মঙ্গলবার   ২৬ নভেম্বর ২০২৪   অগ্রাহায়ণ ১২ ১৪৩১   ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

বাস্তবে নেই ফাজেলপুর খাল !

যুগের চিন্তা অনলাইন

যুগের চিন্তা

প্রকাশিত : ০৭:০৪ পিএম, ৩০ জুন ২০২১ বুধবার

# কালিয়ানী-ফাজেলপুর, পঞ্চবটি ও কাশীপুর হয়ে সংযোগ ছিল শীতলক্ষ্যায় 


# দখলের কারণে পরিণত হয়েছে সরু ড্রেনে, সিংহভাগের অস্তিত্ব নেই


ফতুল্লার এনায়েতনগর ভূমি অফিসের নকশায় থাকলেও বাস্তবে নেই ফাজেলপুর খাল। এক সময় যেখানে চলতো পালতোলা নৌকা ও পন্যবাহি নৌযান, সেখানে এখন গড়ে উঠেছে সু-বিশাল অট্টালিকা! দখল-দারিত্বের ফলে সিংহভাগ স্থানেই খালের অস্তিত্ব নেই। খালের কোথাও আবার পরিণত হয়েছে সরু ড্রেনে ! খালের বুকে কোথাও বসত বাড়ি আবার কোথাও গড়ে উঠেছে ছোট বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। এক সময়ের খরস্রোতা ও প্রাণবন্ত এই খালটির পুরো অংশ জুড়ে চালানো হয়েছে দখলদারিত্বের এমন রামরাজত্ব।  

 

গতকাল সরেজমিনে দেখা যায়, খালটি ফতুল্লার আলীনগর-ফাজেলপুর এলাকা দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ফতুল্লার যমুনা ডিপো সংলগ্ন বধ্যভূমি পর্যন্ত এসে উধাও হয়ে গেছে। এনায়েতনগর ইউনিয়ন ভূমি অফিস সূত্রে জানা গেছে, বুড়িগঙ্গা নদী থেকে  উৎপত্তি হওয়া এই শাখা খালটির দৈর্ঘ্য ১১০০ ফুট। আর প্রস্থ ১৫ থেকে ২০ ফুট পর্যন্ত। দৈর্ঘ্য-প্রস্থের এই হিসেব ভূমি অফিসের নকশায় থাকলেও বাস্তবে নেই! সরেজমিনে দেখা যায়, ফতুল্লার ফাজেলপুর এলাকার বুড়িগঙ্গা নদী থেকে শুরু করে যমুনা তেলের ডিপো সংলগ্ন বদ্ধভূমি পর্যন্ত এসে খালটির সর্বশেষ চিহ্নও বিলিন হয়ে গেছে। বদ্ধভূমি থেকে দক্ষিণে খাল বয়ে যাওয়ার তথ্য ম্যাপে থাকলেও বাস্তবে তা নেই।

 

এখানে গড়ে উঠেছে সারি-সারি বসত ঘর ও বিভিন্ন ব্যবসায়ীক স্থাপনা। ফাজেলপুর ও আলীনগর মৌজার সীমানা ঘেষে বয়ে যাওয়া এই খালের প্রায় দু’পাশই দখল হয়ে আছে। খালপাড় ঘেঁষা জমির মালিকরা তাদের বসত বাড়ি নির্মাণ করেছেন খাল ভরাট করে। একতলা থেকে শুরু করে চারতলা পর্যন্ত শতাধিক বসত বাড়ি গড়ে উঠেছে খালের সীমানায়। শুধু তাই নয়, এনায়েতনগরের বিসিক এলাকা দিয়ে বয়ে যাওয়া ঐহিত্যবাহি কালিয়ানী খালও দখল হয়ে আছে। খালের পুরনো সেই ঐতিহ্যের স্মৃতিচারণ করে ফাজেলপুর এলাকার বাসিন্দা ইলিয়াস (৫৫) যুগের চিন্তা’কে বলেন, “এক সময় এই খালে নৌকা চলত। পন্যবাহি ট্রলারও চলতে দেখেছি। আমরা খাল থেকে মাছ শিকার করে সংসার চালাতাম। পানি পরিস্কার থাকায় সবাই এই খালেই গোসল করতাম। এখন এগুলো গল্প মনে হবে। কারণ খালইতো নেই। ড্রেনে রূপ নিলেও সেই ড্রেনও আটকে আছে। খালের জায়গায় রাস্তা হয়েছে।

 

স্থানীয় অনেকেই খাল দখল করে বাড়ি নির্মান করেছে। সরকার উদ্যোগ না নিলে একসময় হয়তো এই ড্রেনও থাকবে না।’ ইলিয়াস মিয়া আরো বলেন, “প্রতিবছর দেখা যায়, এনায়েতনগর ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে এই খালের বিভিন্ন স্থানে ভেকু দিয়ে পরিস্কার করা হয়। কিন্তু দখলমুক্ত না করায় এবং স্থানীয়রা খালের মধ্যে গৃহস্থালির ময়লা ফেলায় খাল আবারও দখল ও ভরাট হয়ে যাচ্ছে। এজন্য স্থায়ী সমাধান প্রয়োজন।’ সরেজমিনে দেখা যায়, ফাজেলপুর-আলীনগর এলাকার বুড়িগঙ্গার শাখা খালটি কালিয়ানী খালের সাথে যেই স্থানে সংযোগ হয়েছে, সেখান থেকে কিছু দুর এগিয়ে গেলেই দেখা মিলবে আস্তরবিহীন ৩ তলা বিশিষ্ট একটি বিশালাকৃতির ভবন। ভবনটির মালিক সোহেল মিয়া। ভবনের উপরে ৪তলা করার জন্য কলাম নির্মানও করিয়েছেন তিনি।

 

তবে, তার বাড়ির পশ্চিম পার্শ্বের দিকে খালের প্রায় অর্ধেকেরও বেশি জায়গা দখল করে বিশালাকৃতির ওই ভবন গড়ে তুলেছেন। ফলে ভবনটিও হয়ে উঠেছে ঝুঁকিপূর্ন। যেকোন সময় খালের দিকে হেলে পড়তে পারে বরে শঙ্কা প্রকাশ করছেন অনেকেই। কেবল সোহেল মিয়াই নন, তার পার্শ্ববর্তী বাড়ির মালিক নূরা সেক্রেটারীও একই ভাবে খাল দখল করে গড়ে তুলেছেন এক তলা বিশিষ্ট পাকা বসতবাড়ি। খালের পাশে গড়ে উঠা বেশ কয়েকটি ভবনের একই হাল।

 

এই বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে খাল দখলকারী মোঃ সোহেল যুগের চিন্তাকে বলেন, “খালের অংশে আমাদের বাড়ি অবস্থিত তা ঠিক, কিন্তু আমি ২০১২ সালে ‘সামছু মিয়া’ নামে এক ব্যক্তির কাছ থেকে বাড়িটি কিনেছিলাম। তাই খাল আমি দখল করিনি। পূর্বের বাড়ি ওয়ালা সামছু মিয়াই খাল দখল করে বাড়ি নির্মান করেছিলেন।” এক প্রশ্নের জবাবে সোহেল বলেন- “প্রায় বছর খানেক আগে ইউনিয়ন পরিষদ থেকে খাল দখলমুক্ত করার জন্য বেকু চালানো হয়েছিল। আমার বাড়ির নিচের কিছু অংশ ভাঙ্গা হয়েছে। উপরের অংশ এবং নিচের টয়লেট এখনও খালের জমিতে আছে। এগুলো সরিয়ে ফেলব। শুধু আমার বাড়িই নয়, আশপাশের প্রত্যেকের বাড়িই এই খালের উপর গড়ে উঠেছে।”

 

এদিকে, এভাবে খাল দখল ও ভরাট হওয়ায় এসব এলাকার বিভিন্ন স্থানে দেখা দিয়েছে জলাবদ্ধতা। চরম ভোগান্তি পোহাচ্ছে স্থানীয় বাসিন্দারা। এ বিষয়ে এনায়েতনগর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান যুগের চিন্তাকে বলেন, “খালের পাশে যেসকল প্রভাবশালী ব্যক্তিরা আছেন, তারা পর্যায়ক্রমে খালটি দখলে নিয়েছেন। খালের অস্তি এখন নেই। অথচ এই খাল দিয়েই আগে নৌকা চলতে দেখেছিলাম। ফাজেলপুর খালের সাথে কালিয়ানী খালের সংযোগ রয়েছে। এই কালিয়ানী খাল ফাজেলপুর, পঞ্চবটি ও কাশীপুর হয়ে একেবারে শীতলক্ষ্যায় গিয়ে মিলেছে। কিন্তু এই খালও এখন অস্তিত্ব সংকটে। জেলা প্রশাসক মহোদয় মিটিংয়ের মাধ্যমে জানিয়েছেন যে, দখল হয়ে যাওয়া খালগুলো ১৫ দিনের মধ্যে শনাক্ত করে অবৈধ দখল উচ্ছেদ করা হবে। তাই আশা করা যায়, দ্রুতই খালগুলো উদ্ধার হতে যাচ্ছে। আর প্রতিবছরই আমরা খালগুলো ভেকু দিয়ে খনন করে থাকি।

 

ইতিপূর্বেও অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করা হয়েছিলো। কিন্তু আবারও দখলে নিচ্ছে। আর আমাদের ইউনিয়নে ময়লা ফেলার জন্য নির্দিষ্ট কোন ডাম্পিং না থাকায় স্থানীয়রা খালের মধ্যেই গৃহস্থালি ও কারখানার ময়লা ফেলছে। এতে করে খাল পরিস্কার করলেও তা ভরাট হয়ে যাচ্ছে। তাই ময়লা ফেলার জন্য যাতে নির্দিষ্ট ডাম্পিং পয়েন্টের জায়গা দেয়া হয়, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কাছে সেই অনুরোধ জানাই।’

 

এই বিষয়ে নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আরিফা জহুরার সাথে যোগাযোগ করা হলে দৈনিক যুগের চিন্তাকে তিনি বলেন, ‘১৫ দিনের মধ্যে আমরা ডিএনডি ও ডিএনডির বাইরে সদর উপজেলার মধ্যে অবস্থিত সকল খালের অবৈধ দখলদারদের তালিকা তৈরী করবো। পরবর্তীতে সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে। এরই মধ্যে গত ২৭ জুন আমরা জলাবদ্ধতা নিরসনকল্পে মিটিং করেছি। তবে, সেখানে বদ্ধভূমি সংলগ্ন খালের বিষয়টি উপস্থাপন করা হয়নি। যেহেতু জানতে পারলাম, সেহেতু এই খালের বিষয়ে খোঁজ-খবর নিয়ে তালিকাভুক্ত করবো। আর ময়লার ডাম্পিং পয়েন্টের ক্ষেত্রে ইউনিয়ণ পরিষদ থেকে আমাদের জায়গা দেখালে ওই জায়গাটা ডাম্পিং পয়েন্ট করার জন্য আমরা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয় থেকে অনুমোদনের ব্যবস্থা করবো।’