মঙ্গলবার   ২৬ নভেম্বর ২০২৪   অগ্রাহায়ণ ১১ ১৪৩১   ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

পোড়া রোগীর পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা নেই নাঃগঞ্জে

যুগের চিন্তা অনলাইন

যুগের চিন্তা

প্রকাশিত : ০৭:০০ পিএম, ৩ আগস্ট ২০২১ মঙ্গলবার

# বোমা’র মতো বিস্ফোরণ ঘটে-ফায়ার সার্ভিস


# হাসপাতাল প্রয়োজন নেই- সিভিল সার্জন


#চলতি বছর ৬৫ জনের মৃত্যু, গেল বছর দ্বগ্ধ হয়ে মারা গেছে ৩৯ জন



ছয়তলা একটি ভবনে হঠাৎ বিকট শব্দ, কোন কিছু বুঝে উঠার আগেই দগ্ধ হন ছয়জন। গুরুত্বর আহত অবস্থায় তাদেরকে নিয়ে যাওয়া হয় নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে। সেখান থেকে পাঠিয়ে দেয়া হয় ঢাকায়। ঘটনাটি ফতুল্লার মাসদাইর পতেঙ্গা এলাকার তবে এমন অনেক ঘটনায় দগ্ধ রোগীদের হাসপাতালে নেয়ার পরপরই অন্যত্র পাঠিয়ে দিচ্ছেন পোড়া রোগীর পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসকরা। 

 

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দাবি, আগুনে পোড়া রোগীদের প্রাথমিক চিকিৎসা ছাড়া কোন ব্যবস্থা নেই। ফায়ার সার্ভিস বলছে, অগ্নিদগ্ধ রোগীদের জন্য দ্রুত সেবার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন, তাহলে প্রাণহানি কমবে। ফায়ার সার্ভিসের সূত্রে জানা গেছে, গত ছয় মাসে আগুনে দগ্ধ হয়েছে অন্তত ৫০ জন মানুষ। গত বছরও দগ্ধ হন ৮২ জন। ৮৬ টি ঘটনায় দগ্ধ হয়ে মারা গেছেন ৩৯ জন। এর মধ্যে ফতুল্লার পশ্চিম তল্লা এলাকার বাইতুস সালাত জামে মসজিদে বিস্ফোরণের ঘটনায় ৩৪ জন মারা যান। চলতি বছর রূপগঞ্জের সেজান জুস কারখানার আগুনে ৫২ জন মারা গেছেন। তাছাড়া গ্যাস বিস্ফোরণ সহ আরও কয়েকটি আগুনের ঘটনায় আরও ১৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত অবস্থায় হাসপাতালে নেয়া হয়েছে অনেকে।  

 

সংস্থাটি বলছে, ২০২০ সালে ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত এ জেলায় গ্যাস থেকে ১০৬ টি বিস্ফোরণে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। যার মধ্যে ৮৬ টি ঘটনায় পাইপ লাইন গ্যাস থেকে বিস্ফোরণ।  ফায়ার সার্ভিসের এক তালিকায় প্রকাশ করা হয়, গত বছরে এ জেলায় ৫৯৪ টি অগ্নিকান্ড জনিত দূর্ঘটনা ঘটেছে। চলতি বছর জানুয়ারী থেকে এ পর্যন্ত আড়াইশতাধিত আগুনের সূত্রপাত ঘটেছে। এসব ঘটনায় আহত হয়েছেন অনেকে। তাদের প্রথমে চিকিৎসার জন্য নেয়া হয় নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে। সেখান থেকে অগ্নিদগ্ধ রোগীদের প্রাথমিক সেবা দিয়ে কিছুক্ষনের মধ্যে অন্য হাসপাতলে পাঠানো হয়ে থাকে। আগুনে পুড়ে আহত ও নিহতের স্বজনারও বলছেন দগ্ধ রোগীদের জন্য দ্রুত চিকিৎসা ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। শহরের তল্লায় মসজিদে বিস্ফোরণের ঘটনায় নিহত জুবায়ের ও জুলহাস ভাড়া থাকতেন ওই এলাকার মামুন মিয়ার বাড়িতে। বিস্ফোরনে তারা দগ্ধ হওয়ার পর মামুন তাদের হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলো।  

 

মামুন বলেন, আগুনে পুড়ে মারা যাওয়া জুবায়ের ও জুলহাস দগ্ধ হওয়ার পর তাদেরকে নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখান থেকে তাদের দ্রুত ঢাকায় পাঠিয়ে দিলো। আমার মতো আরও অনেকে তাদের দগ্ধ স্বজনদের নিয়ে গিয়েছিলো কিন্তু সবাইকে ঢাকার হাসপাতালে পাঠানো হয়। তিনি আরও বলেন, যদি নারায়ণগঞ্জে দগ্ধ রোগীদের জন্য চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকতো তাহলে হয়তো এতো মানুষ মারা যেতো না। ফতুল্লার মাসদাইর পতেঙ্গা এলাকার দগ্ধ হয়ে মারা যাওয়া সাব্বিরের ফুফা সুলতান মিয়া বলেন, ঘটনার তিন দিন আগে চাচাতো ভাই মিশালের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলো সাব্বির। কে জানতো তাদের বাড়িতে আগুন জ্বলবে? কোন কিছু বুঝে উঠার আগেই তারা আগুনে পুরে ৬ জন দগ্ধ হয়ে যায়। বিকট শব্দ হয়ে আশপাশের লোকজন ছুটে এসে তাদের ফায়ার সার্ভিসে খবর দেয়। তখন আহত অবস্থায় তাদের উদ্ধার করে ভিক্টোরিয়া হাসপাতালে নেয়া হলে সেখান থেকে ঢাকা পাঠিয়ে দেয়া হয়।

 

তিনি আরও বলেন, যদি নারায়ণঞ্জের হাসপাতালে বার্ণ ইউনিট থাকতো তাহলে যারা আগুনে পুরে মারা গেছে তাদের মধ্যে কেউ কেউ বাঁচতে পারতো। তার সাথে এক মত প্রকাশ করেছেন ফায়ার সাভির্সের উপসকারি পরিচালক আব্দুল্লাহ আল আরেফীনও। তার মতে ৮০ লাখ মানুষের এ জেলায় প্রায় প্রতিদিন অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটছে। দগ্ধ হচ্ছেন অনেকে তাদের যদি এ জেলায় চিকিৎসা করা হতো তাহলে অনেকে দ্রুত সেবা পেয়ে যেতেন।  আব্দুল্লাহ আল আরেফীন বলেন, গত বছরের তুলনায় চলতি বছরও আগুনের ঘটনা কম নয়। তার মধ্যে গ্যাস বিস্ফোরণ ভয়াবহ। কারণ পাইপ লিকেজ হলে কক্ষের আনাচে কানাচে থাকা বিভিন্ন খালি জায়গা গ্যাস জমাট বাঁধে। আগুন কিংবা বিদ্যুৎ যে কোন ভাবে স্পার্ক হলে এ ঝলকে বোমা’র মতো বিস্ফোরণ ঘটে। গ্যাস বিস্ফোণের আগুনে দগ্ধ হতে মাত্র ১৫ সেকেন্ড সময় লাগে। এই সময়ের মধ্যে শরীরের অধিকাংশ অংশ পুড়ে যায়। সে কারণে দগ্ধ ব্যক্তিদের দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হয়। অগ্নিদগ্ধ রোগীদের জন্য দ্রুত সেবার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন, তাহলে প্রাণহানি কমবে।  

 

তবে আগুনে পোড়া রোগীদের  জন্য প্রাথমিক চিকিৎসা ছাড়া অন্য কোন ব্যবস্থা নেই বলে জানালেন হাসপাতালের প্রধান। ভিক্টোরিয়া হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক আসাদুজ্জামান বলেন, বয়স ও ওজনের হিসাব এবং শরীরের ১০ শতাংশ এর বেশী পুড়া হলে তাদের সাথে ঢাকার হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়া। আগুনে পোড়া রোগীদের প্রাথমিক চিকিৎসা ছাড়া কোন ব্যবস্থা নেই। তবে এ জেলায় বার্ণ হাসপাতাল হবে বলে জানিয়েছেন তিনি। এবিষয়ে জানতে চাইলে নারায়ণগঞ্জের সিভিল সার্জন ডাক্তার ইমতিয়াজ আহম্মেদ বলেন, এখানে কোনা বার্ণ ইউনিট বা  দগ্ধ রোগীদের হাসপাতাল প্রয়োজনিয়তা (প্রয়োজন) নেই। কারণ বছরে চার পাঁচ জন মারা যায় আগুনে। কিন্তু হার্ট এট্যাক ও ক্যান্সারে বেশি মানুষ মনে তাই  আগে তাদের হাসপাতাল প্রয়োজন।  যারা দগ্ধ হবেন তাদের কে ঢাকাই পাঠানো হবে জানিয়ে তিনি আরও বলেন, বছরে কত মানুষ সড়ক দূর্ঘটনা মারা যায় তাহলে কি পঙ্গ হাসপাতাল বানানো হবে।

 

গণমাধ্যম বলছে, ফতুল্লার তল্লার জামাই বাজার এলাকার একটি ভবনে বিস্ফোরণে শিশুসহ ১১ জন দগ্ধ হয়েছেন। তাদের মধ্যে একই পরিবারের পাঁচজনকে রাজধানীর শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্ট্রিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়েছে। তাদের মধ্যে আলেয়া বেগম নামে এক নারীর মৃত্যু হয়েছে। তার আগে বন্দর উপজেলার নবীগঞ্জে রান্নাঘরের গ্যাসের লাইন থেকে গ্যাস নিয়ে পানির পাইপ পরিষ্কার করার সময় ৫ জন দগ্ধ হয়েছেন। ফতুল্লার ফতুল্লার গাবতলি নতুন বাজারে একটি বাড়িতে অগ্নিকা-ের ঘটনায় একই পরিবারের তিনজন দগ্ধ হন। আগুনে দগ্ধ হয়ে মৃত্যুর সংখ্যাও কম এ জেলায়। এ বছরের গত ৮ জুলাই রাতে হাশেম ফুড লিমিটেডের কারখানায় আগুন লাগে। শুরুতে তিনজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেলেও পরের দিন উদ্ধার করা হয় ৪৯ জনের মরদেহ। মোট মৃতের সংখ্যা দাঁড়ায় ৫২ জনে। ২২ জানুয়ারি রূপগঞ্জ উপজেলার পূর্বাচল এলাকায় আগুনে পুড়ে একই পরিবারের চার জনের মৃত্যু হয়েছে। তার আগে রূপগঞ্জে লোহা গলানোর একটি কারখানায় ভাট্টি বিস্ফোরণে গলিত লোহা শরীরে পড়ে দগ্ধ হওয়া আরও দুই শ্রমিকের মৃত্যু হয়।

 

১২ এপ্রিল রাতে শহরের আমলাপাড়ার প্রেসিডেন্ট রোড এলাকায় গ্রীন জিএম গার্ডেন নামের একটি ভবনের আটতলায় গ্যাস আগুনে দগ্ধ হয়েছেন ২ জন। তাদের মধ্যে চিকিৎসাধীন অবস্থায় এক নৈশপ্রহরীর মৃত্যু হয়। ৯ মার্চ ফতুল্লার মাসদাইরের পতেঙ্গা এলাকায় ছয় তলা ভবনের ষষ্ঠ তলায় গ্যাস পাইপের লিক থেকে ফ্ল্যাটে গ্যাস জমে বিস্ফোরণ ঘটে। এতে একই পরিবারের শিশুসহ ৬ জন দগ্ধ হন। এর মধ্যে চিকিৎসাধীন অবস্থায় চারজনের মৃত্যু হয়। ৭ জানুয়ারী ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের বিলাস নগর এলাকায় গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে রফিক উল্লাহ (৫০) নামে এক মিস্ত্রির মারা যান। ১ জানুয়ারী আড়াইহাজারে একটি রেস্তোরাঁয় গ্যাসের লাইনে বিস্ফোরণে তিনজন অগ্নিদগ্ধ হন। তাদের হাসপাতালে একজনের মৃত্যু হয়।