মঙ্গলবার   ২৬ নভেম্বর ২০২৪   অগ্রাহায়ণ ১২ ১৪৩১   ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

‘বাগানের কথা শুনলে কেউ ঘর ভাড়াও দিতে চায় না’

মামুনুর রহমান

যুগের চিন্তা

প্রকাশিত : ০৬:১৭ পিএম, ২০ জুন ২০২১ রোববার

# উত্তর ও দক্ষিণ কুমুদিনী বাগানে বসবারত বিহারি ও বাঙালি ৬০০ শ্রমিকের পরিবার বাগান ছাড়ছে
 
একদিকে বৃষ্টি অন্য দিকে সরাতে হবে ঘর দুয়ারসহ মালামাল। কারণ বেঁধে দেওয়া হয়েছে সময়সীমা। এই সময়ের আগেই সরাতে হবে মালামাল তাই বৃষ্টি মধ্যে ভিজেও মালামাল সরাচ্ছে শহরের কুমুদিনী বাগানের হেলেনা বেগম। হেলেনা বেগম বলেন, আগামী ৩০ জুনের মধ্যে আমাদেরকে এখান থেকে চলে যেতে বলেছে । সেই সাথে সরাতে বলেছে নিজেদের মালামাল। এখানে নাকি হাসপাতাল বানাবে তারা। তার জন্য আমাদেরকে মালামাল নিয়ে চলে যাইতে বলা হয়েছে।

 

তাই আগেভাগেই যাই গাঁ না হলে শুনছি বুল ড্রেজার দিয়ে ভাইঙ্গা দিবো। এইসব কথা গুলো যেন খুব আবেগ আপ্লুতভাবে বললেন শহরের উত্তর কুমুদিনী বাগানে দীর্ঘ তিন যুগ ধর বসবাসকৃত এই নারী। তিনি বলেন, হঠাৎ করে  কুমুদিনী কোম্পানী বলেন তারা নাকি এখানে হাসপাতাল বানাবে । তাই সবাইকে এই বাগান ছেড়ে দিতে হবে। আমরা তিন পুরুষ ধরে এখানে বসবাস করে আসছি। যখন কুমুদিনী পাটের মিলস ছিলো তখন আমাদের দাদা এখানে আসে। বাঙ্গালিরা তো পাটের কাজ তখন জানতেও না। তখন পাকিস্তান ও ইন্ডিয়া থেকে শ্রমিক এনে কাজ করাতো। সেই সময় আমাদের বসবানের জন্য কুমুদিনী কোম্পানী জায়গা দেয়। আমরা পাকিস্তানী। আমাদের তো যাওয়ার  কোনো জায়গা নাই। এখন আমরা কোথায় যাবো। কোথায় ঘর ভাড়া পাই না। আর বাগানের কথা শুনলে কেউ ঘর ভাড়াও দিতে চায় না।

 

তিনি আরও বলেন, কুমুদিনী কোম্পানীর তো আর টাকা - পয়সা ও জায়গা সম্পত্তির অভাই নাই । তারা চাইলে আমাদের এ সকল গরীব অসহায় পরিবার গুলোকে পূনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে পারে। আমাদের তিন পুরুষ তো এই কুমুদিনী কাজ করেছিলো। এখন আমাদের শেষ ভরসা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী । তিনি যদি আমাদের জন্য কিছু করে তা নাহলে পরিবার নিয়ে গাছ তলায় থাকতে হবে। সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, শহরের দক্ষিণ ও উত্তর কুমুদিনী বাগানের বসবাসকৃত শ্রমিকেরা তাদের ঘর- দুয়ার  মালামাল খুলে অন্যত্থায় সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। কেউ বা ভ্যান আবার কেউ মিনি ট্রাক ভাড়া করে ভাড়া বাসার গন্তব্যে ছুটছে। আবার অনেকই বাগানের পাশে মালামাল খুলে বসে আছে।

 

দীর্ঘ যুগের পর যুগ ধরে বসবাসের যে মায়া তা যেনো ছেড়ে যেতে পারছে না মন। যাওয়ার সময় যেনো বার বার ফিরে দেখে বসবারের শেষ ঠিকানাকে। দীর্ঘ দিন ধরে তিলে তিলে গড়ে তুলা ঘর-বাড়ি আসবারপত্র  কিছু যেনো রেখে যাচ্ছে না তারা। ঘরের টিনসহ বাঁেশের পাল্লা এমনকি ইট পর্যন্ত খুলে নিয়ে যাইতাছে। বসবাসকৃত ছেড়ে যাওয়া শ্রমিকদের সাথে আলাপকালে তারা বলেন, আমরা কোনো দিন কল্পনাও করতে পারেনি যে আমাদেরকে এই জায়গা ছেড়ে দিতে হবে। আমাদের তিন পুরুষ ধরে আমরা এখানে বসবান করে আসছি। এইটা কোন মানবতা হলো না। হাসপাতাল হবে সেইটা আমরাও চাই, এই জায়গা ছেড়ে দিব। হাসপাতাল হলে সকলের উপকার হবে। কিন্তু আমরা যারা দীর্ঘ যুগের পর যুগ ধরে আছি আমাদের জন্য তো পূর্নবাসনের ব্যবস্থা তা তো করবে।

 

আমাদেরকে পুর্নবাসনের জন্য দাবিও জানাইছি। কুমুদিনী কোম্পানী গরীবের জন্য সব সময় পাশে থাকে, আমরা জানি। আমাদেরকেও দয়া করেই এই জায়গা দেওয়া হয়ে ছিলো। আজকে এই সকল অসহায় মানুষ গুলো কোথায় যাবে। তারা চাইলে আমাদেরকে পূর্ণবাসনের ব্যবস্থা করে দিতে পারেন। কিন্তু করছে না। এইটা কোনো মানবতা হলো না। আমরা প্রধানমন্ত্রীর বরাবার আবেদন করেছি আমাদের যেনো পূর্ণবাসনের ব্যবস্থা করা হয়। লাখ লাখ রোহিঙ্গারা যদি এদেশে আশ্রয় পায় এবং তাদেরকে পূর্ণবাসনের ব্যবস্থা করা হয় তাহলে আমাদেরকে কেনা করা হবে না।

 


দক্ষিণ কুমুদিনী বাগানের ইলিয়াস বলেন, আমাদের পূর্বপুষরা ব্রিটিশ শাসন আমল থেকেই কুমুদিনীর পাট কারখানায় কাজ করেছেন। তখন বাঙ্গলিরা পাটের কাজ জানতো না, তখন পাকিস্তানি ও ইন্ডিয়ান থেকে বিহারীদের এনে এই পাটের কাজ করেন। তখন শ্রমিকদের থাকার জন্য এই বাগানে ঘর করে দেয়।  এই ওয়ারিশ সূত্রে পাওয়া ঘরেই পরিবার-পরিজন নিয়ে কুমুদিনী বাগানেই থাকি। আমি নিজেও কুমুদিনীর শ্রমিক ছিলেন।

 

ঔইদিন আমাদের হঠাৎ করে জানান বাগান ছেড়ে দিতে হবে। আমরা দুই বাগানে মিলে প্রায় সাড়ে তিশত পরিবার আছি পাকিস্তানি ও ইন্ডিয়ান মিলে। আর বাকী প্রায় আর তিনশত পরিবার আছে তারা বাইরের। তিনি আরও বলেন, যারা বাইরের লোক ও ভাড়াটিয়া আছে তারা চলে যাইতাছে। আমরা কোথায় যাবো। আমাদের যাওয়ার তো কোনো জায়গা নাই । আমরা যারা পাকিস্তানি ও ইন্ডিয়ান বিহারী আছি আমরা পূর্নবাসন চাই। আমরা পূর্নবাসন ছাড়া কোথায় যাবো। আমরা ইতিমধ্যে আমাদের আইনজীবীর মাধ্যমে পূর্নবাসনের জন্য আবেদন করেছি।

 


প্রসঙ্গত, কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের বেঙ্গল বিডি লিমিটেড পাট কারখানার পাকিস্তানি ও ইন্ডিয়ান তিনশ’ বিহারি শ্রমিক পরিবার বাস করেন উত্তর ও দক্ষিণ কুমুদিনী বাগানে। আরও তিনশ মতো বাঙালি পরিবারও থাকে এই বাগানে। নারায়ণগঞ্জে  কুমুদিনী ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব মেডিকেল সায়েন্স এন্ড ক্যান্সার রিসার্চ (কেআইআইএমএস কেয়ার) স্থাপন করা হবে। গত ১৪  ফেব্রুয়ারি গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এইপ্রকল্পের ভিত্তি প্রস্তর উদ্বোধন করেন। এই প্রকল্পের আওতাধীন ছাত্রী  হোস্টেল নির্মাণের জন্য ঈশা খাঁ সড়কের নারায়ণগঞ্জ ৩শ’ শয্যা হাসপাতালের পাশের উত্তর কুমুদিনী বাগানের জায়গা নেওয়া হবে।

 

এজন্য এই বাগানে বসবাসরত শ্রমিকদের ঘর ছাড়তে হবে। তবে  শ্রমিকদের দাবি ছিল, দীর্ঘদিন জুট প্রেসে (পাট কারখানা) কাজ করা শ্রমিকদের শ্রম আইন অনুযায়ী পাওনাদি পরিশোধের। অন্যথায় পুনর্বাসন দাবি করেছিলেন তারা। শ্রমিকদের দাবি থাকলেও মালিকপক্ষ তা দিতে নারাজ। গত ৮ জুন জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের সাংসদ একেএম সেলিম ওসমানের উপস্থিতিতে এক বৈঠকে ঘর ছেড়ে দিলে মালামাল আনা-নেওয়া বাবদ ৩ হাজার টাকা  প্রদানের সিদ্ধান্ত হয়। আগামী ৩০ জুনের মধ্যে এই শর্তে ঘর ছেড়ে দিতে হবে। এরপর গত ১২ জুন ‘ক্যান্সার হাসপাতাল নির্মাণ বন্ধের পায়তারা করছেন‘ এমন অভিযোগ তুলে নারায়ণগঞ্জ চেম্বার অব কমার্সের ব্যানারে এই মানববন্ধনে অংশ নেয় বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠন, ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মী।