কঠোর লকডাউনেও অসতর্ক জনগণ
লতিফ রানা
যুগের চিন্তা
প্রকাশিত : ০৮:৩২ পিএম, ১১ জুলাই ২০২১ রোববার
করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর তালিকা দীর্ঘ হচ্ছে। প্রায় প্রতিদিনই মৃত্যুর হারের রেকর্ড ভাঙছে। তাই করোনার এই মহামারিতে আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার রোধ করতে সব ধরণের প্রচেষ্টা চালাচ্ছে সরকার। প্রতিদিন সরকারের এই কাজে সহযোগিতা করতে এবং জনগণকে এই বিষয়ে সতর্ক করতে মাঠে কাজ করছে প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারি বাহিনী, সামরিক বাহিনী, আধাসামরিক বাহিনীসহ বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। কিন্তু তারপরও সরকারের সব ধরণের প্রচেষ্টাকে বৃদ্ধঙ্গুলি দেখিয়ে অবাধে চলাফেরার চেষ্টা করছেন তারা।
এ বিষয়ে জনগণের মধ্যে এতটাই উদাসীনতা যে, করোনায় কি হলো তা দেখার সময় তাদের মাঝে নাই। যেন সরকারের এই প্রচেষ্টাকে ভন্ডুল করতে তারা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। গত ১ জুলাই থেকে সরকার ঘোষিত কঠোর লকডাউনের প্রথম দশ দিনের চিত্রের উপর ভিত্তি করে এমন তথ্যই পাওয়া যায়। কোন সাধারণ অযুহাতকে কেন্দ্র করে তারা বেরিয়ে পড়ছেন রাস্তাঘাটে। যেন তারা প্রশাসনের কাজের নজরদারি করতে বের হচ্ছেন।
এর মধ্যে বন্দর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শুক্লা সরকারের নেতৃত্বে বন্দর ঘাট এলাকায় করোনার বিধি নিষেদ তদারকী করতে গিয়ে দেখেন মানুষ মিথ্যে মেডিকেল খাম নিয়ে ডাক্তারকে রিপোর্ট দেখাতে যাচ্ছেন বলে ঘাট পার হয়ে শহরের আসার চেষ্টা করছেন। তার কথায় সন্দেহ হওয়ায় যখন তার কথার সত্যতা যাচাই করতে খামটি প্রশাসন হাতে নেন তখন দেখা যায় তার হাতে মেডিকেল খামের অংশ বিশেষ ছিল এবং তাতে কোন এক্সরে ফিল্ম নেই তিনি প্রশাসনকে ধোকা দেওয়ার জন্য এই প্রতারণা করেন।
লকডাউন চলাচলের সময় গণপরিবহন বলতে শুধু প্যাডেল চালিত রিকশা চলাচলের অনুমতি থাকলেও সুযোগ খুঁজে চলছে সিএনজি, ইজিবাইকসহ অপ্রয়োজনীয় সব ব্যক্তিগত গাড়ি। মোটর সাইকেল নিয়ে অতি উৎসুক জনতাদের দেখা যায় অনর্থক ঘুরাঘুরি করতে। শহরের চাষাড়া ও খানপুর এলাকায় স্বাস্থ্যবিধি পালনে সরকারি তদারকি থাকায় অনেক অবৈধ গাড়িকেই দেখা যায় তল্লা, খানপুর, ডনচেম্বার হয়ে মিশনপাড়া এলাকা দিয়ে বের হতে। করোনা এই মহামারিতেও তারা পালিয়ে চলাচল করে ঠিকই, তবে যাত্রী কিন্তু কম নিচ্ছেন না। গাদাগাদি করে ইজিবাইকে ৭ জন সিএনজিতে ৫ থেকে ৬জন (চালকসহ) নিয়ে চলাচল করছেন। তবে সবচেয়ে করুন অবস্থা নদী পথ ও মহল্লার মার্কেটগুলোতে। নদী পথে নৌকায় এই চরম দুর্যোগের মধ্যেও গাদাগাদি করে পার করা হচ্ছে যাত্রী। সেখানে তিল ধারণের কোন ঠাই নেই। মার্কেটগুলোর বিকেলের পর থেকে বিশেষ করে সন্ধ্যা রাতে খুবই ভয়ানক অবস্থায় চলাফেরা করছে জনগণ। এসব জায়গায় স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার কোন বালাই নেই।
শুক্রবার সন্ধ্যায় সিদ্ধিরগঞ্জ থানার চৌধুরীবাড়ি এলাকার মার্কেটসহ চৌধুরীবাড়ি চৌরাস্তা এলাকায় সড়কগুলোতে দেখা যায় খুবই শোচনীয় অবস্থা। ছয় বছরের ছোট শিশুকে নিয়ে নদীর পূর্ব পার বন্দর এলাকার লক্ষণখোলা থেকে এখানে চৌধুরীবাড়ি এলাকায় জুতা কিনতে এসেছেন রাশিদা বেগম। তিনি জানান, বেশ কিছুদিন যাবতই তার মেয়ে নতুন জুতাসহ কিছু কসমেটিক্স এর জন্য বায়না ধরেছেন। শুক্রবার ছুটির দিন তাই বের হয়েছেন তিনি। তাদের কারো মুখে মাস্ক নেই কেন প্রশ্ন করলে রাশিদা বলেন, শুধু করোনায়ই কি মানুষ মরে! এছাড়া কি মানুষ মরে না? এক্সিডেন্টেও মানুষ মরে, তাহলে কি মানুষ গাড়ি চলাচল করা বন্ধ করে দিব? একদিনে মৃত্যুর সংখ্যা দুইশতের উপর জানালে উল্টো তিনি বলেন, সরকার করোনার মৃতের সংখ্যা গননা করছে তাই এইটা জানেন, প্রতিদিন স্বাভাবিক মৃত্যুসহ বিভিন্ন কারনে কতজন মারা যায় এইটাতো সরকার গণনা করে না তাই সেই বিষয়ে জানে না। আমার প্রয়োজন মনে হইছে তাই আইছি। মরন আইলে কেউ রাখতে পারবে না। তার কথায় বুঝলাম, তার সাথে কথা বলে লাভ নেই, মনে তিনি প্রতিজ্ঞা করেছেন যে, তিনি কোন নিয়মকানুন মানবেন না।
শনিবার বিকেলে নবীগঞ্জ গুদারা ঘাটে দেখা যায়, যাত্রীতে ট্রলার ভর্তি হয়ে গেছে তারপরও মানুষ ওঠার চেষ্টা করছে। যখন ওঠার মত কোন সুযোগ পাচ্ছেন না তখন ট্রলার ছেড়ে দিচ্ছেন আবার পরের ট্রলার আসতে যাত্রীর উপস্থিতির সংখ্যাও দ্রæত বাড়ছে এবং পুনরায় সেই আগের অবস্থায় চলে আসে এবং পরের ট্রলারে উঠার সময় সেই একই ঘটনা ঘটছে। এ সময় বন্দর মিনার বাড়ি এলাকা থেকে আসা সিরাজুল ইসলাম জানান, তিনি খানপুর বউ বাজার এলাকার একটি দোকানে চাকরী করেন। তিনি প্রতিদিন রাত ৮টার দিকে বাড়ি ফিরেন। আজ বাড়িতে কাজ থাকায় মালিককে বলে আগে চলে এসেছেন। লকডাউনের বিষয়ে তিনি বলেন, লকডাউন কি আমাদের পেটের চিন্তা করবে! এই লকডাউন কতদিন থাকবে তা কেউ জানে না। মানুষ কতদিন ঘরে বন্দি থাকবে! মুখে মাস্ক নেই কেন জানতে চাইলে তিনি পাল্টা যুক্তি দিয়ে বলেন, আমাদের ধীরে ধীরে মাস্কা ছাড়া চলার অভ্যাস করতে হবে। তাই মাস্ক ছাড়া চলার চেষ্টা করছি। রাস্তায় পুলিশে ধরলে কি বলবেন জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন সব সময় পকেটে মাস্ক রেখে দেই। সামনে পুলিশ দেখলে মুখে দেই।
এ বিষয়ে কথা বললে নারায়ণগঞ্জ এর জেলা প্রশাসক মো. মোস্তাইন বিল্লাহ জানান, জনগণের মধ্যে অনেক উদাসীনতা আছে। কিছু কিছু জায়গায় আমরা সাড়া পাই, আবার কিছু কিছু মানুষ অহেতুক নানা অজুহাতে বাইরে আসছে, না আসলেও হয় এমন অজুহাতে বাইরে আসছে। আমরা অনেক জায়গায় সাড়া পেয়েছি আবার অনেক জায়গায় সাড়া পাইনি। অনেক লোককে সচেতন করতে পেরেছি, আবার অনেক লোককে সচেতন করতে পারিনি। জেলা প্রশাসক আরো বলেন, আমরা প্রতিদিনই অভিযান পরিচালনা করছি, মার্কেটগুলো বন্ধ করছি, জরিমানাও হচ্ছে।
আজকেও (শনিবার) প্রায় ৭০ থেকে ৭৫টি মামলা হয়েছে এবং প্রায় লক্ষাধিক টাকা জরিমানাও করা হয়েছে। আমরা কাজ করে যাচ্ছি। এই অভিযান পরিচালনা অব্যাহত থাকবে উল্লেখ করে নারায়ণগঞ্জবাসির উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ‘কোভিডের অবস্থা খুব খারাপ, আমরা এখন একটি হটস্পটের মধ্যে আছি। আমরা চার-পাঁচটা দিন যদি বাসায় একটু থাকি, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলি, নিতান্তই প্রয়োজন না হলে আমরা বাইরে না আসি। তাহলে অন্ততপক্ষে আমরা কোভিড কমাতে পারব, নারায়ণগঞ্জকে ভাল রাখতে পারব। নারায়ণগঞ্জ ভাল থাকলে সারাদেশই ভাল থাকবে। সারাদেশের অর্থনীতি ভাল থাকবে। আপনারা বাসায়ই থাকুন নিরাপদে থাকুন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন।’