার স্ত্রী তিন মেয়ে নিয়ে বাস করেন। জাব্বারের বড় মেয়ে জান্নাতুল ফেরদৌস নাফিজা নারায়ণগঞ্জ কলেজে অনার্স তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী।

মেঝো মেয়ে জাকিয়া সুলতানা সাদিয়া প্রিপারেটরি স্কুল থেকে এসএসসি পাস করেছে। আর ছোট মেয়ে তাসমিন জাহান নোহা মর্গ্যাণ গার্লস স্কুলে অষ্টম শ্রেণীতে পড়ছে।

মিলি জানান, গত ৫ জুলাই মেডিপ্লাস হাসপাতালে ডা. শফিউল আলম ফেরদৌস জাব্বারের পিঠের ফোঁড়ার অপারেশন করেন। জাব্বার ডায়াবেটিসের রোগী ছিলেন। তার ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে এনেই অপারেশন করা হয়। নিয়মিত ডায়াবেটিস পরীক্ষা ও ড্রেসিং করার পর ক্ষতস্থান প্রায় ৯০ ভাগ শুকিয়ে আসার এক পর্যায়ে ২২ জুলাই রাতে ঘুমের মধ্যে তার গলা দিয়ে গড় গড় শব্দ শুনি।

বিছানার কাছে গিয়ে দেখি তিনি অচেতন হয়ে পড়েছেন। সাথ সাথে এ্যাম্বুলেন্সযোগে প্রথমে সোহরাওয়ার্দি ,বারডেম এবং ঢাকা মেডিকেলহাসপাতালে নিয়ে যাই।

কিন্তু কোথাও না রাখায় আরিফ মিহির ভাইয়ের পরামর্শে সাইনবোর্ডের কাছে প্রো-এ্যাক্টিভ হাসপাতালে ভর্তি করাই।সেখানে তাকে আইসিইউতে রাখা হয়। ডাক্তার জানান, রক্তে সুগার ফল করায় তার ব্রেইন ফেইল করেছে। গত ২৬ জুলাই তিনি মারা যান।


আমরা তার বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করি। তার পরিবারকে জানাই গভীর সমবেদনা।