দীর্ঘশ্বাস ও বোবা কান্না মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্তের
লতিফ রানা
যুগের চিন্তা
প্রকাশিত : ০৮:৪৩ পিএম, ৮ জুলাই ২০২১ বৃহস্পতিবার
প্রায় দেড় বছরের মতো হলো করোনার থাবায় পড়েছে বাংলাদেশ। এই সময়ে দেশের ব্যবসা বাণিজ্য, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে মানুষের আয় উপার্জনে ব্যাপক ধস নেমেছে। আর এই মহামারিতে মানুষের অন্যতম মৌলিক চাহিদাগুলো বিশেষ করে অন্ন, বস্ত্র, চিকিৎসা ও শিক্ষা ব্যবস্থায় চরম দুর্যোগ নেমে এসেছে।
এই দুর্যোগের সময় সবচেয়ে বড় বিপর্যয়ের মুখে যারা পড়েছেন তারা হলেন নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত। এই দুর্যোগে তাদের জীবনযাপনের মানদÐটা কোথায় আছে! তাদের বেদনা, কান্না, কষ্ট এবং পাওয়া না পাওয়ার হিসাব-নিকাশ কতটা জটিল অবস্থায় আছে! তারা প্রতিদিন কতটা না বলা অমানবিক যন্ত্রণার মধ্যে জীবনযাপন করে থাকে। অথচ তাদের কষ্ট কাউকে বলতে পারেন না। তারা নিদারুণ কষ্টের মধ্যে থেকে, সকল কষ্ট বুকের মধ্যে চাপা দিয়ে মেকি হাসির ভান করে অন্যকে মিষ্টি সুরে বলতে হয় আমি খুব ভালো আছি।
মধ্য ও নিম্নবিত্তের প্রকৃত কোন সংজ্ঞা নাই। বিভিন্ন মনীষীগণ বিভিন্ন মানদণ্ড এর বিচার করেন। তবে আমরা স্বাভাবিকভাবে এতটুকু বুঝতে পারি যে, যেসব পরিবার মোটামুটি স্বাচ্ছন্দে সারা মাস পার করতে পারে, একই সাথে হঠাৎ করে কোন সমস্যায় দুএক মাস রোজগারে কোন প্রকার সমস্যা হলে কিংবা সাধারণ মানের কোন জরুরী সমস্যায় পড়লে তা কাটিয়ে তুলতে পারে তারা মধ্যবিত্ত। আর যারা একটি মাস পার করার জন্য নির্দিষ্ট একটি ছকে চলতে হয়, কিন্তু দুএক মাস হঠাৎ করে রোজগারে কোন সমস্যা হলে কিংবা সাধারণ মানের কোন সমস্যায় পড়লে তার জন্য ধার দেনা করতে হয় তবে তা পরবর্তীতে ধীরে ধীরে কাটিয়ে উঠতে পারে তারা হলো নিম্নবিত্ত।
এই দুই ধরণে স্তরে যারা আছেন তাদের সামাজিক অবস্থানের কারণে নিজের সম্মানের কথা ভেবে নিজেদের সমস্যার কথা কাউকে বলতেও পারেন না। এমনকি তাদের চলাফেরায় অন্যের কাছে যাতে হেয় প্রতিপন্ন হতে না হয় সে জন্য তারা সব সময় নিজেদের সমস্যার কথা গোপন রাখে। করোনার দুঃসময়ে তাদের মধ্যে যারা বাড়িওয়ালা আছেন অথচ একটি রুম খালি থাকলে মাস চলতে হিমসিম খেতে হয়, যারা ভাড়া বাড়িতে থাকেন মাস শেষে বাড়িওয়ালার ভাড়ার টাকা দিতে হিমসিম খেতে হচ্ছে তাদের সংসার চালানোর সমস্যার কথা অন্যকে কীভাবে বলবেন। তাদের কেউ বুঝতেও চাইবেন না। তাদের বোবা মন কান্নায় ভরে ওঠলেও তা থাকে সবার চোখের আড়ালে। করোনার এই দুঃসময়ে এ ধরণের বিভিন্ন পেশার মানুষের সাথে বলে তাদের এ ধরণের একটি চিত্র ফুটে ওঠে।
নবীগঞ্জ গুদারাঘাট এলাকায় কথা হয় প্রবাস ফেরত শেখ মো. আইয়ুব আলীর সাথে। তিনি জানান, তিনি থাকেন সিদ্ধিরগঞ্জ গোদনাইল এলাকায়। নদীর পূর্ব পার বন্দরে তার পৈত্রিক সম্পত্তি বিক্রি করে সেই টাকায় গোদনাইল এলাকায় তিন শতাংশ জায়গা ক্রয় করেন তিনি। এখানে দুই তলা ভবনের কাজ শেষ করতে তাকে ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ করতে হয়, যার কিস্তি প্রতি মাসে পরিশোধ করতে হয়। ভবনের তিনটি ফ্ল্যাটের একটিতে নিজে থাকেন আর দুইটি ভাড়া দেন। দুইটি ফ্ল্যাট থেকে ১০ হাজার করে মাসে ২০ হাজার টাকা আসত। কিন্তু গত ঈদুল ফিতরের পর থেকে তার একটি ফ্ল্যাট খালি পড়ে আছে।
আইয়ুব আলী জানান, চিটাগাংরোড এলাকায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ১৪ হাজার টাকা বেতনে একটি চাকরি করতাম, এই বছরের প্রথম দিকে ব্যয় কমানোর জন্য লোক ছাটাই করে তখন থেকে সেই চাকুরীটা আর নাই। এখন মাস শেষে তার গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানি বিল দিয়ে সংসার চালানের মতো কোন টাকা থাকে না। কিস্তির টাকা পরিশোধ করা এখনো বাকি আছে। তিনি এখন কি করবেন তার কোন কুল কিনারা না পেয়ে খুবই হতাশায় আছেন। তিনি বলেন, প্রতিমাসে বাজার খরচ ও সংসার খরচের জন্য কার কাছে হাত পাতবো বলেন। লকডাউনের এই সমস্যার কারনে আমরাতো কারো কাছে যেতেও পারবো না, আবার না খেয়ে থাকাও সম্ভব না।
হাজীগঞ্জ তল্লা এলাকার বাসিন্দা প্রত্যুষ সাহা জানান, শহরে তার একটি দর্জি দোকান আছে। তার এখানে দুইজন কারিগর কাজ করেন। করোনার দ্বিতীয় ধাপে গত রমজানের আগ থেকেই দোকান পাট প্রায় বন্ধ ছিল। রোজার ঈদের সময় তিনি তার কারিগরদের কিছু করে টাকা দিয়ে অন্য জায়গায় কাজ খুজে নেওয়ার কথা বলে দিয়েছেন। এরমধ্যে সুযোগ পেলে কয়েকদিন দোকান খোলা রাখলেও এখন আবার দোকান পাট বন্ধ। সংসারে দুই মেয়ে আর স্ত্রীসহ এখন তারা চারজন সদস্য। তিনি হতাশ সুরে বলেন, কাজ বন্ধ, কিন্তু পেট তো আর বন্ধ করে রাখা যায় না। এখন কোথায় যাবেন কার কাছে যাবেন সেটা ভাবতেই পারছেন না। তিনি বলেন, আমাগো দিকে কে চাইবে বলেন।
খানপুর এলাকার আহমেদ ফয়সাল শুভ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার চাকুরীর জন্য অনেক চেষ্টা করেও সফল হননি। শেষে তিনি একটি কিন্ডারগার্টেনে নাম মাত্র বেতনে শিক্ষকতার চাকুরী নেন। তারপর তিনি তার বাসার একটি রুমে কোচিং সেন্টারের মতো করে শিক্ষার্থীদের ব্যাচ পড়ান। আর তাতে মোটামুটি তার সংসার ভালভাবেই চলে যেত। কিন্তু করোনার প্রথম ধাপেই তার কিন্ডারগার্টেন বন্ধ হয়ে যায়। এরপর সংসারের প্রয়োজনে তিনি কিছু সংখ্যক শিক্ষার্থীকে শিক্ষাদান চালিয়ে গেলেও করোনা মহামারির কারনে রোজগার কমে যাওয়ায় ধীরে ধীরে শিক্ষার্থীদের সংখ্যাও কমতে থাকে। ফলে এই পেশার মাধ্যমে তার সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়ে।
তাই তিনি বর্তমানে একটি ফার্মেসীতে সেলসম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি বলেন, এ দুঃসময়ে যারা উচ্চবিত্ত আছেন তাদের আয় রোজগার একটু মন্দা হতে পারে কিন্তু তাদের কিন্তু সংসার চালানোর অক্ষমতার মতো সমস্যা বা না খেয়ে থাকার মতো সমস্যা হয়না। যারা বিত্তশালী আছেন তাদের ব্যবসা হয়তো একটু মন্দা হতে পারে লাভ কম হতে পারে, কিন্তু সংসার নিয়ে ভাবতে হয় না। এমনকি যারা দিন মজুর বা দরিদ্র আছেন তারা যেকোন এক পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় চলে যেতে পারেন, একই সাথে তারা মানুষের কাচে সাহায্য সহযোগিতা চাইতে পারেন। কিন্তু আমাদের নি¤œবিত্ত বা মধ্যবিত্তরা এখন গলায় কাঁটা আটকে যাওয়ার অবস্থায় আছি। না পারছি বের করতে না পারছি গিলতে। আমাদের বুকের মধ্যে কীসের বেদনা প্রতিনিয়ত আহত করছে আমরা তা কাউকে বলতেও পারি না।