মঙ্গলবার   ২৬ নভেম্বর ২০২৪   অগ্রাহায়ণ ১২ ১৪৩১   ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

একটি সিজারে সারাজীবনের পঙ্গুত্ব!

ফরিদ আহম্মেদ বাধন

যুগের চিন্তা

প্রকাশিত : ০৬:০৮ পিএম, ২০ জুন ২০২১ রোববার

বিয়ের কয়েক মাস পরেই সুমনা সন্তান সম্ভবা হয়। মা হওয়ার আনন্দে সুমনা ও তার শ্বশুর বাড়ির লোকজনদের মনেও চলছিল আনন্দ। গর্ভধারনের ৫ মাসের মাথায় নারায়ণগঞ্জের একটি ক্লিনিকে গাইনি চিকিৎসকের তত্বাবধানে গিয়েছিল সুমনা। তার চেম্বারে মাঝে মাঝে চেকআপে  যেতেন তিনি। সন্তান জন্মের কিছুদিন আগে থেকে ঐ গাইনী চিকিৎসক সুমনাকে সিজারের কথা বলে।

 

সিজারের কথা শুনে ভয় পেয়েছিল সে। কিন্তু কিছু করার ছিল না। শেষ পর্যন্ত তাকে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী সিজার করিয়ে সন্তান জন্ম দিতে হয়। সন্তান জন্মদানের পর থেকে বেশ কিছু শারিরীক সমস্যায় ভুগছেন তিনি। এমনি ভাবে হাজারো প্রসুতি চিকিৎসকের তত্বাবধানে থেকে চিকিৎসা করাতে গিয়ে সিজারের সম্মুখিন হয়েছেন। সেই সাথে আজীবন এক ধরনের যন্ত্রণা নিয়েই বেঁচে থাকতে হচ্ছে সিজার করা মায়েদের। বিয়ের পর পরই একজন মা সন্তান প্রসব করতে গিয়ে চিরতরে পঙ্গু হয়ে যাচ্ছে।

 

প্রাচীনকালে দাদী,নানী,খালা,মামীদের বাচ্চা হতো। গ্রামের দাইমার হাতে সন্তান প্রসব হতো। কোনো বাড়িতে কোনো নারীর পেটে বাচ্চা আসার পরপরই গ্রাম বা শহরে দাইমায়ের খোঁজ খবর রাখতেন প্রসুতির পরিবার। প্রসব ব্যাথা উঠার পরপরই দাইমাকে বাসায় ডাকা হতো। আর তাঁদের হাতেই সন্তান প্রসব হতো। প্রসুতি মৃত্যুর তেমন কোনো খবর পাওয়া যেতো না। এখন যাকে বলা হয় নরমাল ডেলিভারী একজন দাইমা তাই করতেন। বর্তমানে নরমাল ডেলিভারী যেনো স্বপ্ন। হাতে গোনা দুইএকজন ব্যাতিত নরমালা ডেলিভারী জেনো অসম্ভব।

 

দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মতো নারায়ণগঞ্জের হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোতে প্রসুতীর সিজার করা জেনো বাধ্যতা মূলক হয়ে দাঁড়িয়েছে। একজন গাইনি চিকিৎসকের কাছে প্রসুতির প্রাথমিক চিকিৎসা করানো মানে সন্তান জন্মদানের আগে তাকে সিজারের জন্য প্রস্তুত করা। অনাকাঙ্খিত সিজারের কবলে পড়ে মায়েরা আজ পঙ্গু হয়ে যাচ্ছে। জেনো তেনোভাবে সিজার করানোর ফলে অনেকে অকালেই দুনিয়া থেকে বিদায় নিচ্ছেন। একেকটি ক্লিনিকে একেক রকম বাজেট ধরা হয় প্রসুতির সিজার করানোর জন্য। সবোর্চ্চ ৫০ হাজার থেকে সর্বনিম্ন ২০ হাজার টাকা নেয়া হয় একজন প্রসুতীর কাছ থেকে। আবার নারায়ণগঞ্জের পাড়া মহল্লায়ও গড়ে উঠেছে বেশ কিছু ছোট ছোট ক্লিনিক। কোনো অনুমোদন না থাকলেও ঐ সমস্ত ক্লিনিকগুলোতে চলে প্রসুতীর অপারেশন।

 

তথ্যমতে,যদি নারীর প্রসবে জটিলতা থাকে তাহলে একজন চিকিৎসক  তাকে অপারেশন করতে পারেন। যদি স্বাভাবিকের চাইতে প্রসব বেদনা যদি দীর্ঘ হয়, গর্ভ ফুল যদি জরায়ু মুখের কাছে নেমে আসে, প্রসবের পূর্বে যদি নারী জরায়ু বাইরে বেড়িয়ে আসে এছাড়াও গর্ভবতী মায়ের উচ্চ রক্তচাপ,ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, ডিম্বাশয় ও জরায়ুর সিস্ট, টিউমার থাকলে সিজারের মাধ্যমে বাচ্চা জন্ম দেওয়া হয়। তবে আমাদের দেশে সিজার এখন বাধ্যমূলক করে নিয়েছে চিকিৎসকরা। কারন সিজার মানেই চিকিৎসক বা ক্লিনিকের বাড়তি আয়। মা বা শিশুর অবস্থা যদি শোচনীয় হয় একমাত্র সে অবস্থায় সিজার করা যেতে পারে । কিন্তু এখন টাকার নেশায় অন্ধ হয়ে গেছে বেশিরভাগ চিকিৎসক।  

 

২০০৭ সালে ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নাল বিভিন্ন হাসপাতালের উপর জরিপ পরিচালনা করে। জরিপে উঠে আসে প্রসবের তুলনায় সিজারিয়ান করা মায়েদের মৃত্যু ঝুঁকি তিন গুণ বেশি। স্বাভাবিক  প্রসবের ক্ষেত্রে যেখানে মৃত্যু ঝুঁকি ০.১%। জরিপে আরো উঠে আসে,সিজারের কারণে জন্ম নেওয়া বাচ্চাদের স্বাস্থ্যের ঝুঁকি থাকে অনেক বেশি। সিজারিয়ানের মাধ্যমে জন্ম নেওয়া বাচ্চার জন্ম পরবর্তী শ্বাস প্রশ্বাস জনিত জটিলতা বেশি পরিলক্ষিত হয়। একবার সিজার হবার পর পরবর্তী দুই বছরের মধ্যে একজন মাকে বাচ্চা নিতে নিষেধ করা হয় ।

 

কারণ বাচ্চা ধারন  করলে তা সেলাই অংশে মারাত্মক ক্ষতি করে। এরপরও অনাকাঙ্খিতভাবে কোন মা যদি বাচ্চা ধারণ করে ফেলে তবে মা ও শিশু থাকেন প্রচন্ড স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে। এছাড়া সিজার করা মায়েরা ৩ বারের বেশি বাচ্চাও নিতেও পারে না।  অপরদিকে, সিজারিয়ানের ফলে যে প্রসুতীকে যে এনেসথেসিয়া দেওয়া হয় তার প্রভাবে নারীদের স্থায়ী কোমর ব্যথার সমস্যা দেখা দেয়। যাকে একটি স্থায়ী পঙ্গুত্বের সাথে তুলনা করা যায়।