জীবিকার টানে করোনার ভীতি উপেক্ষিত ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় শিশুরা
যুগের চিন্তা অনলাইন
যুগের চিন্তা
প্রকাশিত : ০৯:২১ পিএম, ২৬ জুন ২০২১ শনিবার
বৈশ্বিক মহামারী করোনার প্রার্দূভাব ও বর্তমান বাস্তবতায় জীবিকার টানে শিশু, কিশোর, আবাল, বৃদ্ধ, বনিতা সব মিলিয়ে সাধারণ মানুষের মাঝে করোনা ভীতি উপেক্ষিত। বিশেষ করে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের খাদ্যের যোগান দিতে সোনারগাঁ উপজেলার বিভিনস্থানে জীবন ঝুঁকিতে জাল মুড়ি বিক্রি, চটপটি, হালিম, সূরক্ষা সামগ্রী মাস্ক বিক্রিসহ অটোরিকশা নিয়ে রাস্তায় শিশুরা।
এছাড়া হোটেল রেস্তোরায়, রুটি, বিস্কুটের কারখানা বেকারীতে, ওয়ার্কসপ ওয়েল্ডিং, মাছ বাজারে পানি টানা, ফার্নিচার দোকানে রামদা দিয়ে কাঠ ছিলা, ড্রিল মেশিনে ছিদ্র করা, ইট ভাঙ্গা, ভাঙ্গারী টোকাই ও ব্যক্তি মালিকানা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে শ্রম দিচ্ছে মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের শিশুরা। দেশে মহামারী করোনা ভাইরাসের প্রার্দূভাব শুরু হওয়ার পর থেকে দিনমজুর, খেটে খাওয়া সাধারন শ্রমজীবি, বিভিন্ন পেশাজীবি, কর্মহীন হয়ে পড়া দেশের মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষের মাঝে এপর্যন্ত সরকার কয়েকদফায় ত্রাণ বিতরণ, উপহার সামগ্রী বিতরণসহ ও নগদ অর্থ সহায়তা প্রদান করেছেন।
তাছাড়া সরকার বিভিন্ন প্রনোদনাসহ মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত, হতদরিদ্র পরিবারের অনেক সদস্যদের মাঝে মোবাইল ব্যাংককিংয়ের মাধ্যমে নগদ অর্থ প্রদান, বয়স্কভাতা, বিধবাভাতা, প্রতিবন্ধিভাতা, শিশুদের মাঝে উপবৃত্তি প্রদানসহ সরকারী বিভিন্ন কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। সরকারী সহায়তার পাশাপাশি স্থানীয় ভাবে বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন, সেবামূলক প্রতিষ্ঠান, দেশের শিল্পমালিক, ব্যক্তি উদ্যোগে সমাজের বিত্তশালী লোকজন, স্থানীয় অনেক জনপ্রতিনিধি ও প্রবাসীদের ভূমিকায় কর্মহীন হয়ে পড়া বিভিন্ন পেশাজীবি মানুষ ত্রান সহায়তা ও নগদ অর্থ সহায়তা পেয়েছেন তারা। বর্তমান সময়ে সরকারী, বেসরকারী ত্রান সহায়তা অনেকটা স্থবির হয়ে পড়ায় নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে জীবিকার তাগিদে করোনা ভীতি উপেক্ষা করে মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের অনেক শিশুরা এখন বাধ্য হয়ে ছোটখাটো বিভিন্ন কাজে ও ব্যাটারী চালিত অটোরিকশা নিয়ে রাস্তায় নেমেছেন। তবে এসব শিশুদের বয়স অনুর্ধ ৭ থেকে ১২ বছর।
সোনারগাঁ উপজেলা সদরের একটি রাস্তায় জাল মুড়ি বিক্রেতা শিশু শরীফ হোসেন (১০) জানান, তার পিতা সাপ্তাহিক হাটের একজন কুলি। করোনার আগে সে বিভিন্ন হাটবাজারে সপ্তাহব্যাপী মানুষের বিভিন্ন ভোজা বহন করে যে টাকা পাওয়া যেত তা দিয়ে আমাদের সংসার চালাতো। করোনার কারনে এখন আর বিভিন্ন হাট বাজারে যেতে পারেনা। তাই আমাদের সংসারে অনেক অভাব। বাধ্য হয়েই আমাকে জাল মুড়ি বিক্রির জন্য রাস্তায় নামতে হয়েছে। কিন্তু করোনার কারনে মানুষের কামাই রোজি না থাকায় তেমন বেচা বিক্রি করতে পারিনা।
চলার পথে অটো চালক শিশু সজল মিয়ার (১১) সঙ্গে কথা হলে সে বলে, তার বাবা একজন দিনমজুর। করোনা পরিস্থিতির কারনে তার বাবার কাজকর্ম বন্ধ হয়ে যাওয়ায় গত কয়েক মাস ধরে পরিবারে কোন আয় উপার্জন নেই। সরকারী ত্রান সহায়তায় গত ঈদের আগে পর্যন্ত চাল, ডাল, আলু, পেঁয়াজের যোগানে কোনো মতে সংসার চললেও বর্তমানে বাবা, মা, ভাই, বোন মিলে পাঁচ সদস্যের পরিবারের অবস্থা অনেকটা নাজুক। তাই পরিবারের সবার খাবারের যোগান দিতে বাধ্য হয়ে ভাড়ায় ব্যাটারী চালিত অটো রিকশা নিয়ে রাস্তায় নামছি। করোনা ভাইরাসের কারনে মানুষ তেমন বাহির না হওয়ায় যাত্রীও পাওয়া যায় না।
আর্ন্তজাতিক ও জাতীয় শ্রমনীতিমালা অনুযায়ী ১৪ বছর বয়সের নিচে শিশুদের কাজ করার বিধান না থাকলেও বর্তমানে করোনা মহামারীর কারনে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের ৭ থেকে ১২ বছর বয়সের অনেক শিশুকে বিভিন্ন শ্রম ক্ষেত্রে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে দেখা যাচ্ছে। সরকার দেশের সব শিশুদের জন্য প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামুলক করলেও অভিভাবক সচেতনতার অভাবে এখনো অনেক শিশুরা ঝুঁকিপূর্ণ বিভিন্ন কাজে জড়িত।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, অধিকাংশ ব্যক্তি মালিকানা প্রতিষ্ঠানে ঝুঁকিপূর্ণ খাতে শিশুরা কাজ করছে। বেশির ভাগ শিশুই হোটেল রেস্তোরায়, রুটি, বিস্কুটের কারখানা বেকারীতে, রিক্সাচালনা, ওয়ার্কসপে ওয়েল্ডিং, মাছ বাজারে পানি টানা, ফার্নিচার দোকানে রামদা দিয়ে কাঠ ছিলা, ড্রিল মেশিনে ছিদ্র করা, ইট ভাঙ্গা, ভাঙ্গারী টোকাই ও ব্যক্তি মালিকানা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে শ্রম দিচ্ছে তারা। শিশু অধিকার আইন মেনে চলা প্রসঙ্গে শিশুদের অধিকার নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থা, মানবাধিকার সংগঠনের কর্মীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, শ্রমনীতিমালা অনুযায়ী যেসব নিয়ম রয়েছে করোনা পরিস্থিতির কারনে এখন মানা সম্ভব হচ্ছেনা। উন্নয়ন সংস্থা ও মানবাধিকার সংস্থার একজন সদস্য বলেন, শ্রমনীতিমালা অনুযায়ী শিশুশ্রম সম্পূর্ণ ভাবে নিষিদ্ধ হলেও করোনা পরিস্থিতির কারনে এখন ভিন্নচিত্র। নিয়ম মানার ক্ষেত্রে সরকারের স্বদিচ্ছার কোন ঘাটতি না থাকলেও মুল সমস্যা রয়েছে অভিভাবক সচেতনতা ও প্রশাসনিক তৎপরতায়। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেই শিশুশ্রম বন্ধে আমরা তদারকি করে প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য সুপারিশ করব।
তিনি মনে করেন, দেশের আর্থ সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন ও শিশু অধিকার আইন যতদিন কার্যকরি হবে না, তত দিন শিশু অধিকার আইন পুরোপুরি বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থা ও শিশুদের নিয়ে কাজ করা মানবাধিকার সংগঠনের কর্মীদের অভিমত, দেশের দরিদ্র জন গোষ্ঠির মাঝে বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে প্রশাসনিক কাঠামোতে বিশেষ নজরদারী ও তদারকি ব্যবস্থা চালু না হলে পুরোপুরি শিশু শ্রম বন্ধ করা অসম্ভব। তারা বলেন, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দরিদ্র পরিবারের শিশুরাই ঝুঁকিপূর্ণ কাজের সঙ্গে জড়িত। শিশু অধিকার রক্ষায় কাজ করা খেলাঘর সংগঠনের সোনারগাঁ উপজেলা শাখার সাধারন সম্পাদক রাজা রহমান রাজন জানান, হত দরিদ্র পরিবারের শিশুদের অধিকার রক্ষায় আমাদের খেলাঘর সংগঠনের কার্যক্রম অব্যাহত ছিল। করোনা পরিস্থিতির কারনে আমরা এই মূহুর্তে মাঠ পর্যায়ে যেতে পারছিনা।
তবে কোন শিশুর উপর অমানবিক নির্যাতনের খবর পেলেই আমরা প্রশাসনিক সহায়তায় সেখানে গিয়ে তাৎক্ষনিক প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহন করে থাকি। ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম বন্ধে প্রথমে অভিভাবক সচেতনতা, পাশাপাশি নাগরিক সচেতনতা ও সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা প্রয়োজন। ইতিপূর্বে শিশু অধিকার রক্ষায় নাগরিক সচেতনতা ও সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলার লক্ষে কয়েক দফায় আমরা উপজেলার বিভিন্নস্থানে মানব বন্ধন কর্মসূচী পালনসহ পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নাগরিক সচেতনতামূলক সভা করেছিলাম। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে পুনরায় ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম বন্ধে তদারকি করে আমরা প্রতিরোধ গড়ে তুলব।