মঙ্গলবার   ২৬ নভেম্বর ২০২৪   অগ্রাহায়ণ ১২ ১৪৩১   ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

‘লকডাউন’ নিম্ন ও মধ্যবিত্তের কপালে দুঃশ্চিন্তার ভাঁজ

লতিফ রানা

যুগের চিন্তা

প্রকাশিত : ০৯:৩৯ পিএম, ১৩ এপ্রিল ২০২১ মঙ্গলবার

গতবছরের প্রায় শুরু থেকেই লকডাউন শব্দটির সাথে ব্যপক মানুষের পরিচয় ঘটেছে। এর আগে সাধারণ মানুষ লকডাউন শব্দটি জানতো না। কিন্তু করোনা মহামারির বদৌলতে এখন শিশু থেকে শুরু করে বৃদ্ধ, শিক্ষিত-অশিক্ষিত সবারই এই শব্দটির সাথে ব্যপক পরিচিতি ঘটেছে। বলা-বাহুল্য এটা সবার কাছে সুখকর কোন শব্দ নয়, বরং ভীতিকর। তবে নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তের জন্য শব্দটি শুধু ভীতিকরই নয় বরং আতঙ্কেরও বটে।

 

গতবছর লকডাউনের অভিজ্ঞতা এই দুই স্তরের মানুষের মধ্যে এমন এক ভীতিকর অবস্থা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে যে এখন লকডাউন শব্দটি শুনলেই তারা আতঙ্কিত হয়ে উঠেন। এমন সঙ্কটময় সময়েও সামাজিক অবস্থান, মানবিক মূল্যবোধের কারণে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থানসহ বিভিন্ন বিষয়ে তারা তাদের অসহায়ত্বের কথা মুখফুটে বলতে পারছেন না। তাই বিভিন্ন প্রতিকুল অবস্থায় এ দুই শ্রেণির মানুষকেই বেশী চাপে পড়তে হয়।

 

গত লকডাউনে দেখা গেছে নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তের পরিবারের প্রায় ৩০ শতাংশ মানুষের হয় আয় কমেছে না হয় আয় বন্ধ হয়ে গেছে। যারা চাকুরী করে তাদের মধ্যে অনেকেরই চাকরি চলে গেছে। যারা ক্ষুদ্র ব্যবসার সাথে জড়িত তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। এদের মধ্যে যারা শহরে বাসা ভাড়া নিয়ে থাকছেন তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ কিংবা চাকরি চলে যাওয়ার পরে তারা দীর্ঘদিন বাসা ভাড়া পরিশোধ করার মতো অবস্থানে থাকছেন না। পারছেন না বাড়িওয়ালার সামনে দাঁড়াতে।

 

তাদের অবস্থানগত কারণে কোন ত্রাণের লাইনে দাঁড়িয়ে সাহায্য নিতে তাদের সমস্যা হচ্ছে, আবার দীর্ঘদিনের অভাব সহ্য করা বা কাউকে বলতে পারাও তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। এদের অনেকেই বিকল্প কোন কিছু যদি করা যায় এই আশায় আবার গ্রামের বাড়ির দিকে ছুটছে। এর মধ্যে করোনা চলাকালে গ্রাম ও শহরের শ্রমজীবী মানুষের জন্য কমপক্ষে ১ মাসের খাদ্য ও নগদ ৫ হাজার টাকা প্রদানের দাবিতে সোমবার ১২ এপ্রিল বামগণতান্ত্রিক জোট নারায়ণগঞ্জের উদ্যোগে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করা হয়।

 

শহরের দুই নং রেলগেট এলাকার নীট ফেব্রিকস ব্যবসায়ী গোলাম রাব্বানীর বাড়ি বন্দর। তার নিজের ছোট বাড়িতে মোট ছয় জন সদস্যের পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী তিনি। তিনি জানান, আমরা শহরের বিভিন্ন হোসিয়ারিসহ ছোট ছোট গার্মেন্টস কোম্পানীর কাছে নীট ফেব্রিকস সরবরাহ করি। এখান থেকে যে আয় হয় তা দিয়ে আমাদের মোটামুটি ভালই চলে যেত। কিন্তু গতবছর করোনা শুরু হওয়া থেকেই ব্যবসা একেবারে নাই।

 

কিছু সঞ্চয় ছিল তা ভেঙ্গে এবং ঘরে যা গহণা ছিল তা বিক্রি করে এতদিন যাবত কোন রকম টিকে আছি। আবারো লকডাউন দিলে এখন কি ব্যবস্থা নিব তা বুঝতে পারছি না। আমরা যে কী অবস্থায় আছি তা বুঝাতে পারব না, আমাদের চাপা কান্না কেউ দেখে না। আমরা তো কারো কাছে হাত পাততে পারি না, সাহায্য চাইতে পারি না। আমাদের শুধুই মুখ বুঝে সহ্য করতে হয়। আর এর জন্য আমাদেরকেই বেশী দুর্ভোগ পোহাতে হয়।

 

একটি কোচিং সেন্টারে শিক্ষকতা করতেন পাঠানটুলির রফিকুল ইসলাম। করোনা মহামারীতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় তিনি উপার্জনের বিকল্প পথ হিসেবে একটি রেডিমেড গার্মেন্টস এর দোকানে সেলসম্যান হিসেবে চাকরি নেন। কিন্তু মার্কেট খোলা-বন্ধের ফাঁন্দে এখন সেখান থেকেও পাচ্ছেন না কোন বেতন। সামনে রোজা, তারপর ঈদ। সেই আনন্দ তো দুরের কথা, তার সংসারের চারজনের মুখের খাবার যোগান দেয়াই তার পক্ষে দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে।

 

ত্রাণ বা সহযোগিতার কথা বললে তিনি বলেন, ত্রাণ যেগুলো আসে জনপ্রতিনিধিদের কাছ থেকে সেগুলো এলাকার আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ বিভিন্ন দলের নেতারা একত্রিত হয়ে ভাগ করে নিয়ে যায়। সেই নেতারা তাদের সাথে যাদের ভাল সম্পর্ক এবং যারা তাদের কাছের মানুষ, শুধু তাদেরকেই দেয়। আমাদের মতো লোক, যাদের কোন নেতার সাথে পরিচয় বা সম্পর্ক নাই তারা সেই ত্রাণ পায় না।এ বিষয়ে সরকারের একটা সু-দৃষ্টি দেয়া উচিৎ উল্লেখ করে তিনি বলেন, সবাইতো আর দল করে না, বা দলীয় কোন লোকের সাথে সম্পর্ক তৈরী হয় না। কিন্তু সরকার তো সবার। তাহলে সাধারণ মানুষ কেন সরকারের সহযোগিতা পাবে না?

 

গত বছরের এপ্রিলে বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক ভিডিও কনফারেন্সে সরকারি সেফটিনেটের বাইরে থাকা নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত মানুষের ঘরে খাবার পৌঁছে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। এ বিষয়ে তালিকা তৈরি করে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য তিনি স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ মাঠ প্রশাসনকে নির্দেশনা দিয়েছেন। কিন্তু এখনও পর্যন্ত তার কোনো বাস্তবায়ন চোখে পড়ছে না।

 

যদিও দেশের প্রচলিত আইনে মধ্যবিত্তের কোনো সংজ্ঞা নেই। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মের পর থেকে বিভিন্ন সংস্থার বিভিন্ন বিশ্লেষণ বা গবেষণা থাকলেও এখন পর্যন্ত সঠিকভাবে মধ্যবিত্তের কোন সংজ্ঞা নির্ধারণ করা হয়নি। তবে বিভিন্ন সংস্থার বিশ্লেষণ করলে আমরা এইটা ধরে নিতে পারি যে, দারিদ্র্য সীমার একটু উপরে যে জনগণ আছে এরা হলো নিম্ন মধ্যবিত্ত, এবং তাদের কাছ থেকে একটু উন্নত জীবনযাপন যারা করেন তারা মধ্যবিত্ত। এই দুই শ্রেণির লোক স্বাভাবিক অবস্থায় মোটামুটি ভাল অবস্থানে থাকলেও যে কোনো দুর্যোগ-দুর্বিপাকে তারা খুবই অসহায় হয়ে পড়েন। এদের অনেকেই হয়তো পরে পরিস্থিতি আবার কাটিয়ে ওঠতে সফল হন। তবে এরাই এখন সবচেয়ে বেশি সংকটের মুখে আছেন।

 

এ স্তরের মানুষগুলো সাধারণত বেশী সচেতন থাকেন। অনেক হিসাব-নিকাশের উপর ভিত্তি করে তাদের পরিবার চালাতে হয়। প্রতিমাসে যে বাজেট থাকে, তার মধ্যেই তারা সীমাবদ্ধ থাকার চেষ্টা করে। এর বাইরে কোন অহেতুক টাকা তারা খরচ করতে চান না। এর ব্যতিক্রম হলে তাদের বিপদে পড়তে হয়। নি¤œ-মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো কোনো বাড়তি খরচ করতে চাইলে তাদের ঋণ গ্রহণ করতে হয়। যার বোঝা তাদের বছর জুড়ে টানতে হয়। এদের মধ্যে যারা সরকারী চাকুরী করেন, তাদের তেমন কোন বিপদে পড়তে হয় না। কিন্তু যারা বেসরকারি চাকরি করেন তারা এ অবস্থায় খুবই ঝুঁকির মুখে পড়েছেন। তারা এখন জমানো টাকা শেষ করেছেন। এর পর হয়তো অনেকেই বাধ্য হয়েই ঋণ গ্রহণ করে তাদের অবস্থান বজায় রাখার চেষ্টা করবেন।
 
বিআইডিএস-এর সাম্প্রতিক জরিপে বলা হচ্ছে, শুধু করোনায়ই প্রায় এক কোটি ৬৪ লাখ মানুষ নতুন করে গরিব হয়ে দারিদ্র্য সীমার নীচে নেমে গেছে। তাই এখন দেশে গরিব মানুষের সংখ্যা পাঁচ কোটির বেশি।

 

এ বিষয়ে নারায়ণগঞ্জ নাগরিক কমিটির সাধারণ সম্পাদক জাহিদ আলম দিপু বলেন, আমিও নিজেও করোনায় আক্রান্ত, এখনো আমি চিকিৎসাধীন আছি। সুতরাং করোনার কষ্টটা আমি বুঝি। তাই লকডাউন অবশ্যই দরকার। তবে নিম্ন মধ্যবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত যারা আছেন তারা করো কাছে যেতে পারে না। তারা না খেয়ে ঘরে পড়ে থাকলেও কারো কাছে বলতে পারেন না। তাই সরকারসহ বিভিন্ন সামর্থবানদের উচিৎ তাদের দিকে আলাদা একটু নজর দেয়া। তিনি বলেন, সরকার হাজার হাজার কোটি টাকার বড় বড় প্রজেক্ট করেন, সরকারের সামর্থ্য আছে। সুতরাং যদি চেষ্টা করে এবং এ বিষয়ে যাতে কোন প্রকার দুর্নীতি না  হয় তাহলে আমি মনে করি এ ধরণের মানুষের অসহায়ত্ব অনেকটাই কমে যাবে।

 

এ বিষয়  সাংস্কৃতিক ব্যাক্তিত্ব রফিউর রাব্বী বলেন, লকডাউনে যারা দিন আনে দিন খায় তাদের সাথে সাথে নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারের মাঝে প্রণোদনা দেয়া জরুরী, এবং আমরা এর দাবি জানাই। গত বছর লকাডাউনে প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দেয়ার পর কিছু কিছু জায়গায় এ ধরণের লোকদের মাঝে সাহায্য দিয়েছে। তবে যেটা সব সময়ই হয়, রাজনৈতিক দল বা নিজেদের দলের উর্ধ্বে তার কখনো উঠতে পারে না। আমরা যতই বলি তারা তাদের দল এবং রাজনৈতিক মানুষদেরই এই তালিকার মধ্যে রাখে, এখানে ভোটের রাজনীতিও কাজ করে।